‘সামাজিক অসন্তোষ আরও বাড়তে পারে’

সম্প্রতি প্রকাশিত আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা অক্সফামের প্রতিবেদনে জানা যায় বর্তমানে ২৬ জন ধনী ব্যক্তির কাছে যে পরিমাণ সম্পদ রয়েছে, তা পৃথিবীর সব গরীব লোকের অর্ধেকের সমান। অর্থাৎ ২৬ জন মানুষের হাতে ৩৮০ কোটি মানুষের সমান সম্পদ!
অর্থনীতিবিদ খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ (বামে), অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত

সম্প্রতি প্রকাশিত আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা অক্সফামের প্রতিবেদনে জানা যায় বর্তমানে ২৬ জন ধনী ব্যক্তির কাছে যে পরিমাণ সম্পদ রয়েছে, তা পৃথিবীর সব গরীব লোকের অর্ধেকের সমান। অর্থাৎ ২৬ জন মানুষের হাতে ৩৮০ কোটি মানুষের সমান সম্পদ!

বাংলাদেশে এর প্রভাব নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার অনলাইন কথা বলে দুজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এবং অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান সঙ্গে। তারা এ নিয়ে তাদের উদ্বেগ প্রকাশের পাশাপাশি জানিয়েছেন বাংলাদেশে সামাজিক ন্যায়বিচার আরও বাধাগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, “যখন বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছিলো তখন সম্পদের এমন বিস্তর বৈষম্যের বিষয়টি ছিলো না। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার যে আধুনিক সংজ্ঞা যেটাকে বলি ‘ওয়েলফেয়ার ইকোনমি’ সেটি যারা মেনে নিচ্ছেন তাদের দেশে এমনটি হয় না। যেমন, নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক, জার্মানি এবং যুক্তরাজ্যের মতো ওয়েলফেয়ার স্টেটে এমনটি হয় না।”

সেখানে কেনো এমনটি হয় না?- এর উত্তরে তিনি বলেন, “সেসব দেশগুলোতে ধনী লোক রয়েছেন কিন্তু, সেই মাত্রার গরীব লোক নেই। আমাদের দেশটিও সেরকম হওয়ার কথা ছিলো। কারণ আমাদের সংবিধানে রাজনৈতিকভাবে গণতন্ত্র এবং অর্থনৈতিকভাবে সমাজতন্ত্রের কথা বলা আছে। সেই সমাজতন্ত্রের মানে হলো ওয়েলফেয়ার ইকোনমি। যেটি নরওয়ে, সুইডেন বা সেসব দেশে রয়েছে। তারা তা করতে পারলে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ কেনো করতে পারবে না?”

বাংলাদেশে সমাজতন্ত্রের বাস্তবায়ন বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “অনেক মন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়, তাদের কেউ কেউ বলেন- সমাজতন্ত্র-তো পুরনো কথা। আমরা এখন মুক্তবাজার অর্থনীতিতে রয়েছি। তাদেরকে বলতে চাই যে মুক্তবাজারের সঙ্গে সমাজতন্ত্রের কোনো সংঘাত নাই। কিন্তু, পুঁজিবাদী অর্থনীতির সঙ্গে সমাজতন্ত্র বা ওয়েলফেয়ার ইকোনমির সংঘর্ষ রয়েছে। দুইটা দুই জিনিস। বর্তমানে সাংবিধানিকভাবে আমাদের সমাজতন্ত্র অর্থনীতি জারি রাখার বাধ্যবাধকতা থাকলেও আমরা চর্চা করছি পুঁজিবাদ।”

বাংলাদেশে পুঁজিবাদের প্রভাব কেমন?- এ প্রসঙ্গে এই বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদের মন্তব্য, “এই পুঁজিবাদের কারণে আমাদের এমন দুরবস্থা হচ্ছে। আমরা একটি গরীব দেশ অথচ আমাদের দেশে অতি ধনীদের সংখ্যা বৃদ্ধির দিক থেকে শতকরা হিসাবে সবচেয়ে বেশি। আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, জাপানের চেয়েও বেশি। আর ধনীদের সংখ্যা বৃদ্ধির হিসাবে বাংলাদেশ তৃতীয়। কারণ হলো যে আমরা সংবিধান লঙ্ঘন করছি। তা লঙ্ঘন করে পুঁজিবাদী অর্থনীতি চর্চা করছি।”

এমন পরিস্থিতিতে আমরা কী করতে পারি?- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমরা যদি সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী সমাজতন্ত্র বা কল্যাণ অর্থনীতিতে নীতিগতভাবে চলে আসি- তাহলে বাজার অর্থনীতি থাকবে, এর কোনো পরিবর্তন হবে না- তখন আমরা অনুসরণ করবো নরওয়ে, সুইডেন, জার্মানি এদেরকে।”

বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের সামাজিক ন্যায়বিচার কিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে মনে করেন?- এর উত্তরে তিনি বলেন, “ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে কী বলছেন! বাংলাদেশে সামাজিক ন্যায়বিচার অনেকাংশে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দেশে দরিদ্রলোকের সংখ্যাই বেশি। অতি দরিদ্র মানুষ রয়েছে দুই কোটির ওপরে। দরিদ্র লোকের সংখ্যা হবে চার কোটি। আমাদের মতো গরীব দেশের জন্যে পুঁজিবাদী অর্থনীতি খুবই ধ্বংসাত্মক। আমি বাংলাদেশ নিয়ে উদ্বিগ্ন।

এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর ডিস্টিংগুইশড ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে আমি অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। অন্যান্য যেসব ন্যায়বিচারের অভাব হয় সেটা অনেক সময় অর্থনৈতিক বৈষম্য থেকে হয়। তখন আইনের আশ্রয় নিতে গেলেও তার ওপর প্রভাব পড়ে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও ন্যায়বিচারের অভাব হয়। সামাজিক ন্যায়বিচারের একটা বড় উপাদান হলো অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার। এটা না থাকলে অন্যান্য সামাজিক অধিকারের ওপর প্রভাব পড়ে।”

নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক- এসব স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশে উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, “আমরা দেখেছি সেখানে সামাজিক বিভিন্ন ধরণের রাজস্ব ব্যবস্থা ও সরকারি ব্যয় ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বৈষম্যকে অনেকক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু, উন্নয়নশীল দেশগুলো যারা এ পথে যাচ্ছে, সেখানে দেখছি আয় বৈষম্য, ভোগ বৈষম্য এবং সম্পদ বৈষম্য- এই তিনটিই বৃদ্ধির দিকে। এর একটা বড় কারণ হলো যে সেসব দেশে কর এবং পুনর্বণ্টনের ব্যবস্থাগুলো অনেক দুর্বল রয়ে গেছে।”

এর মধ্যে আমাদের দেশও কি রয়েছে?- এর উত্তরে তিনি বলেন, “আমাদের দেশেও এর প্রতিফলন দেখছি। যার কারণে আমাদের দেশে সরকারের পরিসংখ্যান ব্যুরো হিসাবে আয় বৈষম্য ০.৪৬ থেকে ০.৪৮ হয়ে গেছে। আমরা হিসাব করে দেখেছি যে ২০১০ সালে সবচেয়ে উপরের ৫ শতাংশ মানুষের আয় এবং সবচেয়ে নিচের ৪০ শতাংশ মানুষের আয়ের ক্ষেত্রে পার্থক্য বেড়েছে। তবে সবারই আর্থসামাজিক বিভিন্ন সূচকে উন্নতি হচ্ছে।”

সবারই আর্থসামাজিক বিভিন্ন সূচকে উন্নতি হওয়া তো একটি ভালো দিক। তাহলে উদ্বেগের বিষয়টি কী হতে পারে?- অধ্যাপক রহমান বলেন, “দেশে মাথাপিছু আয় বাড়ছে, দারিদ্র কমছে। কিন্তু, কথাটা হচ্ছে যে এর সাথে সাথে আমরা দেখছি যে (বৈষম্যের) পার্থক্যটা বাড়ছে। অর্থাৎ, যে প্রবৃদ্ধিটা হচ্ছে তা যারা বেশি সম্পদের মানুষ তাদের হাতে বেশির ভাগটা যাচ্ছে। যারা কম সম্পদের মালিক তাদের হাতে তুলনামূলক কম ভাগটা যাচ্ছে। কিন্তু, সবাই পাচ্ছে। চরম দরিদ্রের সংখ্যা কমছে। তবে, ধনী-গরীবের আয়ের পার্থক্যটা বেড়ে যাওয়াটাই একটা দুশ্চিন্তার বিষয়।”

কেনো দুশ্চিন্তার বিষয় বলে আপনি মনে করেন?- এর উত্তরে তিনি বলেন, “বাংলাদেশে দারিদ্র ও চরম দারিদ্রের হার কমেছে। কিন্তু, ধনী-গরীবের আয়ের পার্থক্য বেড়েছে। এই পার্থক্যটাই হলো বৈষম্য। একজন বেশি ধনী আরেকজন তার তুলনায় অনেক গরীব- এমনটি হলে সমস্যা হয়।… এগুলো বাড়লে বিভিন্ন সামাজিক অসন্তুষ্টি পুঞ্জিভূত হতে থাকে এবং যে অগ্রগতি হয়েছে সেটাও অনেক সময় হুমকির মুখে পড়ে।… এর ফলে দেশে সামাজিক অসন্তোষ আরও বাড়তে পারে।”

এগুলো থেকে মুক্তির উপায় কী? এমন প্রশ্নের উত্তরে এই বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদের মন্তব্য, “যদি একটা অর্ন্তভূক্তিমূলক সমাজ নিয়ে আমাদের প্রবৃদ্ধি করতে হয় তাহলে আমাদের অবশ্যই দুর্নীতি কমানো, কর ফাঁকি, ঋণখেলাপি ইত্যাদি কমাতে হবে। কর ব্যবস্থাপনা, প্রত্যক্ষ করের অংশ বাড়ানো এবং সুশাসনের মাধ্যমে আমাদের এই প্রবণতাকে রোধ করতে হবে।”

Comments

The Daily Star  | English
World Bank’s senior official speaks on lending culture in Bangladesh

Banks mostly gave loans to their owners rather than creditworthy borrowers

Bangladesh’s banking sector was not well-managed in recent years. Banks mostly gave loans to their owners, rather than to creditworthy entities. Consequently, several banks are now in difficulty.

13h ago