যা করতে চেয়েছিলাম তার ১০ শতাংশ পেরেছি: এনামুল করিম নির্ঝর
এনামুল করিম নির্ঝর একজন খ্যাতিমান স্থপতি। তাকে এবার বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ বইমেলা আয়োজনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছিলো। খুব অল্প সময়ের মধ্যে রুচিশীল নান্দনিকতার সমন্বয়ে সাজানোর চেষ্টা করা হয়েছে এ বছরের অমর একুশে গ্রন্থমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশটিকে। বিষয়টি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনের কথা হয় স্বনামধন্য স্থপতি এনামুল করিম নির্ঝরের সঙ্গে।
বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে এবারের বইমেলা গোছানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো আপনাকে। এ কাজ করতে গিয়ে আপনার অভিজ্ঞতা কী হলো?
এনামুল করিম নির্ঝর: আসলে আমরা তো একটা অভ্যাসের মধ্যে থাকি এবং তা থেকে আমরা খুব একটা বের হতে চাই না। বাংলা একাডেমি যে কীভাবে এতো সীমিত অবস্থার মধ্যে থেকে এ মেলাটিকে সামাল দেয় তা দেখে আমার কাছে আশ্চর্যের ব্যাপার মনে হয়েছে। তাদের নিজস্ব তহবিল নেই তারপরও তাদের আন্তরিকতা ছিলো অনেক।
আপনি তো কাজটি স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে করেছেন। এ কাজটি করতে গিয়ে কোন বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন?
এনামুল করিম নির্ঝর: হ্যাঁ, আমিতো কাজ করেছি স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে একজন প্রভাবক হিসেবে। আমার বিবেচনায় ছিলো রুচিবোধের জায়গা তৈরি করা। নান্দনিকতা ছাড়াও স্বাচ্ছন্দ্যের বিষয়টি তুলে ধরা। স্থপতি হিসেবে আমরা সাধারণত এগুলো ভেবে থাকি।
কাজগুলোর মধ্যে কী কী ছিলো?
এনামুল করিম নির্ঝর: সবকিছু ভালো হোক- এমন ভাবনা নিয়ে আমার অফিস- সিস্টেম আর্কিটেক্টস এর লোকজন এবং কয়েকজন শিল্পীকে নিয়ে এই গোছানোর কাজে সহায়তা করেছি। যেমন, ডিজাইন লে-আউট করা, গ্রাফিক্স পরিবর্তন করা ইত্যাদি। কেনো সব সময় আলপনা এঁকেই মেলা সাজাতে হবে? সেই একঘেয়েমি থেকে বের করার চেষ্টা করেছি। এটি আসলে আমাদের জন্যে ছিলো একটি ভূমিকা বা পরিচয় পর্ব।
আর কী কী করেছেন?
এনামুল করিম নির্ঝর: এবারের মেলাতে চত্বরগুলো কীভাবে চিহ্নিত করা যায়, কেউ যেনো হারিয়ে না যান, নির্দেশিকা দিয়ে দেওয়া হয়েছে যে সামনে রাস্তাটি একটু নিচু আছে সাবধানে পা ফেলুন। আপনি কীভাবে খুঁজে পাবেন স্টল, কীভাবে যাবেন সেখানে ইত্যাদি করার চেষ্টা করেছি। ডাক্তার তো ব্যবস্থাপত্র দিবেই। কিন্তু, বাসায় গিয়ে রোগী ওষুধ খাবে কী খাবে না তা তো বলতে পারি না। আগ্রহবোধ তৈরি হলে আমার বিশ্বাস রুচিবোধও বদলে যাবে।
জানি না বাংলা একাডেমি আমাকে আর ডাকবে কী না। যদি ডাকে তাহলে এটিকে একটি সুন্দর জায়গায় নিয়ে যেতে পারবো।
যে কাজগুলো করেছেন সেগুলো কতটুকু করতে পেরেছিলেন?
এনামুল করিম নির্ঝর: অনেক কিছু যে করতে পেরেছি তা নয়। আসলে সবাইকে দেখছি পুরনো অভ্যাসেই থাকতে চান। ওখান থেকে নড়তে চান না। আমার কাছে মনে হয়েছে এই প্রক্রিয়াটি খুবই মজার। বাংলা একাডেমির কাছে আমরা খুবই কৃতজ্ঞ। তারা আমাদেরকে অনেক উৎসাহ দিয়েছে। তবে আমি মনে করি, যা করতে চেয়েছিলাম তার ১০ শতাংশ পেরেছি। অর্থাৎ ৯০ শতাংশই ফেল করেছি। আবারও বলছি- এটি আসলে শুরু মাত্র।
ফেল করার কারণগুলো কী হতে পারে?
এনামুল করিম নির্ঝর: ঐ যে আমাদের নিয়মিত অভ্যাস! যেমন ধরুন বইমেলার টয়লেট কেমন হবে?- সেটা নিয়ে কেউ যে ভাববে… সেই ভাবনার জায়গাটিই তাদের নেই। আমরা যখন ভাবনার জায়গাটি বলেছি, তখন ঘুরেফিরে তারা আমাদেরকে তাদের ভাবনার জায়গাতেই নিয়ে গেছে। যখন আমরা বলেছি আইনশৃঙ্খলার জায়গা থেকে নিরাপত্তা সবচেয়ে বড় ইস্যু। কিন্তু, তা নান্দনিকতার মধ্য দিয়ে করা যায়। আতঙ্ক তৈরি করে নয়। কিন্তু, তারা তো ওটা করে অভ্যস্ত না। তারা তো তা মেনে নেবেও না।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কী ভাবনা থেকে কাজ করেছেন?
এনামুল করিম নির্ঝর: সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ রয়েছে। একটি জলাশয়ও রয়েছে সেখানে। আমরা বইমেলার সঙ্গে এগুলোর সংযোগ তৈরি করার চেষ্টা করেছি। স্বাধীনতা স্তম্ভের যে এলাইনমেন্ট রয়েছে সেটাকে রেফারেন্স হিসেবে ধরে এর সঙ্গে সমান্তরালভাবে স্টল-প্যাভিলিয়ন সাজিয়েছি। এবার মেলায় দর্শনার্থীরা সেই জলাশয়ের পাশে বসতে পারবেন। এছাড়াও, বসার জায়গা তৈরি করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। অনেকাংশে পেরেছি, অনেকাংশে পারিনি।
স্থানীয় উপকরণ- বিশেষ করে বাঁশ ব্যবহার করার চেষ্টা করেছি। গেটগুলো নান্দনিকভাবে তৈরি করার চেষ্টা করেছি। লোগো করে দিয়েছি। এটি সবসময় গোল-প্যাঁচানো হাতের লেখায় হতো। আমরা এবার একটু অন্যরকমভাবে করার চেষ্টা করেছি। ১৯৫২ সালে ছাপার কাজে যে হরফ ব্যবহার করা হতো তা ব্যবহার করেছি।
আর কী কী করতে চেয়েছিলেন কিন্তু পারেননি?
এনামুল করিম নির্ঝর: অনেক কিছুই করার ইচ্ছা ছিলো কিন্তু, তা করতে পারিনি। যেমন- আমাদের ইচ্ছা ছিলো নারী, বয়স্ক ও শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্যে আলাদা জায়গা করে দিবো যাতে তারা স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করতে পারে কিন্তু, তা পারিনি।
কেনো পারেননি?
এনামুল করিম নির্ঝর: একটা কারণ হচ্ছে সময়। আমরা মাত্র ১০ দিনের মধ্যে এই কাজটি করেছি। এছাড়াও, অনুভব করার বিষয়টি জাতিগতভাবে আমাদের মধ্যে নেই। বইমেলাটিই আমাদের মানসিকতা পরিবর্তনের একটি জায়গা হতে পারে। আমরা পুরনো অভ্যাসের মধ্যেই বসে থাকছি। তবে আমরা সেসব নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ পেয়েছি। এখন সেসব বিষয়ে সবার এক ধরণের সম্পৃক্ততা সৃষ্টি হয়েছে।
না পারার আরও একটি কারণ হলো: তারা হয়তো ভেবেছেন- গত ২০ বছর ধরে এভাবে চলে এসেছে। হঠাৎ করে এসে সে বললেই হলো না কী? তার কথা শুনবো কেনো?
তাহলে কাজের সাফল্য কতোটুকু?
এনামুল করিম নির্ঝর: আমি মনে করি, প্রথম ধাপে পা দিয়েই যদি সফল হয়ে যেতে চাই তাহলে তা বোকামি হবে। আর মাত্র দুবছর পর আমাদের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি হবে। আমরা যদি তা অনুভব করতে পারি তাহলে অনেক জায়গাতেই আমাদের শোধরানোর সুযোগ রয়েছে।
যেমন- যারা জুনিয়র আর্টিস্ট ছিলেন বা আমার অফিসে যারা জুনিয়র আর্কিটেক্ট আছেন তাদের বইমেলা নিয়ে তেমন কোনো ধারণাই ছিলো না। অনেকে হয়তো বইও পড়েন না ঠিক মতো। এখন তো তাদের মধ্যে এ বিষয়ে একটা ভালোবাসা ঢুকেছে। গতকাল রাতে দেখছি কেউ কেউ বলছেন এটা বাঁকা হয়ে গেছে, সোজা করো। একবারে তো সব সোজা হবে না। কিন্তু, উৎসাহের জায়গাটা তৈরি হয়েছে বলতে পারেন।
ডিজাইন করার সময় আপনি অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন কীসের ওপর?
এনামুল করিম নির্ঝর: আমার প্রথম কাজ ছিলো মানুষের বিবেচনাবোধটিকে জাগিয়ে তোলা। আমি কাজ করেছি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণে কিছুই করতে পারিনি। করতে চাইওনি। তবে কিছু কিছু বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছিলাম তা তারা কাজে লাগিয়েছেন।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আমরা চেষ্টা করেছি- এটাকে কতটুকু স্বাস্থ্যকর করা যায়। পরিবেশ ও বিদ্যমান জিনিসগুলো ঠিক রেখে চত্বরগুলোকে সুচারুভাবে ভাগ করা বা ম্যাপিংটা ঠিক করা। কতোটুকু স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করা যায়। তবে ইট বিছানো চলার পথগুলো ঠিক করতে পারিনি। এ জায়গায় আমি ব্যর্থ হয়েছি। আমিতো ইট বিছাতে পারবো না। আমি তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে পারি। আমি জাদুকর নই যে একবারেই সব করে ফেলতে পারবো। আমি মনে করি, এটা শুরু হিসেবে চমৎকার। এটাকে যদি চালিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় আমি আশা করি যখন আমাদের স্বাধীনতা ৫০ বছর পূর্তি হবে তখন বইমেলা একেবারে অন্য চেহারায় চলে যাবে। অন্য চেহারা বলতে যেটা ২০২১ সালে হওয়া উচিত সেটাই হবে।
আপনার এই না পারার পেছনে বাধা কি বাংলা একাডেমি বা সরকার?
এনামুল করিম নির্ঝর: না, বাধা হচ্ছে আমাদের মানসিকতা। বাংলা একাডেমি এক পা এগিয়ে রয়েছে। তা না হলে তারা তো আমাকে ডাকতোই না। আমার উৎসাহকে তারা গুরুত্ব দিয়েছে। আমি মনে করি সরকারেরও হয়তো আগ্রহ রয়েছে। কিন্তু, সেই আগ্রহটাকে বাস্তবায়িত করতে হলে আমাদেরকেই এগিয়ে যেতে হবে। আমি সরকারকে সন্দেহ করলে সেও আমাকে সন্দেহ করবে। সেই জায়গা থেকে আমি মনে করি- আমাদেরও দায়িত্বের জায়গা রয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে যদি বলি তাহলে বলবো- বাধা হচ্ছে আমাদের মানসিকতা।
এই কাজে প্রকাশকদের কাছ থেকে কেমন সাড়া পেয়েছেন?
এনামুল করিম নির্ঝর: প্রথমদিকে সবাই একটু দুশ্চিন্তায় ছিলেন। কিন্তু, প্রকাশকরা যখন দেখলেন যেখানেই তার অবস্থান হচ্ছে সেখানেই একটা স্বাচ্ছন্দ্যের জায়গা পাচ্ছেন। তিনি সামনে দেখতে পাচ্ছেন। দুই পাশে খোলা জায়গা দেখতে পাচ্ছেন। প্রকাশকদের কাছ থেকে ভালো প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। এখন পর্যন্ত তাদের কাছ থেকে নেতিবাচক কিছু শুনিনি।
এ কাজের জন্যে কী একাডেমিকে কোনো বাড়তি খরচ করতে হয়েছে?
এনামুল করিম নির্ঝর: ওদের যে খরচ তার মধ্যে থেকেই আমরা পাল্টানোর চেষ্টা করেছি। আমাদের জন্যে ওদের কিছু করতে হয়নি। আমরা নিজের থেকেই এগিয়ে গিয়েছি। আমি চেষ্টা করেছি একটা ইন্টারেস্ট গ্রুপ বা একদল আগ্রহী মানুষ তৈরি করতে যারা বাংলা একাডেমিকে সহায়তা করবেন। তারাই ভাববেন যে বইমেলাটি কেমন হওয়া উচিত।
আপনি কীভাবে কাজটির সঙ্গে যুক্ত হলেন?
এনামুল করিম নির্ঝর: আমাকে হঠাৎ করে পরিচালনা কমিটির সদস্য করা হয়েছিলো। একজন স্থপতিকে তাদের কেনো দরকার তা আমি বুঝতে পারিনি। আমি ব্যক্তিগতভাবে জানি না কে আমাকে ডেকেছেন। তবে আমি এখনে আসার সময় এতোটা খ্যাপাটে ছিলাম না। একাডেমির নতুন পরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী আমাকে একদিন বললেন, ‘আপনার যা মনে হয় তাই করেন।’ তারপর একে একে অনেকেই সহযোগিতা করেছেন। অবহেলাও ছিলো অনেকের। এ কাজে আমাকে বিশেষভাবে সহযোগিতা করেছেন এমন ব্যক্তিদের মধ্যে আরও কয়েকজনের নাম বলা দরকার- যেমন, বাংলা একাডেমির জালাল ভাই। এছাড়াও, এ কাজে আমার সঙ্গে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে শিল্পী সব্যসাচী হাজরা, লিটন কর, কার্টুনিস্ট মেহেদী এবং মারুফ অন্যতম।
তবে যা কিছু করেছি মোটা দাগে হয়তো ভালো। কিন্তু, এ নিয়ে আমার অতৃপ্তি অনেক। বিশেষ করে, মানুষের চলার পথটি আমি সুন্দর মতো করতে পারিনি। এটা নিয়ে আমি দুর্ভাবনায় রয়েছি।
আপনি কি এই কাজটি নিয়ে আগেই ভেবে রেখেছিলেন?
এনামুল করিম নির্ঝর: না, আমি একেবারেই ভাবিনি। আমার একটা আবেগ রয়েছে। আমি একসময় লিখতাম। ঢাকা শহরে আমি লেখক হতে এসেছিলাম যদিও তা হতে পারিনি। তবে আমি যে বইমেলা দেখেছি আজ থেকে ৩০ বছর আগে তা আসলে কতোটুকু এগিয়েছে? আমার মনে হয় তা যেখানে ছিলো সেখানেই রয়েছে।
যেহেতু আমি স্থপতি; গ্রাফিক্স ডিজাইন করতাম, আঁকাআঁকি করি- এ সবকিছু মিলিয়ে একটা যোগাযোগ অনেকের সঙ্গে রয়েছে। সেই ভাবনা থেকেই এই কাজটা করেছি।
একটি কথা বিশেষভাবে বলতে চাই- আমাদের জাতীয় পর্যায়ে এ ধরণের যতো অনুষ্ঠান হয় সেগুলো একটা ধাঁচেই চলে সবসময়। কিন্তু, আমি মনে করি, এখন সময় এসেছে সেখানে রুচিবোধ, নান্দনিকতার বিষয়গুলো নিয়ে নতুন করে ভাবার জন্যে অনেক আগ্রহী মানুষ রয়েছেন তাদেরকে জড়ো করা জরুরি।
Comments