‘শুধু যে চুরির কারণেই ঘাটতি হয়েছে তা নয়...’
বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি থেকে ১ লাখ ৪৪ হাজার টনের বেশি কয়লা ‘গায়েব’ হয়ে যাওয়া নিয়ে প্রথম সংবাদটি প্রকাশ করেছিল দ্য ডেইলি স্টার। গত বছরের ২১ জুলাই প্রকাশিত Just vanished শিরোনামের সংবাদটি নিয়ে দেশজুড়ে হইচই পড়ে গিয়েছিলো। গঠন করা হয়েছিলো চারটি তদন্ত কমিটি। কিন্তু, কমিটিগুলো প্রতিবেদন দেওয়ার আগেই ‘গায়েব’ হওয়া কয়লাকে ‘সিস্টেম লস’ হিসেবে উল্লেখ করেছে বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি লিমিটেড (বিসিএমসিএল)।গত ৬ ডিসেম্বর সংস্থাটির ২০তম সাধারণ সভায় এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে আজ (১০ ফেব্রুয়ারি) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে দৈনিক প্রথম আলো। এ বিষয়ে দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনের কথা হয় তিনজন বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, “কর্তৃপক্ষ কয়লা চুরির ঘটনায় মামলা করেছে। মামলার প্রাথমিক প্রতিবেদনে চুরির বিষয়টি সনাক্ত করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকে দুটি পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কারোই তদন্ত প্রতিবেদন বের হয়নি। তারপরও সেই কোম্পানি (বিসিএমসিএল) কী করে বলে এটি সিস্টেম লস? এতে চরম বিভ্রান্তিকর অবস্থা তৈরি হয়েছে। প্রশাসনের এই অবস্থানকে সাংঘর্ষিক বলা যায় এবং এগুলো উদ্বেগজনক।”
“ক্যাবও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটির প্রতিবেদন এখনো চূড়ান্ত হয়নি। আমরা এটি আগামী মার্চ মাসে সরকারকে দিবো বলে আশা করছি” উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, “যে কথাটি আমরা সবসময়ই বলে আসছি তা হলো এটিকে সিস্টেম লস হিসেবে চালানোর সুযোগ নেই। যেসব তথ্য উপাত্ত আমাদের কাছে আসছে সেগুলোকে আমরা খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখছি, সবদিক বিচার-বিশ্লেষণ করছি।”
“কয়লার এই ঘাটতির পেছনে নানা ধরনের প্রভাব রয়েছে। শুধু যে চুরির কারণেই ঘাটতি হয়েছে তা নয়। আরও অনেক কারণে ঘাটতি হয়েছে- যেগুলোকে কারিগরি ঘাটতি হিসেবে চালানো যায় না। এসব ঘাটতিকে গ্রহণযোগ্য বলা যায় না। এগুলো এক ধরনে তসরুপ বা আত্মসাৎ। এখানে অনেক কিছু বিবেচনা করার বিষয় রয়েছে।”
“আমাদের তদন্ত চূড়ান্ত হয়নি বলে এখন এ বিষয়ে মন্তব্য করা ঠিক হবে না। তবে আমরা এখন পর্যন্ত শুধু এটুকুই নিশ্চিত করতে পেরেছি যে এটিকে ঢালাওভাবে সিস্টেম লস হিসেবে বলে দায় মুক্তি দেওয়া যায় না।”
তার মতে, “অনেকের দায়িত্বে অবহেলা রয়েছে। অনেকের অদক্ষতা রয়েছে। কয়লা সম্পদ সুরক্ষিত করার ক্ষেত্রে এই খাতে কর্মরত উপর থেকে নিচ পর্যন্ত সবারই ভূমিকা রয়েছে। সব ক্ষয়ক্ষতিকেই সিস্টেম লস হিসেবে চালানোর সুযোগ নেই। সিস্টেম লসের সমন্বয়ের বিষয়ে যেভাবে বলা হচ্ছে যেটিকে আমরা গ্রহণযোগ্য মনে করি না।”
তিনি মনে করেন, “সেই বিভাগকেই বলতে হবে এই কয়লা কোথায় গেলো। তাদেরকেই তা ব্যাখ্যা করতে হবে। যাদেরকে পাহারাদার রাখা হলো, প্রশাসনের এতো স্তরে এতো মানুষ অথচ বলা হলো যে ১ লাখ ৪৪ হাজার মেট্রিক টন কয়লা নেই। কেনো নেই? সিস্টেম লস বলে দিলেই তো তা মেনে নেওয়া যায় না। তাদের সবাইকেই এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। তারা সম্পদ সুরক্ষার দায়িত্বে রয়েছেন অথচ তারা তা করতে পারলেন না কেনো- সেটিই বড় কথা। সবাই এ ব্যাপারে দায়বদ্ধ।”
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ বলেন, “দুর্নীতি ধামাচাপা দেওয়ার জন্যে এই চেষ্টাটি আমরা বিভিন্ন পর্যায়ে দেখি। এ থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়- যারা এটিকে ধামাচাপা দিতে চান তারাই এই সিস্টেমের সঙ্গে সম্পর্কিত। তারা মনে করেন যে যদি তদন্ত হয় তাহলে আরও অনেক তথ্য বের হয়ে যেতে পারে। তাই তারাই এগুলো ধামাচাপা দিতে চান।”
বড়পুকুরিয়া এবং ফুলবাড়ি কয়লা খনিগুলো নিয়ে দেশি-বিদেশি নানা রকম তৎপরতা এখন চলছে উল্লেখ করে তিনি মন্তব্য করেন, “এখানে চীনা কোম্পানি জড়িত। বাংলাদেশি বেশকিছু ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এর সঙ্গে সম্পর্কিত রয়েছে। সরকারের ভেতরের নানা রকম লোকজন রয়েছে। তাদের একটি বড় পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বড়পুকুরিয়া ও ফুলবাড়ি কয়লা খনিগুলো নিয়ে নানা কিছু করছে।”
তদন্ত কমিটি কোনো প্রতিবেদন দেওয়ার আগেই এধরনের মন্তব্য করা হলো- এ প্রশ্নে উত্তরে তার বক্তব্য, “তদন্ত কমিটি একটি ন্যূনতম নিয়ম-কানুনের বিষয়। তদন্ত কমিটি হলে তারা তদন্ত করবে। তার মধ্যে যদি উচ্চ পর্যায়ের ক্ষমতাবান লোকজনদের কোনো সংশ্লিষ্টতা না থাকে তাহলে স্বাভাবিকভাবে তদন্ত কমিটির কাজ করার কথা, প্রতিবেদন দেওয়ার কথা। সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা। বিপুল পরিমান কয়লা গায়েব বা চুরি হয়েছে, আসল ঘটনা আড়াল করার জন্যে বিভিন্ন ধরনের চেষ্টা বা কথাবার্তার কথা আমরা প্রথম থেকেই শুনছি।”
“তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দিলেও তা প্রকাশ করা হয় না, ব্যবস্থা নেওয়া হয় না, অতীতে অনেকবার আমরা এমন দেখেছি। এবার কয়লা গায়েবের ক্ষেত্রে তা আরও বেশি নগ্নভাবে করা হলো। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন দেওয়ার আগেই তারা ধামাচাপা দিয়ে দিচ্ছেন আরেকটি যুক্তি দেখিয়ে। এতে প্রমাণিত হয় যে কয়লা লোপাট করার ঘটনাটি সত্য। আমাদের যে আশঙ্কা বা সন্দেহ ছিলো অনেক উচ্চপর্যায়ের লোকজন জড়িত রয়েছে- সেটাই হয়ত সত্য।”
বুয়েটের অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. এজাজ হোসেন বলেন, “কয়লা খোয়া যাওয়ার বিষয়ে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে যদি সিস্টেম লসের কথা বলা হতো তাহলে একরকম, আর যদি কোম্পানি নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়ে এ কথা বলে তাহলে আরেক রকম। এটি তদন্ত হওয়া দরকার ছিলো। তবে আমার মত- গত ১২ বছরে ওখান থেকে (বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি) কিছু কয়লা হয়তো চুরি কিংবা অনিয়মের কারণে সরেছে। কিন্তু, যারা বলছেন যে বিপুল পরিমাণের কয়লা চুরি হয়েছে- তা আমি বিশ্বাস করি না।”
তার মতে, “সুষ্ঠু ইনভেনটরি ম্যানেজমেন্ট বা বর্ণনামূলক তালিকা না রাখার কারণে এই গোলমালটি হয়েছে। তবে আমি এটি বলছি না যে ওখানে চুরি হয়নি। এটি বলতে হবে প্রমাণ সাপেক্ষে। এখন সংস্থাটি যদি প্রমাণ না দেখাতে পারে তাহলে তো তারা সিস্টেম লসই দেখাবে।”
“আমার মনে হয়, যেহেতু বর্ণনামূলক তালিকা রাখা হয়নি তাই সম্ভবত এই গোলমালটির সুযোগ কেউ নিয়েছেন।”
“আমার মতে সবচেয়ে বড় ইস্যু হচ্ছে- খুব ভালো করে তদন্ত করা উচিত। এখনকার মতো তদন্ত নয়। একটি ঐতিহাসিক তদন্ত করা উচিত। যদি চুরি হয়ে থাকে তাহলে কেউ না কেউ তা বলে দিবে। কোনো না কোনোভাবে তা বের হবে। সেসব সন্তোষজনকভাবে করে যদি তদন্ত কমিটি সিস্টেম লস বলে তাহলে তা মেনে নিতে আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু তা না জেনে এমন কিছু বলাটা ঠিক না।”
তিনি আরও বলেন, “কমিটিগুলোর প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করেই ‘সিস্টেম লসের’ কথাটি বলা উচিত ছিলো। এবং সেই প্রতিবেদনগুলো জনসম্মুখে আনা উচিত। এটি দেশের সম্পদ। এখানে কী হচ্ছে না হচ্ছে তা জনগণের জানা উচিত। পুরো প্রতিবেদন জনসম্মুখে আনা না হলেও এর সারমর্মটি জনগণকে জানানো উচিত।”
আরও পড়ুন:
Comments