বিপ্লবের ৪০ বছর পর কী ভাবছেন ইরানিরা?
প্রায় আড়াই হাজার বছরের রাজতন্ত্র সরিয়ে ইরানে ইসলামি বিপ্লব হয়েছিল ১৯৭৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি। আজ সেই বিপ্লবের ৪০ বছর পূর্তি উদযাপিত হচ্ছে দেশটিতে। কিন্তু, গত চার দশকে কতোটুকু এগিয়েছে রাজা দারিয়ুসের দেশটি?
ইরান সম্পর্কে আমরা যতোটুকু জানতে পারি তার অধিকাংশই আসে পশ্চিমের সংবাদমাধ্যমগুলো থেকে। দেশটিতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাওয়া বাংলাদেশিদের কাছে থেকেও জানা যায় ‘ব্যক্তিগত’ তথ্য। তবে সব মিলিয়ে যে কথাটি মোটা দাগে বলা যায় তা হলো- একটি কর্তৃত্ববাদী সরকার সবসময়ই চায় ভিন্ন মতাবলম্বীদের কণ্ঠরোধ করতে। ইরান সেই পরিস্থিতির বাইরে নয়।
ইসলামি বিপ্লবের চার দশক পূর্তির প্রাক্কালে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের সাংবাদিক ফারানাক আমিদি এক প্রতিবেদনে লিখেছেন, “আমার মাথার ওপরে হিজাব থাকলেও ভেতরে ঘুরপাক খায় (মার্কিন রক সংগীতদল) নিরভানার গান।”
ইউএসটুডে’র সংবাদদাতা কিম হজেলমগার্ডকে কয়েকজন ইরানি তরুণ বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটিকে সবাই ভুল বুঝে থাকে। তারা “উত্তর কোরিয়া” নয়। এক তরুণ সাংবাদিক কিমকে পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দেন, “আমাদের দেশে শাস্তিস্বরূপ ক্ষুধার্ত কুকুরের মুখে কোনো জীবন্ত মানুষকে ছুঁড়ে দেওয়া হয় না।”
সম্প্রতি আল-জাজিরাকে কয়েকজন ইরানি বলেছিলেন, তাদের “আমেরিকা নিপাত যাক” স্লোগানটি আসলে এখন কথার কথা। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ইরাননীতির প্রতি ক্ষোভ হিসেবেই সেই পুরনো স্লোগানটি ব্যবহার করা হয়।
এ কথা বলে রাখা দরকার যে যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থক ও যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত তৎকালীন শাহ সরকারকে উৎখাত করেই বিপ্লব এনেছিলেন ইরানের জনগণ।
দেশটির সরকারি প্রেস টিভি’র এক প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে বলা হয়- “২০১৭ সালে প্যারিসে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বলেছিলেন, ‘২০১৯ সালে ইরান সরকার ইসলামি বিপ্লবের ৪০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান উদযাপন করতে পারবে না। এর আগেই তাদের পতন হবে।’ কিন্তু, আজ আজাদি ময়দানে লাখো জনতার উপস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গিকে ভুল প্রমাণিত করছে।”
ইরানের আট কোটি জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশির জন্ম ইসলামি বিপ্লবের পর। তাদের অধিকাংশের বয়স এখন ৩৫ বছরের নিচে। বর্তমান ইরানকে নিয়ে কী ভাবছে সেই তরুণ সমাজ?- সে বিষয়ে বার্তা সংস্থা দ্য এসোসিয়েটেড প্রেস জানায়, “২২ বছর বয়সী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ফারজাদ ফারাহানির মতে, আমাদের কিছু দাবি রয়েছে। আমরা জানি সেই দাবিগুলো বাস্তবসম্মত। কিন্তু, সরকার আমাদের সেসব দাবি পুরোপুরি মানছে না।”
২৭ বছর বয়সী মানিয়া ফিলুম বার্তা সংস্থাটিকে জানান যে বিপ্লবের পরে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার বেশ উন্নতি হয়েছে। কিন্তু, সুযোগ পেলেই সে ও তার বন্ধুরা দেশ ছাড়তে এক পায়ে খাড়া হয়ে আছে।
কিমিয়া জাকেরি নামের ২০ বছর বয়সী একজন জানান, “আমার যুদ্ধাহত বাবা ইমাম খোমেনির খুব ভক্ত। কিন্তু, তার সঙ্গে যখন দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয় তিনি তখন হতাশা ব্যক্ত করেন। কেননা, অর্থনৈতিকভাবে দেশের অবস্থা খুবই খারাপ।”
তবে ইরানের এই অবস্থার জন্যে অনেকের মতো যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেন ২৭ বছর বয়সী শায়ান মোমেনি। তিনি মনে করেন, “এই দূরাবস্থার সঙ্গে বিপ্লবের কোনো সম্পর্ক নেই। ইরানের ওপর আমেরিকার অবরোধ আরোপের কারণেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।”
তার মতে, স্বাধীন ইরান আধিপত্যবাদী যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নতজানু হয়নি বলেই তাদেরকে প্রতিনিয়ত অবরোধের মুখে পড়তে হচ্ছে।
কিন্তু, মোমেনির মতের বিরোধিতাও করেন তার দেশের অনেকেই। তাদের মত- যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ইরান সরকারের সুসম্পর্ক রাখা যেতেই পারে।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো আজ (১১ ফেব্রুয়ারি) জানায়, প্রয়াত ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে ৪০ বছর আগে সংগঠিত বিপ্লবের বর্ষপূর্তি উদযাপনে রাস্তায় নেমেছে ইরানের জনগণ। রাজধানী তেহরানের আজাদি স্কয়ারে সমবেত জনতার উদ্দেশে বক্তব্য রাখবেন দেশটির রাষ্ট্রপতি হাসান রুহানি। তিনি তুলে ধরবেন ইরানি জাতির অতীত ইতিহাস, বর্তমান অবস্থা এবং ভবিষ্যৎ ভাবনা।
প্রতিবছরই ইরানে ইসলামি বিপ্লবের বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান শুরু হয় ফেব্রুয়ারির প্রথম দিনে। সেদিন খোমেনি স্বেচ্ছা নির্বাসন ছেড়ে ফ্রান্স থেকে দেশে ফিরেছিলেন। তার দেশে ফেরার ১৫ দিন আগে গণবিক্ষোভের মুখে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন তৎকালীন শাসক তথা পারস্য সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট মোহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভী। দেশত্যাগের আগে তিনি শাসনভার দিয়ে যান বিরোধীপক্ষ সমর্থিত প্রধানমন্ত্রী শাপুর বখতিয়ারের হাতে। জন-দাবির প্রেক্ষিতে বখতিয়ার সরকার খোমেনিকে আমন্ত্রণ জানায় দেশে ফেরার।
খোমেনির দেশে ফেরার ১০ দিন পর তার সশস্ত্র সমর্থকরা শাহ-সমর্থিত সেনাদের ওপর নিজেদের কর্তৃত্ব ঘোষণা করে। তৎকালীন সরকারকে উৎখাত করে তারা খোমেনিকে ইরানের নেতা হিসেবে মান্যতা দেয়। এর মাধ্যমে ১১ ফেব্রুয়ারি দেশটিতে সংগঠিত হয় ইসলামি বিপ্লব। তবে সেই বিপ্লবকে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেওয়া হয় সে বছরের ১ এপ্রিল অনুষ্ঠিত গণভোটের মাধ্যমে।
উল্লেখ্য, গত ৪০ বছরে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-খেলাধুলা, জ্ঞান-বিজ্ঞানে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলো থেকে অনেক এগিয়ে রয়েছে ইরান। রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটেও সেই অঞ্চলের অনেক দেশের তুলনায় সভ্যতার এই চারণভূমির ভাবমূর্তি অনেকটাই উজ্জ্বল। তবে বিরুদ্ধমতের প্রতি সরকারের নিপীড়নের মাত্রা প্রতিবেশী যেকোনো দেশের থেকে ইরানে কম নয়- তা দেখা যায় সে দেশের জেলখানার দিকে তাকালে।
গত ৭ ফেব্রুয়ারি রিপোর্টারস উইদাউট বর্ডার জানায়, গত ৩০ বছরে তেহরান ও এর আশপাশের এলাকা থেকে ১৭ লাখের বেশি সরকারবিরোধীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন অন্তত ৮৬০ জন সাংবাদিক।
Comments