‘১৪-১৫ ফেব্রুয়ারি প্রায় ৫০ জনকে হত্যা করা হয়েছিলো’

১৪ ফেব্রুয়ারি সারাদেশের তরুণ-তরুণীরা যখন বিশ্ব ভালোবাসা দিবস পালন করছেন তখন তাদের অনেকেই হয়তো জানেন না এ দেশের ইতিহাসে ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি কী ঘটেছিলো। যা ছিলো একই সঙ্গে বেদনাদায়ক ও গৌরবময় ঘটনা এবং আজকের দিনটি ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’।
Doctor Mustaq Hossain
জাসদ ছাত্রলীগের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক ও ডাকসুর সাবেক জিএস ডা. মুশতাক হোসেন। ছবি: ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে নেওয়া

১৪ ফেব্রুয়ারি সারাদেশের তরুণ-তরুণীরা যখন বিশ্ব ভালোবাসা দিবস পালন করছেন তখন তাদের অনেকেই হয়তো জানেন না এ দেশের ইতিহাসে ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি কী ঘটেছিলো। যা ছিলো একই সঙ্গে বেদনাদায়ক ও গৌরবময় ঘটনা এবং আজকের দিনটি ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’।

১৯৮৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে তৎকালীন স্বৈরশাসক লে. জে. হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের শিক্ষামন্ত্রী মজিদ খানের বিতর্কিত শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গড়ে উঠেছিলো আন্দোলন।

সামরিক আইনের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ১৪ ফেব্রুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি দেওয়ার জন্যে মিছিল নিয়ে আসে মন্ত্রণালয়ের কাছে। স্বৈরাচার এরশাদের পুলিশ নির্মমভাবে গুলি চালায় শিক্ষার্থীদের মিছিলে। নিহত হন অনেক ছাত্র।

সেই থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’। ছাত্রসমাজের আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় স্বৈরাচারের পতন হয়েছে। তারপরের ইতিহাস সবাই জানেন। পর্যায়ক্রমে আওয়ামী লীগ-বিএনপি স্বৈরাচারের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলেছে, ক্ষমতার অংশীদার করেছে। এখন আর বড় দুটি রাজনৈতিক দল সেভাবে দিবসটি পালন করে না। কেউ কেউ অজুহাত তৈরি করে নিয়েছে এই বলে যে- এটি তো ছাত্রদের আন্দোলন, তারাই পালন করবে। ১৯৫২ সালেও ছাত্ররাই প্রতিবাদ করেছিলেন, জীবন দিয়েছিলেন। তাই বলে ২১ ফেব্রুয়ারি শুধু ছাত্র সংগঠনগুলোই পালন করে না।

১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও এর আশপাশের এলাকায় শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশি হামলার খণ্ডচিত্র। ছবি: সংগৃহীত

দিনটির স্মরণে আজ (১৪ ফেব্রুয়ারি) দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেন সেদিন মিছিলে অংশ নেওয়া জাসদ ছাত্রলীগের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক ও ডাকসুর সাবেক জিএস ডা. মুশতাক হোসেন।

তিনি বলেন, “আমরা বলি- ১৪ এবং ১৫ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা এবং চট্টগ্রাম মিলিয়ে কমপক্ষে ৫০ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিলো। মরদেহ হাতে কমই পেয়েছি। আমরা মোট তিনজনের লাশ হাতে পেয়েছিলাম। ঢাকায় মোজাম্মেল আইয়ুব ও জয়নাল এবং চট্টগ্রামে মোজাম্মেল কাঞ্চনের লাশ পাওয়া গিয়েছিলো। দীপালি ও জাফরের লাশ পাওয়া যায়নি।”

“মোজাম্মেল আইয়ুবের লাশ নিয়ে আসার সময় মর্গে গুলিবিদ্ধ আরও অনেকের মরদেহ পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিলো। তাদের দেওয়া তথ্য থেকেই বলা হয় যে সেসময় পুলিশের গুলিতে কমপক্ষে ৫০জন মারা গিয়েছিলেন,” যোগ করে এই সাবেক ছাত্রনেতা।

তার মতে, ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় একটি এবং ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ও চট্টগ্রামে একটি করে- মোট তিনটি লাশ হাতে পাওয়া গিয়েছে।। “তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন যে পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছেন আরও অনেক মানুষ। যেমন- একজন মেয়ের লাশ পুলিশকে নিয়ে যেতে দেখা গিয়েছিলো। পরে আমরা জেনেছি দীপালি নামের এক মেয়ে নিখোঁজ রয়েছেন।”

দিনটির স্মৃতিচারণ করে তিনি আরও বলেন, “আমি তখন বৈজ্ঞানিক জাসদ ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলাম। ১৪ ফেব্রুয়ারি সকাল ১১টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে মিছিল শুরু হয়। আমি মিছিলে ছিলাম। এরপর মিছিলটি কার্জন হলের সামনের রাস্তায় এলে পুলিশ বাধা দেয়। তখন আমি কার্জন হল এবং শিশু একাডেমির সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে স্লোগান দিচ্ছিলাম। আমি মিছিলের অগ্রভাগ থেকে সামান্য পেছনে ছিলাম। এরপর পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছোড়া হয়। পুলিশ গুলি চালায়।”

“মৃত্যুর ঘটনা সরকার যদি রেকর্ড না করে তাহলে তা সঠিকভাবে জানা হয় না” উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমরা যদি জয়নালের লাশ ছিনিয়ে না নিতাম তাহলে তার মারা যাওয়ার কথা জানতে পারতাম না। এমনিভাবে আমরা অনেকের লাশ উদ্ধার করতে পারিনি।”

অন্য একটি ঘটনা স্মরণ করে তিনি বলেন, “যেমন ধরুন- ১৯৮৩ সালের নভেম্বরে সচিবালয় ঘেরাওয়ের সময় কাঁধে ব্যাগ নিয়ে একজন স্কুলের ছাত্র গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় পড়ে ছিলো। তার লাশ আমরা বুয়েটে এনে কবর দিয়েছিলাম। রাতে পুলিশ এসে সেই লাশ তুলে নিয়ে যায়। সেই শিক্ষার্থীর অভিভাবকের খবর আমরা পাইনি। তখনতো পত্রিকায় তার ছবিসহ খবর ছাপানোর সুযোগ ছিলো না। তাই আমাদের দলের বুলেটিনে সেই খবরটি প্রকাশ করা হয়। কিন্তু, সেই লাশের খোঁজ নিতে কেউ আসেনি।”

14-February-1983
১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও এর আশপাশের এলাকায় শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ হামলা চালায়। ছবি: সংগৃহীত

এভাবেই সেই মৃতরা পরিবারের কাছে নিখোঁজ হিসেবে বিবেচিত হয় বলে তার মন্তব্য। “শুধু স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের বেলায় নয়, বিভিন্ন সরকারের আমলেও আমরা দেখেছি লাশ সরিয়ে ফেলতে। মৃতের আত্মীয় প্রভাবশালী না হলে লাশ আর ফেরত পাওয়া যায় না।”

এখন বড় রাজনৈতিক দলগুলো বা সরকার দিবসটি পালন করছে না। সেদিনের সেই স্বৈরাচার পুনর্বাসিত হয়েছে- এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?- জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, “সব ছাত্র সংগঠনই দিবসটি পালন করছে। তবে কোনো রাজনৈতিক দল তা পালন করছে না। তারা বলে- এটি ছাত্রদের দিবস তারাই পালন করুক। আজকেও ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র মৈত্রী, জাসদ ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন রাজধানীর ‘শিক্ষা অধিকার চত্বরে’ এসে শ্রদ্ধা জানিয়েছে। প্রতিবারের মতো সংগঠনগুলোর সাবেক ও বর্তমান নেতারা শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন।”

“রাজনৈতিক দলগুলো দিবসটি পালন না করলেও এরশাদের সঙ্গে প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির যে রাজনৈতিক সখ্যতা দেখা যাচ্ছে আমরা সেটির কঠোর সমালোচনা করি। বিএনপি চার দলীয় জোটে এরশাদকে রেখেছিলো এবং আওয়ামী লীগের মহাজোটে এরশাদকে রেখেছে। এই দল দুটি তাদের রাজনৈতিক জোটে এরশাদ ও জাতীয় পার্টির বিভিন্ন অংশকে ব্যবহার করছে।”

“এ জন্যে আমরা খুবই ক্ষুব্ধ। আমরা মনে করি এটি শহিদদের জন্যে অপমানকর। সেদিনের সেই আন্দোলনের প্রতি উপহাস করে এসব করা হচ্ছে। তারা যদি শহিদ হয়ে আন্দোলনের পথকে বেগবান না করতেন তাহলে এই দলগুলো কখনই ক্ষমতায় আসতে পারতো না। আর এখন এমন কী ঘটনা ঘটলো যে স্বৈরাচারের ধারক-বাহকদের সঙ্গে জোট না বাঁধলে ক্ষমতা যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে?”

তার মতে, সেদিন সাধারণ শিক্ষার্থীরা নিহত হয়েছিলেন বলে হয়তো তাদেরকে নিয়ে কোনো দল উচ্চবাচ্য করে না। কিন্তু, ১৪ ফেব্রুয়ারিকেও রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা উচিত। এই দিনকে স্মরণ করাকে ঋণ শোধের অংশ বলে মনে করেন ডা. মুশতাক।

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

6h ago