শত-জোড়া চোখের ভারত দর্শন: প্রত্যাশা প্রাপ্তির সাতদিন!

মানুষ গল্প বলতে ভালোবাসে। ভালোবাসে আনন্দে দিনাতিপাত করতে। একজীবন কারো কারো এভাবেই কাটে পাখির ছন্দে। পাখিরা আকাশে ওড়ে, মানুষ মাটিতে থেকে আকাশ দেখে। তবে সে দেখা ও জানা কখনো একলা হয় কখনো সঙ্গবদ্ধ। আর সঙ্গবদ্ধ হলেই আসে ভাবনা: পড়শি কেমন হবে, ভালো না মন্দ। উড়নচণ্ডী না দায়িত্বশীল- এ নিয়ে নানান কৌতূহল। কিন্তু যুগে যুগে সময়কে যারা অসাধারণ করেছেন প্রসঙ্গত তারা কী বলেন। জেনে নেওয়া যাক- ইবনে বতুতা বলেন, মানুষ যখন ভ্রমণে যায়, বিস্ময়ে হতভম্ব হয়। তারপর সেই গল্প না বলে পারে না। তাই একজন সাধারণ মানুষকে ভ্রমণ প্রথমে নির্বাক করে দেবে তারপর গল্প বলতে বাধ্য করবে। ফরাসি গাল্পিক গুস্তাভ ফ্লুবেয়ার বলেন, “ভ্রমণ মানুষকে বিনয়ী করে তোলে। সে জানতে পারে দুনিয়ার তুলনায় সে কত ক্ষুদ্র।”
India tour
ইন্ডিয়া গেটের সামনে ‘বাংলাদেশ ইয়ুথ ডেলিগেশন টু ইন্ডিয়া ২০১৯’ এর সদস্যরা। ছবি: ইমরান মাহফুজ

মানুষ গল্প বলতে ভালোবাসে। ভালোবাসে আনন্দে দিনাতিপাত করতে। একজীবন কারো কারো এভাবেই কাটে পাখির ছন্দে। পাখিরা আকাশে ওড়ে, মানুষ মাটিতে থেকে আকাশ দেখে। তবে সে দেখা ও জানা কখনো একলা হয় কখনো সঙ্গবদ্ধ। আর সঙ্গবদ্ধ হলেই আসে ভাবনা: পড়শি কেমন হবে, ভালো না মন্দ। উড়নচণ্ডী না দায়িত্বশীল- এ নিয়ে নানান কৌতূহল। কিন্তু যুগে যুগে সময়কে যারা অসাধারণ করেছেন প্রসঙ্গত তারা কী বলেন। জেনে নেওয়া যাক- ইবনে বতুতা বলেন, মানুষ যখন ভ্রমণে যায়, বিস্ময়ে হতভম্ব হয়। তারপর সেই গল্প না বলে পারে না। তাই একজন সাধারণ মানুষকে ভ্রমণ প্রথমে নির্বাক করে দেবে তারপর গল্প বলতে বাধ্য করবে। ফরাসি গাল্পিক গুস্তাভ ফ্লুবেয়ার বলেন, “ভ্রমণ মানুষকে বিনয়ী করে তোলে। সে জানতে পারে দুনিয়ার তুলনায় সে কত ক্ষুদ্র।”

প্রথমে আমিও ভেবেছিলাম কেমন হবে যাত্রা। না, দুশ্চিন্তার কোনো কারণ পাইনি কারণ- শত যুবার প্রত্যেকেই ৬ মাস ধরে যাচাই-বাচাই করে নির্বাচিত। তবে কোথায় কে কী করবে, তা নিয়ে ভাবনা ছিলো। দেখতে না দেখতে সময় কেটে গেছে। ইন্টারভিউ থেকে শুরু করে বাংলাদেশে ভারতীয় হাইকমিশনের সংবর্ধনা প্রোগ্রামের পর আটদিনের ভারত সফরে একশ তরুণের সঙ্গে গভীরভাবে মেশার সুযোগ হয়েছে। কারণ এ সফরের অন্যতম উদ্দেশ্য দুদেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, ইতিহাস, ঐতিহ্য, বিজ্ঞান-প্রযুক্তিজ্ঞান বিনিময় করে নিজেদের আরও সমৃদ্ধ করা।

২০১২ সালে ‘বাংলাদেশ ইয়ুথ ডেলিগেশন টু ইন্ডিয়া’ শুরু হয়। এবার আমরা ছিলাম সপ্তম ব্যাচ। এই ব্যাচে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও পেশার ৪০ জন নারী ও ৬০ জন পুরুষ ছিলেন। তাদের মধ্যে যেমন ছিলেন শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী; তেমনি ছিলেন কবি, চিত্রশিল্পী, নৃত্যশিল্পী, সাংবাদিক, ক্রীড়াবিদ, মডেল, রেডিও জকি; ছিলেন মানবিক ও বিজ্ঞান ছাত্র, সমাজকর্মীও। প্রত্যেকেরই রয়েছে নিজস্ব পরিচয়। সবাই মিলে হয়ে ওঠে যেনো একটি ‘বাংলাদেশ’ নামক ‘পরিবার’।

তবে, প্রতিটি দিনই খুব সূচি মেনে চলতে হয়েছে। দিল্লি, আগ্রা, হায়দারাবাদসহ বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থানগুলোতে ঘুরতে গিয়ে কখনো সূচির এদিক-ওদিক হয়েছে। তবে যে সূচি ছিলো তার অধিকাংশ ঘুরে দেখা গেছে। আর সব সময়ই এই একশ তরুণের সঙ্গে অভিভাবক হয়ে ছিলেন বাংলাদেশে ভারতীয় দূতাবাসের প্রথম রাজনৈতিক সচিব নবনীতা চক্রবর্তী এবং সফরের সমন্বয়ক ভারতীয় হাইকমিশনের মিডিয়া ও কালচার সমন্বয়ক কল্যাণ কান্তি দাশ।

খ.

বলা যায় যাত্রা ভারতীয় হাইকমিশনের আয়োজনে ২৭ মার্চ এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষাউপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী প্রধান অতিথি এবং বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক ও সংসদ সদস্য মাশরাফি বিন মুর্তজা বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। ছিলেন ভারতীয় হাইকমিশনার রীভা গাঙ্গুলী দাশ।

স্বজনদের সবার শুভাশিস নিয়ে পরের দিন ২৮ মার্চ সন্ধ্যায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে দিল্লি, আগ্রা ও হায়দরাবাদে- আটদিনের সফর শুরু। ঐদিনই দিল্লি পৌঁছি আমরা। দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আমাদের স্বাগত জানায় ভারতের যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। ছিলাম দিল্লির নিউ ফ্রেন্ডস কলোনির সুরিয়া নিউ দিল্লি হোটেলে।

সকালে ভারতের পার্লামেন্ট ভবনের দিকে রওয়ানা হই। তবে প্রতিবছর বাংলাদেশের ইয়ুথ ডেলিগেশন টিম ভারতে এলেও এবারই প্রথম সুযোগ হয়েছে সংসদে যাওয়ার। অবিভক্ত ভারতবর্ষের সময়কার ব্রিটিশ স্থাপত্যশৈলীর ওপর আধুনিকায়নে যেনো আভিজাত্যের পরিচয় মিলে এই সংসদে। এককথায় পার্লামেন্ট ভবনের সৌন্দর্য বিস্মিত করে সবাইকে। সারিবদ্ধভাবে ঢুকতেই অতিথি হলে ব্রিফিং শেষে পার্লামেন্টের সামনে গিয়ে গ্রুপ ফটোবন্দি হন ডেলিগেটরা। এরপর তাদের দ্বিকক্ষ-বিশিষ্ট সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় নিয়ে যান রমেশ কুমার।

সংসদ পরিদর্শন শেষে ডেলিগেটরা আসেন অতিথি হলে। এখানে তাদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন ভারতের ইলেক্ট্রনিক্স অ্যান্ড ইনফরমেশনটেকনোলজি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী এসএস আহলুওয়ালিয়া। তার সঙ্গে ছিলেন সংসদ সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব কল্পনা শর্মা। এসএস আলুওয়ালিয়ার সাথে সাক্ষাতে সবচেয়ে ভালো লেগেছে- ভারতের সংসদে পাঞ্জাববাসী সাংসদ এসএস আহলুওয়ালিয়া আমার সাথে বাংলায় কথা বলায়। শত যুবার পরিচিতি পর্বে সবাই ইংরেজিতে পরিচয় দিচ্ছিলেন। একমাত্র আমি বাংলায় পরিচয় দিতেই তিনি আমার মুখ থেকে কথা নিয়ে নিজের বাংলা জানা নিয়ে সবিস্তর আলাপ জমান। একজন পাঞ্জাব অধিবাসীর মুখে স্বদেশীর মতো বাংলায় অন্যরকম পরিবেশ বিরাজ করেছিলো। এক বক্তব্যে মন্ত্রী জানান, কীভাবে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাশে থেকে বাংলাদেশকে সাহায্য করেছে ভারত। সার্বিকভাবে আমার মতো অনেকের মনটা জুড়িয়ে গেলো। লোকটি যেনো সবার ভালবাসার প্রতীক হয়ে দাঁড়ালেন। তার সঙ্গে কাটানো কিছু সময় যেনো অসামান্য হয়ে থাকলো। এরপর যাই ইন্দিরা গান্ধী ন্যাশনাল সেন্টার ফর আর্ট, এখানে ভারতের সংস্কৃতি ধরে রাখার অসামান্য উদ্যোগ লক্ষ্য করার মতো।

তারপর ন্যাশনাল ওয়ার মেমোরিয়াল ও ইন্ডিয়া গেট পরিদর্শন করি। আমরা দেখি ইতিহাস-ঐতিহ্য ছাপিয়ে পর্যটনের অন্যতম কেন্দ্র হয়ে ওঠা ইন্ডিয়া গেট। তার আশপাশ তখন স্থানীয় ও বিদেশি পর্যটকদের পদচারণয় মুখরিত। তবে ডেলিগেশন টিমকে মেমোরিয়ালে ঢোকার আগে সংক্ষিপ্ত ব্রিফ দেন এই সৌধ কমপ্লেক্সের গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ আর এন শর্মা। তার ভাষ্যে, এই মেমোরিয়ালকে সেই সব শহিদ সেনাদের উদ্দেশে উৎসর্গ করা হয়েছে যারা ১৯৬২ সালে ইন্দো-চিন যুদ্ধ, ১৯৪৭, ১৯৬৫ এবং ১৯৭১ সালে ইন্দো-পাক যুদ্ধ, ১৯৯৯ সালের কার্গিল যুদ্ধ এবং শ্রীলঙ্কায় ভারতের শান্তি বাহিনীর অভিযানে শহিদদের স্মরণে।

ব্রিটিশ আমলে ১৯২১ সাল থেকে প্রায় ১০ বছর ধরে নির্মিত হয় যুদ্ধস্মৃতির মিনার ইন্ডিয়া গেট। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রাণ হারানো প্রায় ৯০ হাজার সৈন্যের স্মরণে গড়ে তোলা সৌধ ৪২ মিটার উঁচু। লাল ভরতপুর পাথরের ওপর এ স্থাপনায় গ্রানাইট ও বেলেপাথরও ব্যবহার করা হয়েছে। উপরে ওঠার সিঁড়ি থাকলেও সেটি এখন বন্ধ। গেটের চূড়ায় বড় করে লেখা ইন্ডিয়া ও ভারত। খিলানের গায়ে খোদাই করা রয়েছে ১৩ হাজারের বেশি ব্রিটিশ ও ভারতীয় সৈন্যের নাম।

ইতিহাসের ছবি মনে ও ফোনে নিয়ে হোটেলে ফিরি। তারপর পুরো সন্ধ্যা মাতিয়ে রাখেন ভারতীয় যুব মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে লালনসংগীত শিল্পী কহিনুর আক্তার গোলাপি ও রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী নুর-ই রাজিয়া মম। মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ জানান বাংলাদেশে ভারতীয় দূতাবাসের প্রথম রাজনৈতিক সচিব নবনীতা চক্রবর্তী।

India tour
ভারতে সফররত ‘বাংলাদেশ ইয়ুথ ডেলিগেশন টু ইন্ডিয়া ২০১৯’ এর সদস্যরা। ছবি: ইমরান মাহফুজ

মানুষ চমকিত হতে ভালোবাসে। আর সেটা যদি হয় কোন উৎসবে- তাহলে তো কথায় নেই। তেমনি বাংলাদেশ ইয়ুথ ডেলিগেশন টিম ভারতে রওয়ানা দেওয়ার সময় কোন এলাকায় যাওয়া হতে পারে সে সম্পর্কে খানিক ধারণা পেলেও ঠিক কোন স্থাপনা বা কোন কেন্দ্রে যাওয়া হবে তা ‘সারপ্রাইজ’ হিসেবে রাখা থাকতো। প্রতিদিন ঘুরে এসে বিশ্রাম আর নৈশভোজের পর রাতে জানাতো পরের দিনের যাপন পরিকল্পনা। সেই কল্পনায় পরের দিন সকালে আগ্রার উদ্দেশ্যে যাত্রা। সেখানে আমরা তাজমহল ও মুঘল সম্রাটদের প্রধান বাসভবন বা প্রাসাদ আগ্রা ফোর্ট পরিদর্শন করি। আর আগ্রা ফিরে কবি ও সাংবাদিক হুসাইন আজাদ লিখেন, প্রিয়তমার প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে তাজমহল বানালেও একটিবারের জন্যও সম্রাট শাজহাজান এটিকে ছুঁয়ে দেখতে পারেননি, এমনকি মহলের প্রাঙ্গণে পা পর্যন্ত রাখতে পারেননি। এটি নির্মাণের একেবারে শেষ পর্যায়ে শাহজাহানকে বন্দি করে ফেলেন তার ‘ক্ষমতালিপ্সু’ পুত্র আওরঙ্গজেব। শাহজাহানকে রাখা হয় তাজমহলের আড়াই কিলোমিটার দূরে আগ্রা দুর্গে। গাইডের মুখে ইতিহাসের এই শ্রুতি শোনার পর কারও কারও মুখে যেনো বিষাদের ছায়া পড়ে যায়। এর বাইরেও জনশ্রুতি আছে, মুঘল রাজবংশের প্রতীক এ দুর্গ থেকে তাজমহলও দেখা যায়। এ দুর্গেই আওরঙ্গজেব তার বাবা শাহজাহানকে মার্বেলের ঘরে বন্দি করে রেখেছিলেন। এ ঘর থেকেই তাজমহল দেখে মুগ্ধ হতেন শাহজাহান। শেষে মৌসাম্মান বুর্জ নামে ঘরটিতেই মৃত্যুবরণ করেন শাহজাহান। তাজমহল ও আগ্রা ফোর্ট ঘুরে আবার হোটেলে ফেরা হয়। চোখের পলকে যেনো দিনটি শেষ হয় এবং বিরহের সুর নিয়ে অনেকে হোটেলে ফেরেন।

পরেরদিন হিন্দুধর্মাম্বলীদের ঐতিহ্যবাহী অক্ষরধাম মন্দিরে যাই। এটি ভারতবর্ষের অন্যতম বড় মন্দির! গাইড জানান, এতে ভারতীয় শিল্প, মূল্যবোধ ও মানবসেবার একটি নিদর্শন স্বামী নারায়ণ অক্ষরধাম। সাত হাজার শ্রমিকের পাঁচ বছর পরিশ্রমের ফলে নয়নাভিরাম রূপ লাভ করেছে ১০০ একর বিস্তৃত উপাসনালয়টি। ভেতরে ঢুকে চোখে পড়বে দশদ্বার, যা দশটি প্রবেশদ্বারের স্মারক হয়ে জানাচ্ছে মঙ্গলবারতা। আমরা দেখলাম মন্দিরটি গোলাপি পাথর ও শ্বেতমর্মরে নির্মিত। এটি ১৪১ ফুট উঁচু, ৩১৬ ফুট প্রস্ত এবং ৩৫৬ ফুট দীর্ঘ এই মন্দিরে সূক্ষ্ম কারুকার্য খচিত ২৩৪টি স্তম্ভ, নয়টি জমকালো গম্বুজ, ২০টি চূড়া এবং ২০ হাজার এর বেশি ভাস্কর্য রয়েছে। এই স্থাপত্যে কোনো ইস্পাত ব্যবহার করা হয়নি বলে জানা গেলো। এটি কেবল ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতির স্মারকই নয়, একুশ শতকের বিস্ময়ও বটে। তবে মন্দিরে ঢুকতে হলে কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী পার হতে হয়, মোবাইল ফোন জমা দিয়ে ভেতরে ঢুকতে হবে, ভেতরে ছবি তোলা নিষেধ। তাই আপাতত মনের স্মৃতি নিয়ে পরে তেলেঙ্গানা রাজ্যের রাজধানী হায়দরাবাদের উদ্দেশ্যে যাত্রা করি।

পরেরদিন সকালে বিদ্যানগর ক্যাম্পাসে অবস্থিত ন্যাশনাল স্কিল ট্রেনিং ইন্সটিটিউট পরিদর্শন করি। ডকুফিল্মে দেখলাম কীভাবে দক্ষ ভারতীয় নাগরিক তৈরি হচ্ছে। শিক্ষক ও গাইড প্রায় ঘণ্টা ঘুরে ঘুরে দেখালেন সচিত্রবয়ান। এক সুযোগে ইনন্সিটিউিটের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের সাথে পরিচিত হলাম। জানলাম এই জনপদের মানুষ তেলেগু ভাষায় কথা বলেন। বাংলাদেশ সম্পর্কে জানাশোনা খুব কম তাদের। ক্লাস টিচারের সাথে পরিচয় হওয়ার পর শিক্ষার্থীদের সাথে ১০ মিনিট কথা বলার সুযোগ পাওয়া যায়। এর মাঝে চেষ্টা করেছি বাংলাদেশ নিয়ে কিছুটা ধারণা দেওয়ার। এরপর তারা আরও আগ্রহী হয়ে উঠেন। তারা খুব আনন্দ পান যে, এই দেশের ঐতিহ্য এতো শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ। আমি চেয়েছি জানতে দেশকাল ইতিহাস, জানাতে চেয়েছি শ্যামল বাংলার গল্প!

পরের দিন আমরা যাই রামোজি ফিল্ম সিটিতে। এর অবস্থান হায়দরাবাদ শহরের প্রায় দুই হাজার একর এলাকাজুড়ে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্টুডিও কমপ্লেক্সের জন্য এটি গিনেস বুকে স্থান করে নিয়েছে। এর আয়তন ১,৬৬৬ একর বা ছয় বর্গকিলোমিটারের বেশি। গাইড জানান- প্রায় ২,০০০ হিন্দি, বাংলা, তামিল, তেলেগু, মালয়ালম, কন্নড় ভাষার চলচ্চিত্র ও বহু বিদেশি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। এখানে বাহুবলি ১ ও ২, মুন্না ভাই এমবিবিএস, রা.ওয়ানসহ অসংখ্য ব্যবসা সফল ছবি নির্মিত হয়েছে।

১৯৯৬ সালে নির্মিত এই সিটি যেনো বাস্তব আর কল্পনা এবং প্রকৃতি ও কৃত্রিমতার মিশেলে গড়ে তোলা এক স্বপ্নপুরী। ছিমছাম পরিচ্ছন্ন রাস্তা, সবুজ ঘাসের গালিচা আর হরেক রকমের ফুলের বাগানে এই সিটি যেনো দক্ষ শিল্পীর নিপুণ হাতে আঁকা এক নয়নাভিরাম চিত্রপট। গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস কর্তৃপক্ষের স্বীকৃতি অনুযায়ী, এই ফিল্ম সিটির স্টুডিওই বিশ্বের সর্ববৃহৎ ফিল্ম স্টুডিও কমপ্লেক্স। সারাদিন কেটে যায় অনিন্দ্য সুন্দরে!

পরের দিন যাই হায়দরাবাদের খ্যাতনামা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জহওরলাল নেহরু প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ক্যাম্পাসের ফটক দিয়ে ঢুকতেই গাঁদা, গোলাপের পাপড়িসহ হরেক ফুলে গালিচায় সাজানো এক স্বাগত-সম্ভাষণ, ‘ওয়েলকাম বাংলাদেশ ডেলিগেটস’।

এমন উষ্ণ অভ্যর্থনাই দিলো বাংলাদেশ ও ভারতের যুবশ্রেণির মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের সুযোগ তৈরির লক্ষ্যে ন্যাশনাল সার্ভিস স্কিমের (এনএসএস) আওতায় আয়োজিত ‘ইন্টারন্যাশনাল ইয়ুথ এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম’ শিরোনামে।

পরে দুই দেশের জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয়। প্রাথমিক আলোচনা শেষে একের পর এক তেলেগু ও হিন্দি ভাষার গানে মিলনায়তনভর্তি দর্শক-শ্রোতা মেতে ওঠে নৃত্যোল্লাসে। তখন স্বাগতিক-অতিথি যেনো মিলে যান এক সুতোয়। কেউ একজন তখন বলছিলেন, একটি গোষ্ঠীকে আরেকটি গোষ্ঠীর নৈকট্যে আনার ক্ষেত্রে সংগীতের মতো কার্যকর কিছু হতে পারে না। অনুষ্ঠান শেষে যখন ডেলিগেটরা স্বাগতিকদের ধন্যবাদ জানিয়ে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানিয়ে বিদায় নিচ্ছিলেন, তখন যেনো এই কথার ছাপ স্পষ্ট হচ্ছিলো কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আপন হয়ে যাওয়া তেলেঙ্গানার শিশু-কিশোর-কিশোরী আর তরুণ-তরুণীদের মুখে। মঞ্চে পরিবেশিত হয় ১১টি প্রধান ইন্ডিয়ান ক্লাসিক্যাল নাচের অন্যতম কুচিপুরি নৃত্য। এরপর গিটার হাতে সুর তোলেন হায়দরাবাদে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি দীপেন চক্রবর্তী। তিনি বাংলায় তিনটি গানের পাশাপাশি হিন্দি এবং তেলেঙ্গানার প্রধান ভাষা তেলেগুতেও একটি গান পরিবেশন করেন। এরপর ফটকে যে শিশুর দল স্বাগত জানিয়েছিলো ডেলিগেশন টিমকে, তাদের ১৪ জন পরিবেশন করে নৃত্য। এই শিশুদের নৃত্য পরিবেশনের সময় হর্ষধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে প্রাঙ্গণ।

পরেরদিন সকালে হায়দরাবাদ সফরের শেষদিনে সবাই যাই পুলেলা গোপিচাঁদ নিমাগাদা ফাউন্ডেশন ব্যাডমিন্টন একাডেমিতে। সেখান থেকে সালার জং মিউজিয়াম ও গোলকন্দা ফোর্টে। এই দূর্গের রয়েছে অসামান্য ইতিহাস। এটি এই শহরের পশ্চিমাঞ্চলের একটি পাহাড়ের ওপর অবস্থিত এমন এক কেল্লা, যেখানে থেকে মধ্যযুগে যাদব, কাকাতিয়া ও কুতুবশাহী সাম্রাজ্য পরিচালিত হতো। তা দেখতে দেখতে লালিমা সন্ধ্যায় শুরু হয় ‘সন এত লুমিয়েরে’ বা ‘সাউন্ড অ্যান্ড লাইট শো’, এটি ভারত সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের ১৯৯২ সালে নির্মিত। অমিতাভ বচ্চনের ভারী গলায় একের পর এক আসতে থাকে বর্ণনা। ফাঁকে পরিপূরক হিসেবে শোনা যায় কবিতা কৃষ্ণমূর্তিসহ আরও কিছু শিল্পীর গলা। হায়দরাবাদে কুচিপুরি নৃত্য, রামদাশের কারাবন্দিত্ব ও পরে মুক্তির বিষয় তুলে ধরার পাশাপাশি আবদুর রাজ্জাক লারির বিশ্বাস ও আবদুল্লাহ খান পান্নির বিশ্বাসঘাতকতার কথাও তুলে ধরা হয় ধারা-বর্ণনায়। অর্থাৎ আমাদের পরিচয় ঘটে ১৬শ শতকের কুতুবশাহি বংশের এক কন্যা অসম্ভব বিচক্ষণ ও ব্যক্তিত্বময়ী নারী হায়াত বক্সি বেগমের সঙ্গে। এরপর গোলকোন্ডা ফোর্ট স্থাপন, উত্থান-পতনের ফলে কী কী ভৌগোলিক ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটে, কীভাবেই বা বদলে যায় সমস্ত কিছু- পুরোটাই এক ভ্রমণগাথার মাধ্যমে তুলে ধরা হয়। কিন্তু, ২০১৯-তে বসেও যখন আলোচনা পুরোটাই হয় বৈঠকি ছন্দে!

প্রত্যেকবারে ভাষ্য দেওয়ার সময় কেল্লার আলাদা আলাদা অংশে লাল-নীল-সবুজ প্রভৃতি বাতি জ্বালিয়ে নির্দেশকরা যেনো দর্শনার্থীদের সেই কুতুবশাহি যুগে নিয়ে যাচ্ছিলেন বারবার। প্রায় এক ঘণ্টার সাউন্ড অ্যান্ড লাইট শো’র শেষাংশেও জগজিৎ সিংয়ের গান বাজানো হয়। তবে প্রথমে যে সুরটা মনোযোগ নিয়েছিলো শো’তে, শেষে গানের সুর যেনো বিষাদ লেপ্টে দেয় ভাবনার ক্যানভাসে।

অন্যদিকে হায়দরাবাদ সফরকালীন বিখ্যাত হায়দরাবাদি বিরিয়ানি ছিলো প্রতিনিধিদের রসনা বিলাসের অন্যতম আকর্ষণ। এরপর ৪ এপ্রিল কলকাতা হয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসেন ডেলিগেশনের একশো সদস্য। মনে হয় রবি ঠাকুরের ছোটগল্পের মতো শেষ হইয়াও না হইলো শেষ! তবে আশা করেছিলাম আমাদের মতো নির্বাচিত ভারতীয় একদল তরুণদের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ হবে। কিন্তু সেটি হয়নি। আগামীতে এধরনের তারুণ্য নির্ভর সময় মুখোমুখি প্রাপ্তির খাতায় যোগ হবে নতুন দিগন্ত। সব মিলিয়ে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়েই মানুষের জীবন।

তবু ধন্যবাদ জানাই বাংলাদেশে ভারতীয় হাইকমিশনকে। তাদের মাধ্যমে প্রতি বছর দেশের একশ তরুণ বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে ভারত সফরের সুযোগ পেয়ে থাকেন। শেখার, জ্ঞান আহরণের, স্বাবলম্বী হওয়ার, নতুন বন্ধু তৈরি করার, আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠার সুযোগ থাকে। সেই সঙ্গে ভবিষ্যৎ পথ চলার শিক্ষাও হয়। এবার সেই একশ জনের মধ্যে আমি একজন ছিলাম। মিস করি শতজনের শত রকমের গল্প।

ইমরান মাহফুজ: কবি ও গবেষক এবং ‘বাংলাদেশ ইয়ুথ ডেলিগেশন টু ইন্ডিয়া ২০১৯ এর অন্যতম সদস্য

Comments

The Daily Star  | English

How Islami Bank was taken over ‘at gunpoint’

Islami Bank, the largest private bank by deposits in 2017, was a lucrative target for Sheikh Hasina’s cronies when an influential business group with her blessing occupied it by force – a “perfect robbery” in Bangladesh’s banking history.

8h ago