প্রসঙ্গ ‘আসামি তালিকায় কেনো ওসি নেই’

ফেনীর মাদরাসা শিক্ষার্থী নুসরাতের মৃত্যুর পেছনে পুলিশের বিশেষ করে সোনগাজী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেনের ভূমিকা নিয়ে নিহতের পরিবার থেকে অভিযোগ উঠলেও হত্যা মামলার অভিযোগপত্রে কোনো পুলিশ কর্মকর্তার নামে নেই। এ বিষয়ে দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনের পক্ষ থেকে মন্তব্য জানতে চাওয়া হয় পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. এনামুল হক, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক এবং সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়ার কাছে।
Shahdeen Malik
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. এনামুল হক (বামে), সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক (মাঝে) এবং সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। ছবি: সংগৃহীত

ফেনীর মাদরাসা শিক্ষার্থী নুসরাতের মৃত্যুর পেছনে পুলিশের বিশেষ করে সোনাগাজী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেনের ভূমিকা নিয়ে নিহতের পরিবার থেকে অভিযোগ উঠলেও হত্যা মামলার অভিযোগপত্রে কোনো পুলিশ কর্মকর্তার নামে নেই। এ বিষয়ে দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনের পক্ষ থেকে মন্তব্য জানতে চাওয়া হয় পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. এনামুল হক, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক এবং সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়ার কাছে।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. এনামুল হক বলেন- যেভাবেই হোক না কেনো ওসি কিছুটা দায়ী রয়েছে। কেউ তাকে নির্দোষ বলতে পারবে না। কারণ ঘটনার শুরু থেকে তার আচার-আচরণ, কথাবার্তা, এবং যে পন্থায় সে বিষয়টি হ্যান্ডেল করেছে তা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। এটি কাম্যও নয়।

আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, যে যেটাই করুক না কেনো তার পেছনে কিছু অ্যাভেটার থাকে। অর্থাৎ, ভালো কাজের কিছু সহযোগী থাকে, খারাপ কাজেরও কিছু সহযোগী থাকে। নিশ্চয় ওসির সঙ্গে তার ওপরে যারা ছিলেন তারাও তো কিছুটা দায়ী হবেন। কেনো দায়ী হবেন, কারণ, ওসি এতো বড় একটি সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন- সেটি শুধু পুলিশের নয়।কিন্তু, ওখানে যারা রয়েছেন- যেমন, মাদরাসা কমিটির সদস্য যারা সরকারি কর্মকর্তা বা জনপ্রতিনিধি- তারাও তো পরোক্ষভাবে কিছু না কিছু দায়ী। কেননা, তারা ওসিকে ফেরাতে পারেননি।

ড. শাহদীন মালিক-এর মন্তব্য- ওসির বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো যে তিনি দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছেন। কিন্তু, এগুলো ক্রিমিনাল অফেন্স নয়। একজন সরকারী কর্মচারীর দায়িত্বহীন হওয়া বা দায়িত্বশীল না হওয়া- এটি কি ক্রিমিনাল অফেন্স হতে পারে? এর জন্যে কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিতে পারে। এমনকী, চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে পারে।

কিন্তু, এর সঙ্গে যদি কারো জীবন-মরণ জড়িয়ে থাকে?- এর উত্তরে তিনি বলেন: আইনে বলা রয়েছে একজন ব্যক্তির জীবন-মরণের জন্যে একটি লোক কখন দায়ী হবে। এই ঘটনা সেই আইনের ব্যাখ্যার আওতায় পড়বে না।

নুসরাতের পরিবার বলছে যে তারা পুলিশের কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পায়নি। উল্টো তাদেরকে অপমানিত করা হয়েছে। এই অভিযোগের ভিত্তিতে কী পুলিশের কাউকে চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করা যেতো?- আমার বক্তব্য শুনে মনে হতে পারে আমি পুলিশের পক্ষে কথা বলছি। কিন্তু, একটু ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করেন- একটি থানায় যদি ৩০০ লোক যায় অপরাধের অভিযোগ নিয়ে এর মধ্যে পুলিশ হয়তো ৩০টি অভিযোগ নেয়, বাকি ২৭০টি অভিযোগ নেয় না। যে অভিযোগ নিচ্ছে না তার মধ্যে হয়তো পাঁচটি অভিযোগ পাওয়া যাবে সেগুলো নেওয়া উচিত ছিলো। এর জন্যে কেউ যদি পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করা শুরু করলে তাহলে নব পুলিশ রিটায়ার করে বাড়ি চলে যাবে।

আর অপমান কোনো ক্রিমিনাল অফেন্স না। আমি সামাজিকভাবে অপমানিত হতে পারি। কিন্তু, এর জন্যে মামলা করা যাবে না। এটি ক্রিমিনাল অফেন্স না।

ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়ার মতে, এসপি, ওসিকে অপরাধী প্রমাণিত করতে যেসব তথ্য-উপাত্ত থাকা দরকার সেগুলো আমাদের তদন্তে কীভাবে উঠে এসেছে তা দেখার বিষয়। নুসরাত হত্যার আগে পুলিশের কাছে অভিযোগ নিয়ে যাওয়া হয়েছে কিন্তু, পুলিশ তা আমলে নেয়নি। এমনকী, জেলা প্রশাসক যিনি মাদরাসা পরিচালনা পরিষদের সদস্যও, তিনি বলেছেন তার কাছে এমন অভিযোগ অনেক এসেছে, কিছু ঘটনার সত্যতাও তিনি পেয়েছেন। কিন্তু, তার উপায় ছিলো না সবগুলোর ব্যবস্থা নেওয়ার। তার মানে, তাদের বক্তব্যের মাধ্যমে বোঝা গেলো যে- এরকম একটি ঘটনা ঘটছে বা অধ্যক্ষের আচরণগত সমস্যার কথা তারা জানতেন।

যদিও আইনজীবীদের একদল হয়তো বলবেন যে যারা মূল অপরাধী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। তবে আমাদের ফৌজদারি আইনে অপরাধীর সহযোগী হিসেবে তাকে (ওসি) ফ্রেম আপ করা সম্ভব। তবে যদি এটি প্রমাণ করা না যায় যে তাদের নীরবতার কারণেই এই ঘটনাটি ঘটেছে তাহলে তাদের অপরাধের সহযোগী হিসেবে বিচারের মুখোমুখি করাটা বেশ কঠিন হবে।

কৌশলগত কারণে দেখা যায় যে  ঘটনার সময় যারা জড়িত ছিলেন তাদেরকে বিচার প্রক্রিয়ায় আনার একটি প্রবণতা আমাদের মধ্যে রয়েছে। দূরবর্তী কোনো ফ্যাক্টর যদি কাজ করে সেগুলোকে বিবেচনায় নেওয়ার সংস্কৃতি আমাদের এখানে গড়ে উঠেনি।

কিন্তু, যে কথাটি আমরা বলছিলাম যে তিনি (ওসি) অভিযোগ করতে যাওয়া নুসরাতের ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া ও বিভিন্ন কাজে তার বিকৃত মানসিকতার প্রমাণ পাওয়া যায়। তাই তাকে দোষী করার একটি সুযোগ ছিলো। নুসরাতের মৃত্যুর আগের বিভিন্ন ঘটনাগুলোকে বিবেচনায় নিলে হয়তো ওসিকে এখানে দায়ী করা যেতো।

আমরা যে বিষয়ে পার্থক্য করতে ভুল করি যে একজন ব্যক্তি পেশাগত পোশাক পড়ে থাকলেই তার সব কাজ পেশাগত হবে না। তিনি কখনো কখনো তার সীমা লঙ্ঘন করেন, সেটি যদি ক্রিমিনাল অ্যাক্টের মধ্যে পড়ে তাহলে তাকে সেই আইন মোতাবেক বিচারের মুখোমুখি করা উচিত।

আমার যুক্তি হলো: একজন ব্যক্তি পুলিশের পোশাক পড়ে থাকলে তার সব কাজ আইনি হবে না। তাহলে তো ‘বন্দুকযুদ্ধ’, ‘গুম’ সবই তো বৈধ হয়ে যায়। এ ধরনের ভুল ধারণা আমাদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাচ্ছে। এই ভুলগুলো ভাঙ্গা প্রয়োজন।

শুধু পুলিশ নন, প্রজাতন্ত্রের যেকোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী অফিসিয়াল ডিউটি হিসেবে যদি সবকিছুকে চালিয়ে দিতে চান তাহলে তো তা হবে না। তিনি সীমা লঙ্ঘন করলে তার দায়ভার তাকে নিতে হবে। অপরাধ করলে তাকে আইনের মুখোমুখি হতে হবে।

ওসির বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা হয়েছে। একটি ভালো খবর হলো যে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরওয়ানা জারি করা হয়েছে। এর ফলে নীতিগত জায়গায় কিছুটা জয় হলো যে পুলিশের বিরুদ্ধে অন্তত পরওয়ানা জারি করা গেলো।

ঘটনার সঙ্গে তার (ওসি) সম্পর্কটি যদি খুব দূরবর্তী হয় তাহলে তাকে দোষী করা মুশকিল হবে এবং এর ফলে মামলা দুর্বল হবে। কিন্তু, তদন্তে যদি এমন দেখা যায় যে তার দায়বদ্ধতা আসলে খুব রিমোট না সে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। তার দায়িত্বহীনতা, অবহেলা, বা কার্যকলাপের জন্যে ঘটনাটি ঘটতে পেরেছে এবং সে অ্যাভেটার হিসেবে কাজ করেছে তাহলে তাকে চার্জশিটে আনাটাই উচিত।

ওসির বিরুদ্ধে তার বিভাগীয় তদন্তের পাশাপাশি তাকে ক্রিমিনাল অ্যাক্টে বিচার করা যেতে পারে কি?- হ্যাঁ পারে। কোনো বাধা নেই। আপিল বিভাগে এ বিষয়ে অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়া রয়েছে। একসঙ্গে দুটি বিচার চলতে কোনো বাধা নেই। আমি নিজেও এমন অনেক মামলায় অংশ নিয়েছি।

কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী যদি নীতিবিরুদ্ধ কোনো কাজ করলে তা বিভাগীয় ব্যবস্থার অধীনে যাবে। কিন্তু, কোনো ক্রিমিনাল অ্যাক্ট করলে তা দেশের প্রচলিত আইনে বিচার হবে। এই দুটো প্রক্রিয়া পাশাপাশি চলতে কোথাও কোনো বাধা নেই।

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

6h ago