মোবাইল গ্রাহকরা কী করবেন, তার স্বার্থ কে দেখবে?
গত কয়েক দিনে রবি এবং গ্রামীণফোনের গ্রাহকরা তাদের নিজ নিজ অপারেটরদের থেকে একটি এসএমএস পেয়েছেন, যেখানে জানানো হয়েছে বিটিআরসি তাদের ব্যান্ডউইথ ব্যবহার কমিয়ে দেওয়ার কারণে সেবার ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা হচ্ছে বা হতে পারে।
ব্যান্ডউইথ কমিয়ে দেওয়ায় কী হয়েছে?
ইন্টারনেটের গতি কমে গেছে, কোথাও কোথাও ইন্টারনেট একেবারেই ‘নেই হয়ে গেছে’। ইন্টারনেট ছাড়া যখন একটি দিন চিন্তা করাও অকল্পনীয়, তখন গতি কমে যাওয়া বা ইন্টারনেটবিহীন দিন কাটানো প্রায় অসম্ভব একটি ব্যাপার।
অনেকেরই জীবন-জীবিকা এখন ইন্টারনেটের ওপর নির্ভর করে। এই তো রাইড শেয়ারিংয়ের কথাই ধরুন না। অনেক রাইডারই এখন লোকেশন ঠিক মতো পিনপয়েন্ট করতে পারছেন না। যারা অনলাইনে পড়াশুনা করেন তাদেরও ত্রাহি অবস্থা। কিছুটা হলেও প্রভাব পড়ছে ই-কমার্সসহ আরো কয়েকটি ডিজিটাল সেবার ওপরেও।
ব্যান্ডউইথ কমে যাওয়ার কারণে কল ড্রপও বাড়ছে। একটি কল করার পর কলটি সফল হতেও সময় বাড়ছে। আর যারা বিভিন্ন কমিউনিকেশন অ্যাপ ব্যবহার করে দেশের-ভেতরে বা বাইরে কথা বলতেন তাদেরও যোগাযোগের ক্ষেত্রে বড় একটি বাঁধা তৈরি হচ্ছে।
পেছনের ঘটনা যারা অনুসরণ করেননি তাদের জন্যে বলে রাখি, গত ৪ জুলাই বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন এক আদেশের মাধ্যমে গ্রামীণফোনের মোট ব্যবহৃত ব্যান্ডউইথের ৩০ শতাংশ এবং রবি’র ১৫ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে।
ফলে ৪ জুলাই সন্ধ্যা থেকে গ্রাহক এবং অপারেটররা পড়েছেন চাপে।
ব্যান্ডউইথ কমিয়ে দেওয়ার কারণ কী?
বিটিআরসির দাবি গ্রামীণফোন এবং রবির কাছে সরকারের সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা পাওনা, যেটি অডিটের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়েছে। আর সেটা আদায় করতে তাদের এই প্রাথমিক উদ্যোগ। আইনের ক্ষমতা এবং সরকারের উচ্চমহলের ইশারা তাদেরকে এমন কঠিন ‘প্রাথমিক’ পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে বলে জানিয়েছে বিটিআরসি।
বেসরকারি অডিটর নিয়োগ করে সরকারের যে প্রাপ্তির হিসাব কষেছে সেখানে দেখা যাচ্ছে গ্রামীণফোনের কাছে বিটিআরসির দাবি ১২ হাজার ৫৭৯ কোটি ৯৫ লাখ এবং রবির কাছে দাবি ৮৬৭ কোটি ২৪ লাখ টাকা।
অপারেটরের কাছে সরকারের টাকা পাওনা মানে তো আসলে এই দেশের একজন ট্যাক্স প্রদানকারী নাগরিক হিসেবে পাওনাটা আসলে আমার-আপনার সবার। সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা পাওনা মানে আপনার ভাগেও আট হাজার টাকার কিছু বেশি পড়ে।
সুতরাং রাষ্ট্র এবং সরকার তাদের প্রাপ্য আদায়ে সকল জনগণকে পাশে পাবেন, সেটাই তো প্রত্যাশিত।
পাওনা যৌক্তিক হলে, আইনগত ভিত্তি থাকলে, টাকা আদায়ের বহুবিধ পথ খোলা আছে। ব্যান্ডউইথ কমানো মানে সরাসরি ক্ষতির শিকার গ্রাহক।
এখানে আমার প্রশ্ন হলো এই যে বড় দুটি মোবাইল ফোন অপারেটরের ব্যান্ডউইথ কমিয়ে দেওয়া হলো - যাদের নেটওয়ার্কেই আসলে সাড়ে নয় কোটি মোবাইল সংযোগের দুই তৃতীয়াংশ বা তার চেয়েও বেশি রয়েছে - তাতে লাভটা কার হলো? কে কী অর্জন করল? বরং ডিজিটাল সেবা এই আছে-তো এই নাই অবস্থার মধ্যে পড়ে গেলো। এমনকী, সিদ্ধান্তটা যারা নিলেন তারাও তো বিঘ্নিতসেবা পাচ্ছেন। মূলত ভোগান্তি বা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন গ্রাহকরা।
‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বিষয়ে বিশ্ব দরবারেই বা কী বার্তা দেওয়া হলো? এর আগে তো গোটা টেলিকম দুনিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বড় অডিটের দাবি তুলে বিটিআরসি আগেই সারা দুনিয়ায় এই খাতের বড় খবর হয়ে গেছে। এবার ব্যান্ডউইথ কমিয়ে দিয়ে আমরা আবারো তথ্যপ্রযুক্তি দুনিয়ার নেতিবাচক খবর হয়ে গেলাম।
ডিজিটালাইজেশনের মূল উপাদানই যেখানে ব্যান্ডউইথের ব্যবহার বাড়ানো সেখানে এই ধাক্কায় দেশের ব্যান্ডউইথের ব্যবহার প্রায় ১০০ জিবিপিএস কমিয়ে দেওয়া হলো। অথচ ইন্টারনেট ডেটার চাহিদা কিন্তু প্রতিদিনই বাড়ছে।
বিটিআরসি বলছে, টাকা আদায়ে তাদের হাতে আর কোনো বিকল্পই ছিলো না। এখানে আমার সবিনয় দ্বিমত হলো টাকা আদায়ের জন্যে তো বিটিআরসি এর আগে অনেক অপারেটরের বিরুদ্ধে পাবলিক ডিমান্ড রিকভারি অ্যাক্টে মামলা করেছে। এমন অন্তত ছয়টি মামলার কথা জানা আছে। তাহলে এখানে কেনো গ্রাহককেই জিম্মি করতে হলো?
বিষয়টি নিয়ে অনেকদিন থেকেই রশি টানাটানি চলছে দেখছি। টানাটানির একটা পর্যায়ে বিষয়টি ওঠে সরকারের নীতি-নির্ধারণী বৈঠকে। সেটি গত ১৭ এপ্রিলের কথা। ওখান থেকেই সিদ্ধান্ত আসে “মোবাইল অপারেটরদের অডিট অবজেকশনের বকেয়া পাওনা আদায় করার জন্য বিটিআরসি একটি নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিয়ে নির্দেশনা জারি করবে। ওই সময়ের মধ্যে পাওনা আদায় না হলে বিটিআরসি অর্থ আদায়ের ব্যবস্থা হিসেবে বিধি মোতাবেক সেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে লাইসেন্স বাতিলসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।”
ওই বৈঠকের ধারাবাহিকতায় আরও একটি বৈঠক আসন্ন। আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই হতে পারে সেটি। আর সে কারণেই তড়িঘড়ি করে একটা কিছু ব্যবস্থা বিটিআরসি নিয়ে নিলো যাতে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে সেটি তারা বৈঠকে উপস্থাপন করতে পারে – এমন কথা কিন্তু বিটিআরসির অনেকেই স্বীকারও করেছেন।
সুতরাং কার ওপর দিয়ে কতোটা গেলো সেটি এখানে দেখার সুযোগ কম।
অপারেটররা কিন্তু এটি নিয়ে আরবিট্রেশনের দাবিও তুলেছেন। কিন্তু সেই দিকে যে বিটিআরসি হাঁটবে না তা তারা পরিষ্কার করে দিয়েছেন। বিটিআরসি বলছে, টেলিযোগাযোগের বিষয় আরবিট্রেশন আইনে যাওয়ার সুযোগ নাই। এখানেও আমার দ্বিমত আছে। আরবিট্রেশন তো এ দেশেরই আইন এবং দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা না হলে যে কেউই এই আইনের আশ্রয় নিতে পারে হোক সে – সরকারি সংস্থা বা বেসরকারি।
আরবিট্রেশনে না যাওয়ার ক্ষেত্রে কী এটিও একটা কারণ যে অডিটরের দাবিগুলো শক্ত নয়? সেটি হলে ভিন্ন কথা। না হলে অন্তত গ্রাহকের কথা মাথায় রেখে হলেও বিটিআরসি আরবিট্রেশনের পথ দেখতে পারতো বলেই মনে করি।
এই লেখা লিখতে লিখতেই খবর পেলাম, টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকেও বিটিআরসিকে আরবিট্রেশনে যাওয়ার জন্যে নির্দেশনা দিয়েছে। তাহলে তো প্রশ্নটা আরো বড় হলো – গ্রাহককে কোনো ভোগান্তিতে ফেলছেন?
সর্বশেষ এই ঘটনার কয়েকদিন আগের একটি ঘটনাও তুলে আনতে চাই। পাস হওয়া বাজেটে আমরা দেখলাম মোবাইল ফোন ব্যবহারের ওপরে ট্যাক্স বাড়ল। গত চার বছর ধরেই যা ধারাবাহিকভাবে বেড়েই চলেছে। ফলে আমরা ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ স্লোগানকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেও আমাদের সিদ্ধান্ত কিন্তু সব চলে যাচ্ছে ডিজিটালাইজেশনের বিপক্ষে।
বিষয়টা এমন দাঁড়িয়েছে যে বাজেট আসলেই ডিজিটাল সেবাদাতা সংস্থাগুলোকে সব ছেড়ে-ছুঁড়ে ছুটতে হচ্ছে নতুন ট্যাক্সের ‘ধাক্কা’ ঠেকাতে। আর শেষে এসে ধাক্কাটা গ্রাহকদের ওপরেই লাগছে বেশি।
সব মিলে যে উদাহরণ তৈরি হচ্ছে, তাতে বৈশ্বিক বিনিয়োগ ইনডেক্সে আমাদের অবস্থানে প্রভাব পড়ছে কী না, তা ভেবে দেখার দাবি রাখে। আর সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ থেকে টেলকম খাতের বিনিয়োগ যে গুটিয়ে যাচ্ছে সেটিও মাথায় রাখা দরকার মনে হয়। এখানেও নিয়ন্ত্রক সংস্থা দায় এড়াতে পারে না।
বলার অপেক্ষা রাখে না নিয়ন্ত্রক সংস্থা গোটা টেলিকম খাতের অভিভাবক। অথচ পাওনা টাকার কারণে যদি ব্যান্ডউইথ কমিয়ে দিতে হয় তাহলে টেলিটকের ব্যান্ডউইথ-ই তো সবার আগে কমাতে হতো। দেশীয় এই অপারেটরটির প্রতি কোনো ক্ষোভ তো নেই-ই বরং এক ধরনের পক্ষপাতিত্ব আছে। সেটি মাথায় রেখেই বলছি, তাদের কাছে তো প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা বাকি। আর যেভাবে গ্রামীণফোন বা রবির অডিটের সঙ্গে বিলম্ব ফি হিসেবে ১৫ শতাংশ করে অতিরিক্ত দাবি করা হয়েছে, সেভাবে টেলিটকের হিসাব করা হলে পাওনা কয়েক হাজার কোটি টাকা হয়ে যাবে।
আবার যে কয় কোটি টাকার জন্যে সিটিসেল বন্ধ হলো সেই হিসাব বিবেচনায় নিলে টেলিটককে কতোবার বন্ধ করতে হবে? এই কথার মানে আবার এমনটা না যে, টেলিটক বন্ধ করে দিতে বলছি। অবশ্যই তা চাই না। বরং চাই টেলিটক সেবা দিয়ে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠুক।
বক্তব্যটা হলো আপনি যখন অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে সিটিসেল বন্ধ করেন, অন্যদের ব্যান্ডউইথ কমিয়ে দেন তখন সমান দায়িত্ব নিতে হবে অন্য জায়গাতেও। নতুন লাইসেন্স দিয়ে বা স্পেকট্রাম বিক্রি করে সরকারের জন্যে টাকা আয় করা যদি আপনার কৃতিত্ব হয় তবে ওয়াইম্যাক্স বন্ধ হয়ে যাওয়া বা পিএসটিএনের মরে যাওয়ার দায়ও আপনাকে নিতে হবে।
মনে রাখাতে হবে, আপনার একটি সিদ্ধান্ত কিন্তু ১৬ কোটি সংযোগের ওপর প্রভাব ফেলে। ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া, ফেসবুক-ভাইবার-হোয়াটসঅ্যাপ বা তারও আগে প্রায় বছর জুড়ে ইউটিউব বন্ধ থাকা এসব ঘটনা ডিজিটাল বাংলাদেশকে বিশ্বজুড়ে কেমন ব্র্যান্ডিং দিয়েছে?
আমরা টুজি-থ্রিজি পেরিয়ে ফোরজি ব্যবহার করছি। সামনের দিনে ফাইভজি আসবে। কিন্তু কতো শতাংশ গ্রাহক ফোরজি সেবার আওতায় এসেছে? গ্রাহককে মোবাইল ইন্টারনেট সেবা কিনতে হচ্ছে অত্যন্ত উচ্চ মূল্যে। গ্রামের কথা বাদই দিলাম, ঢাকার বাইরে অনেক উপজেলা শহরেও ফোরজি ঠিকমতো কাজ করে না। গতি খুবই কম। দুর্বল নেটওয়ার্ক, কল ড্রপ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেওয়ার যেনো কেউ নেই। পয়সা খরচ করেও ঠিক মতো কথা বলা যাবে না? সরকারের নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রথম দায়িত্ব গ্রাহকের স্বার্থ দেখা। সাশ্রয়ী মূল্যে ফোরজি সেবা নিশ্চিত করা। ফোরজির নামে টুজি, থ্রিজি সেবা চালিয়ে যাওয়া প্রতিরোধ করা। সেদিকে বিটিআরসির কোনো নজর নেই।
ন্যায্য পাওনা অবশ্যই অপারেটরদের থেকে আদায় করতে হবে। কিন্তু তার জন্যে ভোগান্তি পোহাতে হবে কেনো গ্রাহকদের? নিশ্চয় পাওনা আদায়ের আরও অনেক কার্যকর পন্থা আছে। ব্যান্ডউইথ কমিয়ে দিতে হবে কেনো?
বিটিআরসি বলছে ‘পাওনা পরিশোধ না করা পর্যন্ত এভাবেই চলবে’।
গ্রাহকরা কী করবেন? তার স্বার্থ কে দেখবে?
মুহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম: সিনিয়র রিপোর্টার, দ্য ডেইলি স্টার
Comments