কারসাজির শাস্তি না হওয়াতে পুঁজিবাজারে দৈন্যদশা

DSCL
ছবি: স্টার ফাইল ফটো

বিশ্বের প্রায় সব দেশের পুঁজিবাজারে নিয়মিত বিরতিতে উত্থান-পতন ঘটে। আর পতন হলেও বিনিয়োগকারীদেরকে সাধারণত রাস্তায় নামতে দেখা যায় না। কিন্তু, বাংলাদেশে কিছুদিন পরপর বিনিয়োগকারীদেরকে বিক্ষোভ করতে দেখা যায়।

সরকারের বক্তব্য হচ্ছে, বিনিয়োগকারীরা মুনাফা হলে কথা বলেন না, লোকসান করলেই হৈচৈ করেন। আসলেই কি তাই? বিনিয়োগকারীরা কেনো হৈচৈ করেন, কেনো তারা টাকা হারান- তা কি কখনো ভেবে দেখেছেন? তাদের ক্ষুদ্ধতার কারণ কি শুধুই সূচকের পতন? নিত্যনৈমিত্তিক কারসাজির কারণে তাদের টাকা খোয়া যাওয়া নয়? না কী কারসাজিকারীদের শাস্তি না হওয়ার প্রবণতায় জিইয়ে থাকা আস্থাহীনতা দূর করতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার ব্যর্থতা?

উন্নত থেকে শুরু করে উদীয়মান সব পুঁজিবাজারেই উত্থান-পতন হয়। একবছর উত্থান হয় তো পরের বছরই পতন। পতনের কিছুদিন পরই দেখা যায়, আবার মার্কেট উত্থান এবং সেটিও আগেরটিকে ছাড়িয়ে পৌঁছায় নতুন উচ্চতায়। আর আমাদের দেশে পুঁজিবাজার মানেই মন্দা। ২০১০ সালে বাজারে যে উত্থান হয়েছিলো এরপর গত নয় বছরে বাজার এখন পর্যন্ত তার ধারে কাছেও যেতে পারেনি। এর বড় কারণ হলো- আমাদের দেশে পুঁজিবাজারের উত্থান কখনোই তার নিজস্ব শক্তিমত্তা দিয়ে হয়নি।

২০১০ সালে বাজারে যে উত্থান হয়েছিলো সেটি হয়েছিলো হঠাৎ করে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বাজারে ঝাঁপিয়ে পড়ায়। সে বছর ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠানও তাদের মূল ব্যবসায়িক কার্যক্রমে মনোযোগ কমিয়ে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে। ফলে সূচক কোনো কারণ ছাড়াই ধাই-ধাই করে বেড়ে যায়।

পুঁজিবাদের নিয়ম হলো যেখানে মুনাফা সেখানেই পুঁজি। আমাদের পুঁজিবাজারে কি মুনাফা নেই? এজন্যই মন্দাভাব লেগে থাকে না কী এখানে অন্য কোনো কারণ রয়েছে? বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে মন্দা থাকুক আর উত্থান হোক গুটিকয়েক মানুষ এখানে প্রতিনিয়তই মুনাফা করছে। এরা এসব শেয়ারের দাম বাড়ানোর জন্য নানাভাবে কারসাজি করে। যেখানে সাধারণ মানুষ মুনাফা করতে পারে না, সেখানে মুনাফা করে এসব কারসাজিকারীরা। এসব শেয়ারেই মূলত সাধারণ বিনিয়োগকারীরা টাকা হারান। মুনাফা থাকলেও তা গুটিকয়েকের জন্য। তাই পুঁজি এ বাজারের দিকে ধাবিত হয় না।

বিশ্বের সবদেশেই পুঁজিবাজারে অল্প-স্বল্প কারসাজি হয়। উদীয়মান মার্কেটগুলোতে তা একটু বেশি হয়। হলেও তার জরিমানা হয়, কিংবা অন্যভাবে শাস্তির আওতায় আনা হয় কারসাজিকারীদের। এর একটি উদাহরণ দেই। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের প্রভাবশালী ধনকুবের এবং রিলায়েন্সের কর্ণধার অনিল আম্বানিকে শেয়ার লেনদেনে আইন অমান্য করার দায়ে ২০১১ সালে সেদেশের পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা (সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অব ইন্ডিয়া) জরিমানা হিসেবে ৫০ কোটি রুপি আদায় করে। পাশাপাশি তাকে এক বছরের জন্য পুঁজিবাজারের যে কোনো লেনদেন থেকে নিষিদ্ধ করা হয়। এ ঘটনায় ভারতের অন্য কারসাজিকারীরাও সচেতন হয়। পাশাপাশি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থাও বৃদ্ধি পায়।

আর বাংলাদেশে প্রতিদিনই কোনো না কোনো শেয়ারে কারসাজির প্রক্রিয়া চলতে থাকে। কয়েকজন মিলে শেয়ার কিনতে থাকে। এরপর তাদের কেনা হয়ে গেলে ছড়ানো হয় গুজব। কখনো কখনো কোম্পানিকে সঙ্গে নিয়েও নানাভাবে বিনিয়োগকারীদেরকে প্রলুব্ধ করা হয়। ব্যস, সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও এসব গুজবে কান দিয়ে শেয়ার কিনতে শুরু করেন, এরপর শুরু হয় কারসাজিকারীদের শেয়ার বিক্রির পালা। প্রতিনিয়তই চলছে এ প্রক্রিয়া। কিন্তু, এ ব্যাপারে বিএসইসির তেমন কোনো পদক্ষেপ নেই, তেমন কারো বিচারও হয় না। দুই-একটি যাও হয়, তাও তা সংখ্যায় এতোটাই কম যে কারসাজিকারীরা তাতে থোরাই কেয়ার করে।

এ পর্যন্ত যে কয়েকজনকে জরিমানা করা হয়েছে তা তাদের কারসাজির মাধ্যমে উপার্জিত টাকার তুলনায় খুবই অল্প। উদাহরণ দিয়ে বলি- কেউ হয়তো কারসাজি করে ৫ কোটি টাকা উপার্জন করলো আর তাকে জরিমানা করা হলো মাত্র ৫০ লাখ টাকা। তাও সে হয়তো ১০টি শেয়ারে কারসাজি করেছে। কিন্তু, তাকে জরিমানা করা হয়েছে একটি শেয়ারে কারসাজি করার জন্য।

এছাড়াও, শাস্তি যেটুকু হয় তাও তাদের জাত-পাত বিবেচনা করে হয়। অর্থাৎ কারসাজিকারীদের যদি কোনো ধরনের রাজনৈতিক শক্তি না থাকে সেক্ষেত্রে বিচার হয় এক রকম, আর যদি ক্ষমতাধর হন তাহলে শাস্তি আদৌ হয় না, হলেও তা হয় আরেক রকম।

এখন প্রশ্ন হলো কারসাজি করলে বাজার কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কিংবা বাজার কেনো পতনমুখী থাকে। একটি বিষয় খুব পরিষ্কার যে, কারসাজি হয় সাধারণত খারাপ কোম্পানি (যাদের পারফরম্যান্স খারাপ অর্থাৎ লভ্যাংশ দিতে পারে না, কিংবা কারখানাই বন্ধ) অথবা স্বল্প মূলধনী কোম্পানিগুলোকে ঘিরে। কারসাজির মাধ্যমে এসব কোম্পানির দাম অনেক বাড়ে, আবার অনেক কমে। কিন্তু, ভালো কোম্পানির (যেসব কোম্পানি নিয়মিত লভ্যাংশ দেয় এবং সম্ভাবনা রয়েছে) শেয়ারের দাম সেভাবে বাড়েও না, কমেও না। ফলে বিশ্লেষণধর্মী বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে আস্থা হারান।

এর একটি উদাহরণ দেই- সাভার রিফ্রেক্টোরিজের মতো কোম্পানি, যেটি অন্তত দশ বছরের মধ্যেও কোনো লভ্যাংশ দিতে পারেনি সেটির শেয়ারের দামও ১০০ টাকা। নর্দান জুট সেটিও জেড ক্যাটাগরির কোম্পানি অথচ শেয়ারের দাম ১২০০ টাকার উপরে। সোনালী আঁশের শেয়ারের দাম ৫৪০ টাকা, যেটি লভ্যাংশ দেয় প্রতিবছর মাত্র ১০ শতাংশ করে।

অথচ স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের শেয়ারের দাম আড়াইশ টাকার নিচে, যেটি প্রতি বছর ৪০ শতাংশেরও বেশি লভ্যাংশ দিয়ে আসছে। ব্র্যাক ব্যাংকের মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম ৬০ টাকারও নিচে। এটিও প্রতি বছর অন্তত ২৫-৩০ শতাংশ করে লভ্যাংশ প্রদান করছে।

এ ধরনের অসামঞ্জস্যপূর্ণ দামের কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা নৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন এবং শেষ পর্যন্ত খারাপ শেয়ারেই বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। স্বাভাবিকভাবেই কারসাজির শেয়ারে বিনিয়োগ করে দুই-একটিতে মুনাফা করতে পারলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা বড় ধরনের লোকসান করেন। এতে তাদের আর বিনিয়োগের সুযোগই থাকে না। আর প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী থেকে শুরু করে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এ ধরনের অসামঞ্জস্যপূর্ণ শেয়ারের দরের কারণে আস্থাহীনতায় পড়েন।

আমাদের পুঁজিবাজারে কারসাজি এতোই বেশি যে, গত তিন সপ্তাহ ধরে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) যেখানে প্রধান সূচক কমেছে ৪ শতাংশেরও বেশি সেখানে একই সময়ে অন্তত ১০টি কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়েছে ২৫ থেকে ৩৫ শতাংশের মতো। যেগুলোর সবগুলোই হয় কম লভ্যাংশ দেওয়া কোম্পানি নতুবা স্বল্প মূলধনী কোম্পানি।

সময় এসেছে কারসাজিকারীদের বিরুদ্ধে শক্ত হাতে কাজ করার। নিয়ন্ত্রক সংস্থা চাইলে এ ধরনের কারসাজি খুব সহজেই বন্ধ করতে পারে, অন্যথায় তাদের কাছে থাকা অত্যাধুনিক সার্ভিল্যান্স সফটওয়্যারের যৌক্তিকতা কোথায়?

গত এপ্রিল-মে মাস জুড়ে পুঁজিবাজারে ব্যাপক দরপতনের প্রেক্ষিতে জুন মাসে নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে বেশি কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়। স্টক ব্রোকার, মার্চেন্ট ব্যাংকার এবং অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিগুলোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে অন্তত ২১টি আইনগত পরিবর্তন আনে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। কিন্তু, কোনো বিনিয়োগকারী কিংবা বাজার বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন মনে করেনি নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।

আইনে এতো এতো পরিবর্তন আনার পাশাপাশি সরকারও বাজেটের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের জন্য করমুক্ত লভ্যাংশ আয় সীমা বাড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকেও ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের সীমা বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এতে করে সাময়িক পতন থামলেও আদতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। আবারও ডিএসইর সূচক পাঁচ হাজারের কাছাকাছিতে নেমে এসেছে। এবার বিএসইসিও হতাশ- কারণ এতো এতো পদক্ষেপের পরও বাজার কেনো পড়ছে?

প্রকৃতপক্ষে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও বিএসইসি আসল জায়গাতেই হাত দেয়নি। সেটি হলো বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরানোর জন্য কারসাজিকারীদের শাস্তি দেওয়া- যেনো কারসাজি উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমে আসে। পাশাপাশি বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে নিয়ে আসার জন্য কার্যকরী উদ্যোগও নেওয়া হয়নি। বিএসইসি যদি সত্যিকার অর্থেই বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে কারসাজি বন্ধ করে এবং কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানিকে বাজারে তালিকাভুক্ত করে তখন অনেক বিনিয়োগকারী এখানে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবেন।

তবে এটিও সত্য যে আমাদের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সচেতনতা কম। তারা জেনে-শুনেও খারাপ শেয়ারে বিনিয়োগ করেন। বিনিয়োগকারীদেরকে মনে রাখতে হবে নিজেদের কষ্টার্জিত অর্থ নিজেদেরকেই রক্ষা করতে হবে। অনেক বিনিয়োগকারীই মনে করেন পুঁজিবাজার মানেই স্বল্প সময়ে অনেক লাভ। এ ধরনের মানসিকতা নিয়ে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ না করাই ভালো। বাজারে বিনিয়োগের আগে ভাবতে হবে যে এখানে বিনিয়োগ করলে যেনো ব্যাংকের সুদের হারের চেয়ে কিছুটা বেশি মুনাফা করা যায়। অর্থাৎ এক বছরে ১০-১২ শতাংশ মুনাফা পেলেই সন্তুষ্ট থাকা উচিত। এর চেয়ে বেশি মুনাফা আশা করা মানেই নিজের অর্থকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেওয়া। এই সত্যটি তাদের বুঝতে হবে।

আহসান হাবীবস্টাফ রিপোর্টার, দ্য ডেইলি স্টার

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

NCP to announce 'July manifesto' on Aug 3: Nahid

Central NCP leaders held a rally in Bogura today as part of their month-long "July March to Build the Nation" rally

1h ago