নগদ ২ কোটি টাকা, রোগ না রোগের উপসর্গ?

যুবলীগ নেতা ও প্রভাবশালী ঠিকাদার জি কে শামীমকে গ্রেপ্তারের পর তার কাছে পাওয়া গেছে নগদ প্রায় দুই কোটি টাকা। তার ব্যাংক হিসেবে আছে ৩০০ কোটি টাকা। জানা গেছে, তার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ৩ হাজার কোটি টাকার কাজ পেয়েছে।...
Ibrahim and Iftekhar
অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ (বামে) এবং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। ছবি: সংগৃহীত

যুবলীগ নেতা ও প্রভাবশালী ঠিকাদার জি কে শামীমকে গ্রেপ্তারের পর তার কাছে পাওয়া গেছে নগদ প্রায় দুই কোটি টাকা। তার ব্যাংক হিসেবে আছে ৩০০ কোটি টাকা। জানা গেছে, তার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ৩ হাজার কোটি টাকার কাজ পেয়েছে। যুবলীগের ঢাকা দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়ার বিপুল সম্পদ, কয়েক হাজার কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজ, টর্চার সেল ও ক্যাসিনোর সন্ধান মিলেছে। সম্রাটসহ আরও কয়েকজন যুবলীগের নেতা-ঠিকাদার, যারা হাজার কোটি টাকার কাজ পেয়েছেন।

দুই কোটি নগদ টাকা-বিপুল সম্পদ, না কীভাবে একজন কয়েক হাজার কোটি টাকার কাজ পেলেন, কোনটি গুরুত্বপূর্ণ? কোনটি রোগ আর কোনটি উপসর্গ?

বিষয়টি নিয়ে  দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনের পক্ষ থেকে কথা বলেছি বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এবং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের সঙ্গে।

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, “আমার মনে হয়, এতো টাকার কাজ পাওয়াটাই মূল সমস্যা। এতো কাজ একজন লোকে কী করে পায়? প্রোপার কম্পিটিশন হলে এগুলো সাধারণত ডিসবার্জ হয়ে যায়। কাজ একেকজন পায়। দু-চারটি হয়তো তিনি পেতে পারেন। কিন্তু, মনে হয় তারা সেসব জায়গায় কাজ পান সেখানে টাকা-পয়সা দিয়েই কাজ পান। ঘুষ দিয়ে কাজ পান- এটাই সাধারণভাবে ধারণা করা যায়। সে জন্যে সেখান থেকে টাকা তো আসবেই। তারা যতো বড় কাজ করেন সেই হিসাবে তাদের কাছে দুই কোটি টাকা থাকাটা বড় কথা নয়।”

“কিন্তু, আমার মূল কথা হলো: এতোগুলো কাজ একজন লোকের হাতে কেন্দ্রীভূত হয় কীসের বিনিময়ে? এটিই মূল প্রসঙ্গ।”

সরকারের ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?- “সরকার কী করে, দেখি। এগুলোর তদন্ত হতে হবে। তদন্ত করে বের করতে হবে (প্রকৃত ঘটনা)। শুধু দুই কোটি টাকার বা বিপুল সম্পদের তদন্ত করে লাভ নেই। তদন্ত করতে হবে- একেকজন কয়েক হাজার কোটি টাকার এতোগেুলো কাজ কী করে পেলেন। কারা কারা (এর সঙ্গে) জড়িত। কারা কারা টাকার বিনিময়ে তাকে সাহায্য করেছে। বা টেন্ডারের সময় আদৌ কোনো প্রতিযোগিতা হতো কী না- এগুলো দেখে, যারা যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। আমার ধারণা যারা কাজ দেওয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত, তারা নিশ্চয়ই টাকা নিতো। সেই জিনিসটাকে (তদন্ত করে) বের করে আনতে হবে। তাদের জবানবন্দি নিয়ে, জিজ্ঞাসাবাদ করে কারা কারা জড়িত তা জানতে হবে। আমার মনে হয়, তাদেরকেও আইনের আওতায় আনা উচিত।”

গত ২০ সেপ্টেম্বর গুলশানের অফিস থেকে যুবলীগ নেতা জি কে শামীমকে আটক করার সময় র‌্যাব প্রায় ২ কোটি টাকা উদ্ধার করে। ছবি: স্টার

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “দুটিই রোগ, দুটিই উপসর্গ- দুটিই গুরুত্বপূর্ণ। একটির সঙ্গে অন্যটির ওতপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে। মূলত কাজ পাওয়ার বিষয়টি হলো: সার্বিকভাবে সারাদেশে যে দুর্নীতি হয় তা রাজনীতি, ব্যবসা এবং প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা- এদের যোগসাজশের মাধ্যমে হয়। এটি একটি সিন্ডিকেটের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে।”

“অর্থের পরিমাণ হিসেবে দুই কোটি টাকার যে কথাটি গণমাধ্যমে এসেছে তা আমার মতে হিমশৈলের চূড়া মাত্র। এটি মূল রোগের একটি উপাদান মাত্র। মূল রোগ হচ্ছে- রাজনীতি, ব্যবসা ও প্রশাসন। এদের ত্রিমুখি আঁতাতের কারণে দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকিকরণ হচ্ছে। এর সিন্ড্রোম বা বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে বৈধসূত্রের তুলনায় অবৈধ অর্থের পরিমাণ বেশি হওয়া।”

“প্রধানমন্ত্রী বলেছেন- টাকার অংকটি গুরুত্বপূর্ণ না। গুরুত্বপূর্ণ হলো: অবৈধ উপায়ে যে কেনো পরিমাণ অর্থ আয় করা হলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। কম হোক, বেশি হোক- সেগুলো একইভাবে অপরাধ।”

সরকারের ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?- “সরকারের ব্যবস্থাকে আমি মনে করি, একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘প্রথম পদক্ষেপ’। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। রাজনৈতিক অঙ্গীকারের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে এটিকে আমরা ইতিবাচকভাবে দেখতে চাই। বাংলাদেশে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব- এসব অভিযানের ফলে মানুষের মধ্যে এই প্রত্যাশার জন্ম দিবে বলে আমি মনে করি।”

“কিন্তু, এর সত্যিকারের সুফল আসলে কতোটুকু হবে সেটি নির্ভর করবে এই উদ্যোগটি কতোখানি বিস্তৃত হবে বা কতোখানি গভীর হবে। যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, যে কতোজনকে এখন পর্যন্ত চিহ্নিত করা হয়েছে, আটক করা হয়েছে বা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে- তারা কিন্তু, কোনো ক্ষেত্রেই এককভাবে অপরাধ করে নি। লেনদেন হয়েছে যোগসাজশে। এই কয়েকজনই যে অপরাধ করেছে তা কিন্তু নয়, সারাদেশে সব পর্যায়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে এই ধরনের প্রবণতা কম-বেশি বিরাজমান। তাই অভিযানগুলো ব্যাপক ও বিস্তৃত হতে হবে।”

“এই যে ‘ক্যাসিনো’ ব্যবসাসহ অনিয়মগুলো ঘটেছে- এগুলো এককভাবে হয়নি। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, প্রশাসনের চোখের সামনে এগুলো হয়েছে। তাদের কাছে তথ্য অবশ্যই ছিলো। এমনকী, বিভিন্ন পর্যায়ের স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও যদি বলেন- ‘আমরা জানতাম না’ তাহলে তাদের কথা কতোটুকু গ্রহণযোগ্য হবে তাও দেখার বিষয় আছে।… আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগাযোগ বা তাদের দায়িত্বে অবহেলা- এগুলোকেও জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে হবে।”

‘মূল হোতা’দের সম্পর্কে কিছু শুনতে পাচ্ছেন কি?- “মূল হোতা কারা তা খুঁজে বের করতে হবে।… যে অপরাধগুলোর কথা আমরা জেনেছি এই অপরাধগুলো কোনোটাই এককভাবে হয়নি। এটিই হলো মূল বিষয়। অর্থাৎ, এর সঙ্গে (অপরাধীদের) সুরক্ষা দেওয়া থেকে শুরু করে যোগসাজশ এবং অংশীদার- বিভিন্ন ভূমিকায় আরো বিভিন্ন ব্যক্তি রয়েছেন। এসবের পেছনে বিভিন্ন পর্যায়ের আরো ক্ষমতাবান ব্যক্তি থাকতে পারেন- এটিই হচ্ছে আমাদের বক্তব্য।”

আরো পড়ুন:

পিডব্লিউডির কাজ হারাতে পারেন জি কে শামীম

সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে জি কে শামীমকে আটক করা হয়েছে: র‌্যাব

শামীমের ব্যাংক একাউন্টে ৩০০ কোটি টাকা

৩ মামলা দিয়ে জি কে শামীমকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

10h ago