জাস্টিফিকেশন পার্টি এবং সিলেক্টিভ প্রতিবাদসমূহ
আমাদের দেশে নৃশংস ঘটনা যেনো অনেকটা রুটিন মেনেই চলে। প্রত্যেকটা নৃশংস ঘটনায় নিয়ম মেনেই চলে জাস্টিফিকেশন বা সাফাই। কুপিয়ে হত্যার পক্ষে সাফাই, পিটিয়ে মারার পক্ষে সাফাই, ধর্ষণের পক্ষে সাফাই, বিনা বিচারে হত্যার পক্ষে সাফাই। সাফাইয়েরও আছে কয়েক স্তর। কড়া সাফাই, হালকা সাফাই, কূটনৈতিক সাফাই ইত্যাদি। আমাদের দেশ আসলে হরেক রকম সাফাইয়ের দেশ।
সাফাইর বিপরীতে আমরা মানবিকতাও পাই বটে। তবে সেই মানবিকতার উদগীরণও আবার ইস্যু বুঝে হয়ে থাকে। কে কোন ব্যাপারে কতটুক মানবিক হবে কিংবা দানবিকতার পক্ষে গলা খুলে না বললেও একটু মিনমিন করবে কী না, তার জন্য একটা রুটিন করা আছে। মানে একটা ছক সাজানো। সেভাবেই চক্রের মতো ঘুরছে সব। মানবিকতাও এখানে ইস্যু দেখে, পক্ষ দেখে উথলে উঠে বা মিইয়ে যায়।
কোনো একটা ভয়াবহ অপরাধের পরও আজ পর্যন্ত শর্তহীনভাবে গোটা দেশের মানুষ একসঙ্গে প্রতিবাদমুখর হয়নি। যেকোনো অপরাধী যখন সমাজের একটা ছোট্ট অংশ থেকেও আত্মিক সমর্থন পায়, তখন তার অপরাধবোধে ভোগার সুযোগ হয় না। উল্টো সে বা তার মতো অনেকে পায় আরও বেপরোয়া হওয়ার জ্বালানি।
ছাত্রলীগের ছেলেরা বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদকে নির্মমভাবে পিটিয়ে খুন করেছে। কোনো একটা ছুতো খুঁজে প্রায়ই নাকি তারা এমন ধরে নিয়ে উত্তম-মধ্যম দিতো। সেই উত্তম-মধ্যমের মাত্রা বেশি হওয়ায় আবরার আর বাঁচেনি। কীভাবে কি হয়েছে আমরা সবাই এখন সবটা জানি। এই ঘটনার পর আমরা কী দেখলাম? প্রতিবাদ দেখলাম, খুব স্বাভাবিক ক্ষোভের বিস্ফোরণও দেখলাম, মানুষের নাড়া পাওয়া দেখলাম। মানবিকতার রমরমা অবস্থা দেখলাম কিংবা দেখছিও। আবার একটু সময় গড়াতেই পেলাম সাফাই। প্রথমে হালকা, তারপরে একটু মাঝারি, তারপরে একটু কূটনৈতিক...এভাবে। সেই সাফাই ক্রমশ কড়া হতে চলেছে। এই হত্যা জায়েজের প্রেক্ষাপটও তৈরি হওয়ার অবস্থা প্রায়।
একইসঙ্গে আরেক পক্ষের মানবিক হওয়ার শর্তও আমরা পেলাম। আবরারের চিন্তার সঙ্গে যেহেতু তাদের মিলেছে, আবরার যেহেতু মেধাবী ছেলে ছিলো, আবরার যেহেতু তাদের দৃষ্টিভঙ্গির প্রত্যাশা মিটিয়ে ‘আদর্শ ছেলে’ ছিলো, কাজেই তার জন্য মানবিক হতে হবে বেশি। এই উদ্দীপনাও দেখলাম। অর্থাৎ আবরারের চিন্তার সঙ্গে না মিললে, সে মেধাবী ছেলে না হলে, তাদের মন মতো আদর্শ ছেলে না হলে এভাবে পিটুনিতে মরলে তাদের ঠিক অতটা গায়ে লাগতো না। সে নজিরও তো আমরা আগে দেখেছিও।
ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতা পাওয়ার চড়া আওয়াজও উঠেছে। খুবই আশাবাদী কথা। আসলে কি সবাই ভিন্নমতে শ্রদ্ধাশীল? নিজেদের পক্ষে যায় এমন ‘ভিন্নমত’ নয়, নিজেদের বিপক্ষে যায় এমন ‘ভিন্নমতও’ সবাই সহনশীলভাবে মেনে নিবেন তো? ইতিহাস কিন্তু সে সাক্ষ্য দেয় না।
২০১৩ সালে বুয়েটেরই হলে আরিফ রায়হান দ্বীপ নামে এক ছাত্রকে কোপানো হয়, পরে সে মারা যায়। সে যেহেতু যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবিতে গণজাগরণে যেতো, তাই এক পক্ষের কাছে ‘ও নাস্তিক ছেলে’। এই ট্যাগ লাগলে প্রতিবাদ আর জমানো যায় না। বলে নেওয়া ভালো, সেই ছেলে ছাত্রলীগই করতো, তার দল ক্ষমতায় থাকলেও আজও বিচার অসমাপ্ত।
২০১৫ সালের বইমেলা। বুয়েটেরই সাবেক ছাত্র অভিজিৎ রায়কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই প্রকাশ্যে রাস্তায় কুপিয়ে হত্যা করা হলো। উগ্রবাদী খুনিরা দায় স্বীকার করে বার্তাও দিলো। এরপরই আমরা পেলাম ভিন্ন ছবি। একটা অংশ অবশ্যই প্রতিবাদমুখর হয়েছেন, তবে তারচেয়ে বড় একটা অংশ তালি বাজিয়েছেন। ‘ও ব্যাটা তো নাস্তিক ছিলো, ওকে মারাই উচিত’- এমন কথাবার্তা প্রকাশ্যেই এসেছে। অর্থাৎ তখন বেশিরভাগেরই মানবিকতা ঘুমিয়ে ছিলো। বরং হিংস্রভাবে জেগেছিলো নৃশংসতার সাফাই।
অদ্ভুত একটা সমীকরণ। আমরা বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাই- নৃশংসতার সাফাই দেওয়া ব্যক্তিই আবার অন্য কোনো ঘটনায় ভিন্ন ভূমিকা নিতে পারে। চরম দানবিক থেকে পরম মানবিক হতে পারে কিংবা উলটো। ক্ষেত্র বিশেষে, টপিক দেখে ইস্যু দেখে চলে এমন মানবিক বা দানবিক হওয়ার চক্র। অভিজিতের মতোই একইরকম ঘটে যাওয়া আরও অনেকগুলো ঘটনার উদাহরণ দিলে লেখাই কেবল লম্বা করা হবে।
আমরা যদি দেশের আক্রান্ত হতভাগা নারীদের দিকে দেখি- কুমিল্লার তনুকে ধর্ষণের পর খুন করা হয়। সে খুনের বিচার-টিচার কিছুই হয়নি। তুমুল প্রতিবাদ হয়েছে বটে। কিন্তু একইসঙ্গে আরেকটা জিনিসও হয়েছে। আক্রান্ত মেয়েটারই চরিত্রহনন! হ্যাঁ, প্রথমে এটা ধীরলয়ে শুরু হয়েছে, পরে কড়াভাবেও চলেছে। সিলেটে ছাত্রলীগের রাজনীতি করা আরেক গুণ্ডা বদরুল খাদিজা বেগম নামের এক তরুণীকে প্রেমে প্রত্যাখ্যানের জেরে কুপিয়েছিলো। দেশব্যাপী ব্যাপক আলোড়নের পর সরকারি ব্যবস্থায় উন্নত চিকিৎসায় সে বেঁচে যায়। কিন্তু খাদিজাও অপরাধ সাফাইকারীদের হাত থেকে বাঁচেনি। বদরুলের অপরাধ লঘু করতে খাদিজার চরিত্রহননের চেষ্টাও আমরা দেখেছি। এই অনলাইনেই, অনলাইনের বাইরেও।
আক্রান্তের পরিচয় কী, আক্রান্তের মতামত কী ছিলো, আক্রান্ত আমার পক্ষের কী না, এসব দেখে এদেশে প্রতিবাদের মাত্রা ঠিক হয়। নৃশংসতা জিইয়ে রাখার জন্য এর চেয়ে ভয়াবহ আর কিছুই হতে পারে না।
কোনো একটা অপরাধের পর অপরাধীর বিচার হওয়াটা ভীষণ জরুরি। বিচার নিশ্চিত হলে অপরাধের মাত্রা নিশ্চয়ই কমে, দৃষ্টান্ত তৈরি হয়। কিন্তু এতেই পুরোপুরি সব নিরসন করা সম্ভব না। কে আস্তিক, কে নাস্তিক, কে ছাত্রলীগ, কে শিবির, কে মেধাবী, কে অমেধাবী, কে পর্দা করেছে, কে করেনি- এসব না দেখে আমরা যদি দেখি কে আক্রান্ত, কে নির্মমতার শিকার। তার জন্য দাঁড়াতে হবে। যে হামলাকারী তার বিপক্ষে গলা চড়াতে হবে। তাহলে আরেকটা এমন ঘটনা ঠেকানোরও কাজ করা হয়।
অভিজিতের খুনিদের যেমন বিচার চেয়ে এসেছি, দ্বীপের খুনিদের যেমন বিচার চেয়ে এসেছি, একইভাবে আবরারের খুনিদেরও দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই। কোন আক্রান্ত আমার পক্ষের, কোন আক্রান্ত বিপক্ষের, কোন হামলাকারীকে একটু সফট-কর্নার দেওয়া যায়, এই হিসেব তোলা থাক। বিচার নিশ্চিতের সঙ্গে পুরো দেশের মানুষ মিলে এই অবস্থান না নিলে, কোনো আশা দেখতে পাই না। দেখি সামনে আরও নিকষ কালো আঁধার, সামনে আরও বীভৎস সময়।
একুশ তাপাদার, ক্রীড়া প্রতিবেদক, দ্য ডেইলি স্টার
Comments