রেলে ৫ বছরে বরাদ্দ ৫০ হাজার কোটি, লোকসান ৬ হাজার ৯০০ কোটি

বিপুল বিনিয়োগের পরও প্রতি বছর লোকসান গুনছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। গত প্রায় ১০ বছর ধরে বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়লেও যাত্রীর সেবার মানে আসেনি কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন।
bangladesh-railway-logo-1.jpg
ছবি: সংগৃহীত

. ১৩৪,৭৬৭ কোটি ৫১ লাখ টাকার ৩৬টি প্রকল্প চলমান

. পাঁচ বছরে বরাদ্দ ৫০ হাজার ১১৪ কোটি ৮৫ লাখ টাকা

. পাঁচ বছরে ব্যয় ২৮ হাজার ৪৮৯ কোটি ৭৫ লাখ টাকা

. পাঁচ বছরে লোকসান ৬ হাজার ৯০০ কোটি ৩ লাখ টাকা

বিপুল বিনিয়োগের পরও প্রতি বছর লোকসান গুনছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। গত প্রায় ১০ বছর ধরে বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়লেও যাত্রীর সেবার মানে আসেনি কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন।

রেল কর্তৃপক্ষ বলছে, লোকসান কমানো নয় বরং যাত্রীদের উন্নত সেবা নিশ্চিত করা তাদের অগ্রাধিকার। তবুও নিরাপদ গণপরিবহন হিসেবে বিবেচিত রেলের কাছ থেকে প্রত্যাশিত সেবা পাচ্ছেন না যাত্রীরা।

জীর্ণ বগি, নোংরা টয়লেট, ট্রেন ছাড়তে বিলম্ব, যাত্রাপথে বিলম্ব, স্টেশন ও প্ল্যাটফর্মে প্রয়োজনীয় সুবিধা না থাকা, টিকিট পেতে সমস্যা এবং নিরাপত্তার অভাবে জর্জরিত রেল সেবা। এক কথায় যাত্রীরা যেসব সেবা প্রত্যাশা করেন তার একটি বড় অংশই অপূর্ণ থেকে যায়। সেই সঙ্গে নিয়মিত লাইন ও ট্রেনের রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ঘটছে মারাত্মক দুর্ঘটনা।

যাত্রীদের এতো অসুবিধার মধ্যে রেলপথ মন্ত্রণালয় গঠনের অষ্টম বার্ষিকী উপলক্ষে বিশেষ সেবা সপ্তাহ শুরু করেছে রেল কর্তৃপক্ষ। সেবা সপ্তাহে ১০টি টাস্কফোর্স কাজ করবে, যারা টিকিট কালোবাজারিদের বিরুদ্ধে অভিযানের পাশাপাশি যাত্রীদের ভোগান্তির কারণগুলো সমাধানের চেষ্টা করবে।

বাংলাদেশ রেলওয়ে এবং মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত এই টাস্কফোর্স ট্রেনের সময়সূচী, টয়লেট এবং বগিগুলির অবস্থার দিকে বিশেষভাবে নজর রাখবে।

পূর্বাঞ্চল এবং পশ্চিমাঞ্চলে বিভক্ত বাংলাদেশ রেলওয়ে সারা দেশে ৩ হাজার কিলোমিটার রেলপথে ৩৬০টি যাত্রীবাহী এবং প্রায় ৩০টি মালবাহী ট্রেন পরিচালনা করে। বছর বছর যাত্রীর সংখ্যা বাড়লেও প্রত্যাশিত মানের সেবা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।

poor_service_in_train.jpg
ছবি: স্টার গ্রাফিক্স

যাত্রীদের অভিজ্ঞতা

পঞ্চগড় এক্সপ্রেসে ঢাকা থেকে দিনাজপুরে যাওয়ার জন্য গত শুক্রবার কমলাপুর স্টেশনে যান বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আবু সাদিক।

রাত ১২টা ১০ মিনিটে ট্রেনটি ছাড়ার কথা থাকলেও তা প্রায় আধা ঘণ্টা দেরিতে ছাড়ে। সকাল ৭টার দিকে ট্রেনটি বগুড়ার সান্তাহারে পৌঁছায়। যেখানে তার সাড়ে ৭টার মধ্যে দিনাজপুর পৌঁছানোর কথা ছিলো।

আবু সাদিক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, “ট্রেনটি দিনাজপুরের আগে শুধু পার্বতীপুর স্টেশনে থামার কথা থাকলেও, প্রায় প্রতিটি স্টেশনেই থামে। শেষ পর্যন্ত আমি সকাল সাড়ে ১০টায় দিনাজপুর পৌঁছেছি।”

সোমবার ঢাকায় ফেরার অভিজ্ঞতাও সুখকর ছিলো না বলে তিনি জানান। দিনাজপুর থেকে ৩টায় একই ট্রেনে রওনা দিয়ে রাত সাড়ে ১০টায় কমলাপুরে পৌঁছানোর কথা ছিলো তার। কিন্তু ঢাকার বিমানবন্দর স্টেশনে পৌঁছাতেই বেজে যায় রাত ১টা।

ট্রেনের ভেতরের অবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, “দীর্ঘ পথে খুব ক্লান্তিকর যাত্রা ছিলো। ট্রেনের সিট ও টয়লেট ছিলো নোংরা। সব জায়গায় তেলাপোকা ছিলো।”

তবে অনলাইনে টিকিট কেনায় সেই ভোগান্তিতে পড়তে হয়নি তাকে।

যেসব যাত্রী সময়মতো অনলাইনে টিকিট করতে ব্যর্থ হন তাদেরকে বাড়তি দাম দিয়ে কালোবাজারে টিকিট সংগ্রহ করতে হয়।

ঢাকায় কর্মরত জামালপুরের বাসিন্দা মোহাম্মদ জাহিদ বলেন, “বেশিরভাগ সময় আমাকে কালোবাজারিদের কাছে থেকে টিকিট কিনতে হয় এবং টিকিটের নির্ধারিত দামের চেয়ে ১০০ থেকে ৫০০ টাকা বেশি দিতে হয়।”

শুধুমাত্র তিস্তা এক্সপ্রেস ছাড়া জামালপুর-ঢাকা রুটে চলা সবগুলো ট্রেন প্রায় দুই ঘণ্টা দেরী করছে বলে যাত্রীরা অভিযোগ করেছেন।

মোহাম্মদ জাহিদ বলেন, “বগি ও টয়লেটের বেশিরভাগ সময়ই অপরিচ্ছন্ন থাকে। এ কারণে অনেক সময় টয়লেট ব্যবহার করাই সম্ভব হয় না।”

service_chart-1.jpg
ছবি: স্টার গ্রাফিক্স

বড় বিনিয়োগ, বড় লোকসান

অনেক বছরের অবহেলার পর, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর রেলওয়ে বর্ধিত বরাদ্দ পেতে শুরু করে।

বর্তমান বছরসহ শেষ পাঁচ অর্থবছরে সরকার বিভিন্ন উন্নয়ন ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রকল্পে রেলওয়ের জন্য ৫০ হাজার ১১৪ কোটি ৮৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। তবে রেল সূত্রগুলো জানায়, চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ওই বরাদ্দের ২৮ হাজার ৪৮৯ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয় করতে পেরেছে রেলওয়ে।

রেলওয়ের তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে ১৩৪ হাজার ৭৬৭ কোটি ৫১ লাখ টাকার ৩৬টি প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা অভিযোগ করেছেন, যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করা এবং দক্ষ জনশক্তি তৈরির পরিবর্তে রেললাইন ও স্টেশনসহ অবকাঠামোগত উন্নয়নে বেশি মনোনিবেশ করছে সরকার।

প্রতি বছর যাত্রীর সংখ্যা বাড়লেও রেল নিয়মিতভাবেই লোকসানের মুখে পড়ছে।

রেলওয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে লোকসান ৮৭২ কোটি ৮৪ লাখ, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১ হাজার ৩২৫ কোটি ২০ লাখ, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১ হাজার ৫৩১ কোটি ৭৬ লাখ এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরে লোকসান করেছে ১ হাজার ৪৩১ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। যা ২০১৮-১৯ অর্থবছরে লোকসান বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৭৩৮ কোটি ৩৭ লাখ টাকা।

সে হিসাবে গত পাঁচ বছরে মোট ৬ হাজার ৯০০ কোটি ৩ লাখ টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়েকে।

যদিও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তাদের যাত্রী সংখ্যা ছিলো ৭ কোটি ৭৮ লাখ। আর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে যাত্রীর সংখ্যা ছিলো ৯ কোটি ৫০ হাজার।

বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইন্সটিটিউটের পরিচালক পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মিজানুর রহমান এ অবস্থার জন্য পেশাদারিত্ব, দক্ষ জনবল এবং সঠিক তদারকির অভাবকে দায়ী করেছেন।

তিনি বলেন, “রেল কর্মকর্তাদের সদিচ্ছা এবং যথাযথ তদারকি পরিস্থিতি বদলে দিতে পারে।”

আরেকজন পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, “বর্তমান ব্যবস্থায় যাত্রীদের যথাযথ সেবা দেওয়া সম্ভব না। সরকারের উচিত বেসরকারি বিনিয়োগের অনুমতি দেওয়া।”

বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইন্সটিটিউটের সাবেক পরিচালক শামসুল হক বলেন, “সরকার প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি করতে পারে। তবে আপনি যদি মানসম্পন্ন সেবা চান, তাহলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। রেল কর্তৃপক্ষ কেবল তাদের তদারকি করবে।”

নিয়মিত লোকসানের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. শামসুজ্জামান বলেন, “রেলওয়ে একটি রাষ্ট্রীয় সংস্থা, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান নয়।”

“...ক্ষতি বা লাভ হতে পারে। আমরা যদি একে লাভজনক করতে চাই, তাহলে ভাড়া বাড়াতে হবে। আমাদের দেশে ট্রেনের ভাড়া অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় কম।”

তবে মহাপরিচালক বলেন, “লোকসানের পরিমাণ কমাতে যেসব জায়গায় দুর্বলতা রয়েছে, তা দূর করতে কাজ করা হবে।”

ট্রেন চলাচলে বিলম্বের বিষয়ে তিনি বলেন, “পূর্ব জোন বা পশ্চিম জোনের ভেতরের, যেমন খুলনা-রাজশাহী রুটে বিলম্বের অভিযোগ নেই।”

তবে তিনি স্বীকার করেছেন যে, ঢাকা থেকে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল এবং দক্ষিণ অঞ্চলে চলা বেশিরভাগ ট্রেনই বিলম্বে চলছে। এর জন্য তিনি মূলত জয়দেবপুর থেকে ঈশ্বরদী পর্যন্ত এক লাইনের রেলপথকে দায়ী করেছেন।

জয়দেবপুর থেকে ঈশ্বরদী পর্যন্ত ডাবল লাইন নির্মাণ এবং যমুনা নদীর ওপর নতুন একটি রেল সেতু তৈরির প্রকল্প ইতিমধ্যে হাতে নেওয়া হয়েছে বলেও তিনি জানান।

এছাড়াও, বঙ্গবন্ধু সেতুর ওপর দিয়ে ধীরে ট্রেন চলাচলকেও দেরী হওয়ার একটি কারণ বলে জানান মহাপরিচালক। গতকাল দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, “পরিস্থিতি বদলাতে সময় এবং বড় বিনিয়োগ লাগবে।”

শামসুজ্জামান আরও বলেন, “ট্রেনের টিকিটের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে বড় পার্থক্য রয়েছে, যার ফলে টিকিটের সংকট দেখা দেয়।”

টিকিটের কালোবাজারির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এমন অভিযোগ যদি তাদের সামনে আনা হয় এবং তাদের কর্মীরা জড়িত বলে প্রমাণিত হয় তবে তারা কঠোর ব্যবস্থা নেবেন।”

“ত্রুটিযুক্ত প্রক্রিয়ায়” ঠিকাদার নিয়োগের কারণে ট্রেনে খাবার সরবরাহের ক্ষেত্রে সমস্যার কথা মেনে নেন মহাপরিচালক। তিনি বলেন, “আমরা তাদের নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছি।”

শামসুজ্জামান বলেন, “তারা রেলের সেবার মান উন্নয়নে বেশ কয়েকটি প্রকল্প হাতে নিয়েছেন এবং এগুলি বাস্তবায়িত হলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে।”

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

10h ago