‘তাহলে কি বলা যায় বাকি ৭০ শতাংশ এই ভোট প্রত্যাখ্যান করেছেন?’

Syed Abul Maksud and Badrul Alam Majumdar
লেখক-গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ (বামে) ও নাগরিক সংগঠন ‘সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন’র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। ছবি: সংগৃহীত

কম ভোটার উপস্থিতি, ভোটার দেখাতে কৃত্রিম লাইন, বিরোধীদলকে ভোটকেন্দ্রে যেতে না দেওয়া, বের করে দেওয়া, ইভিএম মেশিনে জটিলতা, সেই জটিলতায় পড়েছিলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিজেই এসব ছিলো গতকালকের ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রধান সংবাদ। ঘোষিত হয়েছে বিজয়ী দুই মেয়রের নাম। নির্বাচন নিয়ে নগরবাসীর কোনো উৎসাহ-উদ্দীপনা দৃশ্যমান ছিলো না।

আজ দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনের কথা হয়েছে বিশিষ্ট লেখক-গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ ও নাগরিক সংগঠন ‘সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন’-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারের সঙ্গে।

সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেছেন, “আমার কাছে মনে হয়েছে, মানুষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলছে। নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতিও তাদের বিশ্বাস নেই। এ দেশের মানুষ খুবই গণতন্ত্র সচেতন। তারা গণতন্ত্রের জন্যে লড়াই করেছে, রক্ত দিয়েছে। এখন সেই অবস্থাকে এমন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, মানুষ এখন এর প্রতি আস্থা রাখতে পারছে না।”

“আমার ভোটের কোনো মূল্য নেই- এমন ভাবনা মনের মধ্যে আসন করে নিয়েছে। এটি গণতন্ত্রের জন্যে অশনি সংকেত। মানুষ ভোট দিতে যায়নি বা ভোট দিতে যায় না, বা ভোট দিতে যাওয়ার মতো পরিবেশ নেই। এর ফলে মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। এটি খুব ক্ষতিকর।”

মানুষের মনে কি কোনো ভয় ছিলো?- “হ্যাঁ। মানুষের মনে ভীতি সৃষ্টি করা হয়েছিলো। এটি প্রশাসনের পক্ষ থেকেও করা হয়েছে। একটি স্বাধীন দেশে, স্বাভাবিক পরিবেশে মানুষ তার পরিচয় সংক্রান্ত ‘দলিলপত্র’ নিয়ে ঘর থেকে বের হবেন কেন? ঢাকার বাইরে থেকে প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ ঢাকায় আসেন জীবিকার জন্যে। প্রশাসন অচেনা মানুষকে গ্রেপ্তার করার হুমকি দিবে কেনো? দিনাজপুরের মানুষ ঢাকায় আসবে, আর আপনি তাকে ‘বহিরাগত’ বলবেন কেনো? যারা এসব কথা বলছেন তাদের প্রায় সবাই তো ঢাকার বাইরে থেকেই ঢাকায় এসেছেন। রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে কেন্দ্র দখল- পাহারা দেওয়ার কথা বলা হবে কেনো? তার মানে, মারামারির আশঙ্কা করা হয়েছে? আমি মনে করি, এগুলো খুবই অন্যায় কাজ হয়েছে।”

“আমি ভোট দিতে গিয়ে বিরোধীদলের কাউকে দেখিনি। নির্বাচনে বিরোধীদলের অংশগ্রহণকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। এটি খুবই ক্ষতিকর কাজ হয়েছে। আমার বাসার সামনে কেন্দ্র ছিলো। কিন্তু, কোনো ভোটার ছিলো না। এটি গণতন্ত্রের জন্যে অশনি সংকেত।”

প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, ৩০ শতাংশের কম ভোট পড়েছে। তাহলে কি বলা যায় বাকি ৭০ শতাংশ এই ভোট প্রত্যাখ্যান করেছেন?- “ভোট না দেওয়ার মানে হচ্ছে জনগণ ভোটকে গুরুত্ব দেয়নি। ভোট না দিয়ে জনগণ ‘প্যাসিভ রেসিসটেন্স’ করেছে বলা যেতে পারে।”

প্রধান নির্বাচন কমিশনার আরও বলেছেন, বিরোধীদলের পোলিং এজেন্টদের ভোটকেন্দ্রে টিকে থাকার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে।– “বিরোধীদল কি মারপিট করবে? পেশীশক্তি দেখাবে টিকে থাকার জন্যে? আমি মনে করি, বিরোধীদলের পোলিং এজেন্টদের সংঘাত সৃষ্টি না করার বিষয়টিও এক ধরণের ‘প্যাসিভ রেসিসটেন্স’। নির্বাচনে সংঘাত যা হয়েছে তা সরকারি দলের লোকেরাই করেছে। এটা তাদের জন্যে লজ্জার।”

বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, “এই নির্বাচন নিয়ে মানুষের মধ্যে অনেক অস্বস্তি, উদ্বেগ এবং উৎকণ্ঠা ছিলো। বিশেষ করে, ইভিএম সম্পর্কে মানুষের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি দেখা গেছে। এর অনেক দুর্বলতা ছিলো। এখানে ওভাররাইট করা সম্ভব। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন যাই বলবে তাই বিশ্বাস করতে হবে। একই সঙ্গে, এই যন্ত্র যারা পরিচালনা করেছেন তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা ভীষণভাবে প্রশ্নের সম্মুখীন। আগের সিটি নির্বাচন ছিলো নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন। জাতীয় নির্বাচন ছিলো চরম জালিয়াতির নির্বাচন। এই জালিয়াতির ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা ছিলো এমন অভিযোগ রয়েছে।”

“এসব উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা নিয়ে এবারের সিটি নির্বাচন হয়েছে। আমরা তো এসব উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা দূর করতে পারিইনি, এটি আরও ঘনীভূত হয়েছে। ভোটর উপস্থিতির যে হার দেখানো হয়, ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার পর আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সঙ্গে তা মিলে না। অনেকের অভিযোগ- তাদেরকে ভোট দিতে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করা হয়েছে। অনেকে বলেছেন, তাদের ভোট অন্যরা দিয়ে দিয়েছে।”

“এছাড়াও, ভোটকেন্দ্রের বাইরে মহড়া ছিলো। এরও প্রভাব পড়েছে ভোটারদের ওপর।”

“নির্বাচন হলো একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু, এই নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এই নির্বাচন নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থা ভেঙ্গে যাওয়ার ক্ষেত্রে এটি আরও একটি পদক্ষেপ। এর পরিণতি অমঙ্গলকর।”

“নির্বাচনই শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা পরিবর্তনের একমাত্র পথ। এটি যদি ভেঙে যায় তাহলে আমরা মহাবিপদের দিকে ধাবিত হবো। এটি কারো জন্যেই কল্যাণ বয়ে আনবে না। এর মাসুল আমাদের সবাইকে দিতে হবে।”

এই নির্বাচন বিমুখতার দায়ভার কি জনগণকেও নিতে হবে?- “জনগণ তো পরিস্থিতির শিকার। ভিকটিমকে তো আপনি দায়ভার দিতে পারেন না। নির্বাচনী পরিবেশকে সঠিক করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের ও সরকারের। যারা এই দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছেন তাদের।”

“এদেশের মানুষ বিরাট লাইন করে ভোট দিয়ে পৃথিবীতে সুনাম পেয়েছে। নারীরাও দীর্ঘ লাইন ধরে ভোট দিয়েছেন। সেসব দৃশ্য গেলো কোথায়? নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থাহীনতার ফলেই এমন হয়েছে।”

Comments

The Daily Star  | English

Yunus promises election on time

Chief Adviser Prof Muhammad Yunus yesterday reaffirmed his commitment to holding the 13th national election in the first half of February next year.

8h ago