তালেবানের সঙ্গে চুক্তি: আমেরিকার আত্মসমর্পণ বা পালানোর পথ
ইতিহাসবিদরা আফগানিস্তানের নাম দিয়েছেন ‘সাম্রাজ্যবাদীদের গোরস্তান’। গত দেড়শ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আফগানিস্তানের মাটিতে পরাজিত হয়েছে তিন তিনটি পরাশক্তি। সেই তালিকার প্রথমে রয়েছে উপনিবেশিক ব্রিটিশ শক্তি, এরপর সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং সবশেষে মহাশক্তিশালী আমেরিকা।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আত্মঘাতী বিমান হামলায় নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর এর দায় পড়েছিল আফগানিস্তানে তালেবানদের আশ্রয়ে থাকা ওসামা বিন লাদেনের আল-কায়েদা জঙ্গি গোষ্ঠীর ওপর।
সেসময় তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লু বুশ জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে সদর্পে বলেছিলেন, ‘যারা আমাদের সঙ্গে থাকবে না তারাই আমাদের শত্রু।’ অর্থাৎ, যেসব রাষ্ট্র আফগানিস্তানে তালেবানদের বিরুদ্ধে আমেরিকার যুদ্ধে অংশ নিবে না তাদেরকেই আমেরিকার শত্রু হিসেবে গণ্য করা হবে!
এরপর মহাপ্রস্তুতি নিয়ে দারিদ্রপীড়িত আফগানিস্তানের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পরাশক্তি আমেরিকা ও এর মিত্র রাষ্ট্রগুলো। সারাবিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষের প্রতিবাদকে ‘বুড়ো আঙ্গুল’ দেখিয়ে পশ্চিমের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো তালেবান ধ্বংসের নামে বোমা ফেলতে শুরু করে গ্রামে-গঞ্জে-শহরে। জানাজা নামাজ ও বিয়ের অনুষ্ঠানের মতো ধর্মীয় ও সামাজিক জমায়েতেও মার্কিন ও মিত্রশক্তিদের বোমা ফেলতে থাকে। উদ্দেশ্য একটাই— তালেবান ধ্বংস।
২০০১ সালের ডিসেম্বরেই পশ্চিমের পরাশক্তিগুলো রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের মাধ্যমে কান্দাহারে তালেবান সরকারের পতন ঘটায়। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তালেবানরা আফগানিস্তানে ‘ধর্মীয় অনুশাসনের’ নামে যে অরাজকতা শুরু করেছিল, তা সারাবিশ্বকে নাড়া দিয়েছিল। রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে তালেবানদের পতনের পর আফগানদের জীবনে পরিবর্তন এসেছে বলে প্রচারণা চালিয়েছিল পশ্চিমা গণমাধ্যম। বাস্তবে ক্ষমতায় না থাকলেও আফগানিস্তানে তালিবানদের প্রভাব অব্যাহতই ছিল। তাদের নিয়ম অনুযায়ীই চলেছে আফগানিস্তানের অধিকাংশ এলাকা।
মিত্রশক্তির নতুন নতুন ধ্বংসাত্মক বোমা ও অস্ত্রের আঘাতে আফগানিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়লেও, তারা গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে থেকে যায় দেশটির রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে। পরাক্রমশালী আমেরিকার বিশাল শক্তির মুখে তালেবানরা তাদের সীমিত শক্তি নিয়ে ছড়িয়ে পড়ে সারা আফগানিস্তানে। দেশটিতে থাকা আমেরিকাসহ সব বিদেশি সৈন্যের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী হামলা চালাতে থাকে তালেবান ও তাদের সমর্থিত রাজনৈতিক ও ধর্মীয়গোষ্ঠীগুলো। এভাবেই কেটে যায় একে একে ১৮টি বছর।
যুদ্ধ শুরুর আগে আমেরিকাসহ সারা পৃথিবীতে উঠেছিল প্রতিবাদের ঝড়। শান্তিবাদী মানুষেরা বলেছিলেন, যুদ্ধ করে তালেবানদের ধ্বংস করা সম্ভব না। সেসময়ের সংবাদ বিশ্লেষণে উঠে এসেছিল আফগানিস্তানের মাটিতে ব্রিটিশ উপনিবেশিক শক্তি ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পরাজয়ের নানা চিত্র। সেসব কথায় কান দেয়নি মার্কিন প্রশাসন। তারা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ শুরু ও তা তালেবানদের ধ্বংস না করা পর্যন্ত চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই যুদ্ধে ডেকে আনে ইউরোপের মিত্রশক্তিগুলোকেও।
গত ১৮ বছরে আমেরিকা তালেবানদের ধ্বংস করা তো দূরের কথা তাদের কাছে ‘নতি স্বীকার’ করতে বাধ্য হয়েছে। তালেবান নেতাদের কাছে ডেকে মার্কিন প্রশাসন খুঁজে নিয়েছে আফগানিস্তান ছাড়ার পথ। ‘শান্তি’র পথেই যদি যুক্তরাষ্ট্র হাঁটতে চায় তাহলে কেনো ১৮ বছর যুদ্ধ চালিয়ে ধ্বংস করা হলো একটি দেশ বা একটি দেশের জনজীবন?
শান্তি চুক্তি, আত্মসমর্পন, না পালানোর পথ?
তালেবানদের বিরুদ্ধে ‘অপারেশন এনডিউরিং ফ্রিডম’ নামে যে যুদ্ধ শুরু করেছিল বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র আমেরিকা তা তাদেরকে চালিয়ে যেতে হয়েছে সুদীর্ঘ ১৮ বছর। যুদ্ধ চালিয়ে নিতে ২০১৯ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের খরচ হয়েছে ৯৭৫ বিলিয়ন ডলার।
জরিপ সংস্থা স্ট্যাটিস্টার বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে— আফগানিস্তান যুদ্ধে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মার্কিন সামরিক বাহিনীর ২ হাজার ৪৪১, যুক্তরাজ্যের ৪৪৫ এবং অন্য মিত্রদেশগুলোর ১ হাজার ১৪৪ জন নিহত হয়েছেন।
ঠিক কতোজন আফগান এই যুদ্ধে নিহত হয়েছেন সেই তথ্য সঠিকভাবে পাওয়া যায়নি। ২০০৯ সালে কাজ শুরু করা জাতিসংঘের অ্যাসিস্টেন্স মিশনের তথ্য মতে, গত ২০০৯ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানে ১ লাখের বেশি মানুষ হতাহত হয়েছেন।
গত ২২ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘ জানিয়েছে, আফগান যুদ্ধে শুধুমাত্র ২০১৯ সালে ৩ হাজার ৪০০ র বেশি বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন ৭ হাজারের মতো।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াটসন ইনস্টিটিউটের হিসাবে, আফগান যুদ্ধে ২০০১ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত নিহত হয়েছেন অন্তত এক লাখ ৫৭ হাজার জন। তাদের মধ্যে ৪৩ হাজারের বেশি বেসামরিক মানুষ।
এতো অর্থব্যয় ও রক্তপাতের পরও আফগানিস্তানের অধিকাংশ এলাকা রয়ে গেছে তালেবানদের নিয়ন্ত্রণে। আমেরিকা বা দখলদারদের জন্যে দেশটি পরিণত হয়েছে এক মৃত্যুপুরীতে। এমন পরিস্থিতিতে আফগানিস্তানে তালেবানদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের জয়ের কোনো আভাস দেখা যাচ্ছে না। তাই এই পরাশক্তির প্রয়োজন হয়েছে আফগানিস্তান ছাড়ার ‘সম্মানজনক’ সুযোগ।
১৯৭৩ সালে রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সন শান্তি চুক্তির মাধ্যমে ভিয়েতনাম থেকে মার্কিন দখলদার বাহিনীর সরে আসার ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই প্রসঙ্গ তুলে ধরে নিউইয়র্ক টাইমসের সংবাদ বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে নিক্সনের যেমন প্রয়োজন হয়েছিলো ভিয়েতনামে আমেরিকানদের পরাজয় ‘ঠেকানো’, তেমনি নির্বাচনের আগে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রয়োজন হয়েছে আফগানিস্তান থেকে ‘মানে মানে বেরিয়ে পড়ার’।
যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে যে যুদ্ধে জড়িয়েছে তার কোনো ‘শেষ নেই’— এমন মন্তব্য করেছেন ট্রাম্প। এই ‘শেষ নেই’ যুদ্ধের সমাপ্তি টানতে বা আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সৈন্য সরিয়ে নিতে গত শনিবার তালেবানদের সঙ্গে কাতারের দোহায় শান্তি চুক্তি করেছে আমেরিকা। এমন চুক্তিকে তালেবানদের কাছে আমেরিকার ‘আত্মসমর্পণ’ হিসেবেও বলা হয়েছে কোনো কোনো বিশ্লেষণে।
মার্কিন প্রশাসন তালেবানদের সঙ্গে সম্পাদিত শান্তি চুক্তি নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করলেও এ নিয়ে আফগানদের মধ্যে দেখা গেছে হতাশা-আক্ষেপ।
চুক্তি অনুসারে আমেরিকা ধীরে ধীরে সব সৈন্য ফিরিয়ে নিবে আফগানিস্তান থেকে। কিন্তু, গত ১৮ বছরে এই দেশটিতে যে অপরিসীম ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে তার কী হিসাব হবে? সেখানে এতো হত্যার দায় কে নিবেন? আফগানিস্তানকে কি আমেরিকা রেখে যাচ্ছে ধর্মান্ধ তালেবান গোষ্ঠীর হাতে? তাই যদি হয়, তাহলে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির শান্তিপ্রিয় মানুষের ভাগ্যে কী জুটবে?— এমন হাজারো প্রশ্ন উঠে আসছে গণমাধ্যমে।
Comments