‘সাদা অর্থনীতি থেকে কালো অর্থনীতিতে চলে যাচ্ছি’

ahsan h mansur
আহসান এইচ মনসুর। ছবি: সংগৃহীত

সরকারের আর্থিক নীতি কতোটা ব্যবসাবান্ধব? বিশেষ করে এসএমই বা ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্পের বাস্তবতা কী? নয়-ছয় সুদনীতির প্রভাব এসএমই সেক্টরে কতটা?— এসব নিয়ে আজ মঙ্গলবার দ্য ডেইলি স্টার অনলাইন কথা বলেছে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারপারসন আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে। তার মতে, সরকারের নীতির কারণে দেশের মানুষ সাদা অর্থনীতি থেকে সরে যাচ্ছেন কালো অর্থনীতির দিকে। তিনি আরও মনে করেন, সরকারের নীতিগুলো এসএমইর জন্যে ভয়ানক ক্ষতির কারণ হয়ে উঠছে।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘নয়-ছয় সুদের হার আমাদের আর্থিক খাতের ওপর বিধ্বংসী প্রভাব ফেলবে। দুটো জায়গায় এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। একটি হলো, ডিপোজিটের ওপর। অন্যটি হলো: এসএমই খাতের ঋণ-প্রবাহের ওপর।’

‘আমরা সবরকম হিসাব করে দেখেছি, এসএমই খাতে তিন শতাংশ স্প্রেডে ঋণ দেওয়া সম্ভব না। এখানে প্রতিটি ঋণেই লোকসান হবে। তাহলে সরকার কি তাদের ঋণ থেকে বঞ্চিত করবে? সেটা কি যুক্তিসঙ্গত হবে? এটা কি সরকারের গ্রোথ স্ট্র্যাটেজির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ? এটা কি আয় বৈষম্য বাড়িয়ে দিবে না? এটা কি জব ক্রিয়েশনকে থামিয়ে দিবে না? আমাদের চাকরির সুযোগ তো তৈরি হচ্ছে এসএমই সেক্টরেই। বড় জায়গায় তো চাকরির সুযোগ তৈরি হচ্ছে না। উল্টো সেসব জায়গা থেকে ছাঁটাই করা হচ্ছে।’

‘সরকারের এই নয়-ছয় সুদনীতি একেবারেই সেলফ ডেস্ট্রাকটিভ পরিকল্পনা।’

এই বিষয়গুলো কি সরকারকে আপনারা জানিয়েছেন?

‘আমরা তো গণমাধ্যমের মাধ্যমে সরকারকে অবহিত করি।’

সরকার কীভাবে এমন সেলফ ডেস্ট্রাকটিভ পরিকল্পনা নেয়?

‘আমি তো জানি না সরকারের সিদ্ধান্তগুলো কীভাবে হয়। যেটুকু বুঝি, সরকারের এমন সিদ্ধান্তের সময় কোনো অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞ মতামতকে মূল্যায়ন করা হয়নি। যেমন: ব্যাংক মালিক নয়, বরং যারা ব্যাংকার, যারা অর্থনীতি নিয়ে কাজ করেন এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিশেষজ্ঞ— তাদের সঙ্গে কথা বললে সবাই একই কথা বলবেন যে এটি (সুদনীতি) সেলফ ডেস্ট্রাকটিভ। তাদের মতামতকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে।’

কেনো ডেস্ট্রাকটিভ?

‘প্রথমত, একটি ব্যাংকের ব্যালেন্স শিট বাড়ে ডিপোজিটের মাধ্যমে। আমি মনে করি, ছয় শতাংশ সুদের কারণে ডিপোজিটের পরিমাণ ব্যাপক হারে কমে যাবে। এ কারণে ব্যাংক যদি ডিপোজিট হারিয়ে ফেলে তাহলে তাদের ব্যালেন্স শিট এক্সপানশন ক্ষমতা কমে যাবে।’

তাহলে আমানতের টাকাগুলো কোথায় যাবে?

‘টাকাগুলো ব্যাংকিং খাত থেকে বেরিয়ে যাবে। এ নিয়ে সবাই চিন্তিত। (অর্থ কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুক্ত) সেই ব্যক্তিরা এখনো সক্রিয় আছে। তাদের অনেককেই অনেক ব্যাংকের মালিক। এর মানে (অর্থ কেলেঙ্কারির) এই ধারা চলছে এবং চলবে!’

জনগণ তখন টাকা কোথায় রাখবে?

‘তাদের কেউ কেউ সঞ্চয়পত্রে রাখবেন। পাশাপাশি ‘শ্যাডো ব্যাংকিং’ ও এমএলএমে যাবে। সমিতির মাধ্যমে ‘শ্যাডো ব্যাংকিং’ আমাদের গ্রামদেশে সবখানেই আছে। এই ‘শ্যাডো ব্যাংকিং’ বেড়ে যাবে। আমরা সাদা অর্থনীতি থেকে কালো অর্থনীতিতে চলে যাবো। আমি ব্যাংকারদের অনেককে দেখেছি তারা টাকা “সমিতি”তে রাখছেন। তারা মনে করছেন, “কোনো সমস্যা তো হচ্ছে না”। তারা এতে খুশি।’

এটাতো ঝুঁকিপূর্ণ?

‘পুরোটাই রিস্কি। বাট দে আর টেম্পটেড। তারা টেম্পটেড কারণ, ওখানে রিটার্ন অনেক বেশি। সমিতিতে টাকা রাখার প্রবণতা অনেক বেশি বেড়ে যাবে। পরে, এক সময় এটা বুমেরাং হয়ে পুরো সমাজকে আঘাত করবে।’

‘ব্যাংকের লোকসানের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে— এসএমই সেক্টরটা ধ্বংস হয়ে যাবে। ব্যাংকিং সেক্টরতো ধ্বংস হওয়ার পথেই আছে। এটা ইতোমধ্যে কবরের পথে...।’

সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে জাতীয় অর্থনীতিতে এসএমইর অবদান ২৮ শতাংশ করার কথা বলছে। তাহলে বাস্তবতা কী?

‘এই অর্থমন্ত্রীর আমলে দুই দিক থেকে এসএমইর সর্বনাশ করা হচ্ছে। একটা হচ্ছে, ভ্যাট। কোনো বড় প্রতিষ্ঠান যদি কোনো ছোট প্রতিষ্ঠানকে সাব-কন্ট্রাক্টে কোনো কাজ দেয় তাহলে সেই বড় প্রতিষ্ঠানকে ১০ শতাংশ কর দিতে হবে। আবার ছোট প্রতিষ্ঠানটিকেও কর দিতে হবে। তখন বড় প্রতিষ্ঠানগুলো ছোট প্রতিষ্ঠানকে কোনো কাজ দিবে না। ফলে ছোট প্রতিষ্ঠান কাজ হারাবে। সব দেশেই বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মিলেমিশে এসএমইর বিকাশ হয়। মার্সিডিজ গাড়ির সব যন্ত্রাংশ এসএমইর মাধ্যমে তৈরি হয়। এখানে করারোপ করা হয় না।’

‘দ্বিতীয়টি হলো: নয়-ছয় সুদের হার করে এসএমইর অর্থায়ন বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ, প্রথমে কাজের অর্ডার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এরপর, অর্থায়ন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।’

‘যে বিষয়টি সরকার গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছে না তা হলো: এসএমই ঋণের জন্যে চলে যাবে ‘শ্যাডো মার্কেটে’।

তাহলে এসএমইর যে সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে?

‘সব হচ্ছে হগওয়াশ, ননসেন্স! আসলে ভ্যাট আরোপ ও অর্থায়ন বন্ধের মাধ্যমে সরকার এসএমই সেক্টরকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এরপর হয়তো মলম লাগানোর চেষ্টা করা হবে। কিন্তু, মারা হবে ছুরি, লাগানো হবে মলম— এতে রক্তক্ষরণ বন্ধ হবে না। এসএমইর আরও অনেক সমস্যা আছে। আমি এই প্রধান দুটি সমস্যার কথা বললাম।’

‘সরকারের নীতি এসএমইর জন্যে ভয়ানক ক্ষতিকর হয়ে গেছে। ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো কাজের অর্ডারও পাবে না, অর্থায়নও পাবে না তাহলে সেখানে প্রবৃদ্ধি আসবে কেমন করে?’

Comments

The Daily Star  | English

'Frustrated, Yunus hints at quitting'

Frustrated over recent developments, Chief Adviser Prof Muhammad Yunus is considering stepping down, said sources familiar with what went down at the Chief Adviser’s Office and Jamuna yesterday.

6h ago