নির্বান্ধব কুয়া থেকে স্বপ্নের সন্ধানে

করোনাভাইরাসের মহামারির ছোবলে পুরো বিশ্বই এই মুহূর্তে থমকে আছে। বন্ধ সব রকমের খেলাধুলা। এরকম এক ভয়াল সংকটের মাঝেও হয়ত সিলেটের স্বজনহারা কিশোরদের এই গল্প আপনাকে আশার গান শোনাতে পারে, অস্থির সময়ে দিতে পারে খানিকটা স্বস্তি।
ছবি: সংগ্রহ

করোনাভাইরাসের মহামারির ছোবলে পুরো বিশ্বই এই মুহূর্তে থমকে আছে। বন্ধ সব রকমের খেলাধুলা। এরকম এক ভয়াল সংকটের মাঝেও হয়ত সিলেটের স্বজনহারা কিশোরদের এই গল্প আপনাকে আশার গান শোনাতে পারে, অস্থির সময়ে দিতে পারে খানিকটা স্বস্তি।

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে শেষ ওয়ানডের আগের দিন। অধিনায়কত্ব থেকে মাশরাফি বিন মর্তুজার সরে দাঁড়ানোর ঘোষণায় সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম সেদিন ছিল উত্তপ্ত। সবাই ব্যস্ত তাকে নিয়েই। মাইল তিনেক দূরে মাশরাফি মতো বড় হওয়ার স্বপ্নে কঠোর অনুশীলনে তখন স্বজনহারা কয়েকজন কিশোর। সন্ধ্যার নিভু নিভু আলোয় তাদের ব্যাট বল থেকে বেরুচ্ছিল নির্বান্ধব পৃথিবীর যাবতীয় বঞ্চনা ঠেলে সরিয়ে উঠে দাঁড়ানোর আকাঙ্ক্ষা।

সিলেট সরকারি শিশু পরিবার ক্রিকেট ও ফুটবল দলের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার কথা ছিল দুপুর থেকেই। কিন্তু মাশরাফির আকস্মিক ঘোষণা এবং এই নিয়ে হুলুস্থুল পরিবেশে দুপুর নিমেষেই হয়ে যায় সন্ধ্যা। তাদের বর্ধিত অনুশীলনেরও তখন শেষ সময়। 

সিলেটের বাগবাড়ির বৃক্ষরাজির মাঝে দাঁড়ানো পুরনো-জীর্ণ ভবনে শিশু পরিবারের বালক শাখার ১৭০ জনের আবাসন। এদের প্রত্যেকেই স্বজনহারা। বাবা পৃথিবীতে বেঁচে নেই কারোরই, কারো কারো মা আছেন কিন্তু হতদরিদ্র অবস্থায় সন্তান প্রতিপালনে তারা অক্ষম। কারোও  আবার বাবা-মার নাম ঠিকানা কিছুই জানা নেই। তাদের আশ্রয় হয়েছে সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রতিষ্ঠানে। 

খাওয়া, পরা আর পড়াশোনার সুযোগ। সরকারের পক্ষ থেকে এই-ই ব্যবস্থা। এসব জায়গায় থেকে খেলাধুলা করা বা খেলোয়াড় হওয়ার স্বপ্ন বোনা ভীষণ মুশকিল। তবে দেশের ৮৫টি শিশু পরিবারের মধ্যে কেবল সিলেট শাখার কিশোররা সেই স্বপ্ন এখন বেশ ভালোভাবেই দেখতে পারেন। তাদের যে তৈরি হয়েছে সুযোগ, মিলেছে প্লাটফর্ম, ডানা মেলছে স্বপ্নও।

বাংলাদেশ-জিম্বাবুয়ের সিরিজের মাঝেই তাই অন্যরকম তাড়নায় খেলায় মগ্ন কিশোরদের সঙ্গে হলো আলাপ। পৌঁছুতেই ম্যানেজার ও সাংবাদিক কাইয়ুম আল রনি অনুশীলন থামিয়ে সবাইকে ডাকলেন। নেটে ব্যাটিং তখনো যেন শেষ হচ্ছে না ক্রিকেট দলের অধিনায়ক লুৎফুর রহমান জিয়ার। এবার স্কুল ক্রিকেটে বেশ নাম কুড়িয়েছে জিয়া। খুব ছোটবেলায় পিতৃহীন হওয়ার পর মা তাকে এখানে রেখে যান। নির্বান্ধব পরিবেশ, শৈশব কাটা পড়ে কুয়োর মধ্যে আটকে গিয়েছিল। কুয়ো থেকে বেরিয়ে সেই জিয়া এখন আলোয় ঝলমল, ‘কোনদিন ভাবিনি এরকম ক্রিকেট খেলব। এখন মনে হচ্ছে বড় কিছু একটা হওয়ার সুযোগ আছে। ক্রিকেট আমার সবচেয়ে আনন্দের জায়গা। দেখি কি হয়।’

জিয়ার হাসির ঝিলিকের পাশেই দাঁড়ানো ইকবাল আহমেদ। ছোটবেলায় বাবাকে হারানো ইকবালেরও আশ্রয় হয়েছে এখানে।  ফুটবল দলের অধিনায়ক ইকবাল সিলেট বিভাগের শতাধিক দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে বাছাই করা ২৫ জনের ক্যাম্পে সুযোগ পেয়েছে। পর্তুগালে কিশোরদের এক টুর্নামেন্টে খেলতে যাওয়ার সুযোগও তার সামনে। ইকবালের স্বপ্ন এখন বিশাল, ‘ছোটবেলা থেকে আমরা এখানে এমনি খেলতাম। এখন তো আমাদের দল আছে। লিগ খেলার সুযোগ পাচ্ছি। স্বপ্ন আছে বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলব।’

রবিউল হাসান আবার ক্রিকেট, ফুটবল দুই খেলাতেই পটু।  স্বজনহারা হয়ে তারও এখানে আসা ৭-৮ বছর বয়েসে। এবার স্কুল ক্রিকেটে শিশু পরিবারকে একাধিক ম্যাচ জেতানোর নায়ক। বয়সভিত্তিক বিভাগীয় দলে খেলার হাতছানি আছে। আবার একইসঙ্গে ফুটবলের বাছাই করা ২৫ জনের ক্যাম্পেও মিলেছে ডাক। স্বজনহারা রবিউল আগামীর সম্ভাবনায় উদ্বেল, , ‘ক্রিকেট-ফুটবল দুটোই খেলি, তবে ইচ্ছা আছে বড় ফুটবলার হওয়ার।’

আল-আমিনের বয়স প্রায় ১৪ বছর। ১৪ বছর ধরেই সে এখানকার বাসিন্দা। অন্যদের বাবা, মার হদিশ থাকলেও আল-আমিনের জানা নেই এর কিছুই। শিশু পরিবারের গণ্ডিই তার পৃথিবী। ঈদ এলে আল-আমিনের মতই আরও অনেকের বাড়ি যাওয়ারও কোন উপায় থাকে না। বাড়িই যে নেই। দুঃখ ভোলার জন্য আল-আমিনের কাছেও ধরা দিয়েছে ব্যাট-বল, ‘এইটাই আমার ঘরবাড়ি, আগে খেলার সুযোগ ছিল না। এখন খেলি, খেলতে ভালো লাগে, কপালে থাকলে খেলোয়াড় হবো।’ 

জিয়া, ইকবাল, আল-আমিনদের খেলার স্বপ্ন গেঁথে দিয়েছে সিলেটের স্পোর্টস ব্র্যান্ড এসএনপি স্পোর্টস। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার পাপলু দত্ত সিলেট বিভাগীয় দলের হয়ে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট খেলেছেন। তিনি জানালেন শুরুর গল্প,  ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে যেতাম ওখানে, তাদের সঙ্গে সময় কাটাতাম। যেহেতু ক্রিকেটের সঙ্গে ছিলাম, এক সময় চিন্তা ছিল ক্রিকেট একাডেমি করব। কিন্তু ওদের সঙ্গে মিশেই ভাবলাম প্রথাগত ক্রিকেট একাডেমি না, স্বজনহারা এসব ছেলেদের নিয়েই কাজ করতে হবে। তাদের খেলোধুলার প্লাটফর্ম করে দিতে হবে।’

সেই চিন্তা থেকেই কোচ নিয়োগ করে শুরু হয় অনুশীলন। ক্রিকেটে সম্মানী ছাড়াই এখানে কোচিং করান শামীম আহমেদ, ফুটবলের কোচ দুলাল হোসেনও নামমাত্র সম্মানিতে দিচ্ছেন সময়।  তাদের স্পর্শে বছরখানেকের মধ্যেই মিলে ফল। এবছর প্রথমবার জাতীয় স্কুল ক্রিকেটে অংশ নিয়ে জেলা পর্যায়ের ফাইনালে উঠে যায় শিশু পরিবার। অল্পের জন্য শিরোপা হাতছাড়া হলেও সিলেটের ঐতিহ্যবাহী বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে হারিয়ে দেয় তারা। অলক কাপালি, রাজিন সালেহ, আবু জায়েদ রাহিরারা যে প্রতিষ্ঠান থেকে উঠে এসেছিলেন, সেই এইডেড হাইস্কুলকে হারায় তারা, হারায় ব্লু বার্ড উচ্চ বিদ্যালয়, সরকারি পাইলট স্কুলকেও।

পাপলু জানান, এসব ছেলেদের খেলোয়াড় বানাতে বার্ষিক বাজেট রেখেছেন তারা। তৈরি করেছেন এসএনপি স্পোর্টস অ্যান্ড সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজেশন নামের সংগঠন। তাদের ক্রীড়া সামগ্রীর প্রতিষ্ঠান থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে ব্যাট-বল। প্রায় প্রতিদিন নতুন বল দিয়ে হয় অনুশীলন, সপ্তাহে দুদিন আয়োজন হয় ম্যাচ।

সমাজসেবা অফিসের উপ-পরিচালক নিবাস রঞ্জন দাশ ছেলেদের খেলার আগ্রহ দেখেই স্বেচ্ছসেবি কোচ খুঁজছিলেন, কোচ তো মিলেছেই, স্থায়ী এক রূপই নিয়ে নিয়েছে তা, ‘বিষয়টা এরকম ছিল, আমাদের শিশুরা খেলছে। কিন্তু সেই খেলাটা ছিল উদ্দেশ্যহীন, অপরিকল্পতি। এতে কেবল সময় নষ্টই হচ্ছে। স্কিল ডেভোলাপ হচ্ছে না। আমি একজন কোচ খুঁজছিলাম। কিন্তু এসএনপি এসে সব দায়িত্ব নিয়ে নিল। এটা অব্যাহত থাকবে।  আমি শিশু পরিবার বালিকা শাখাকেও স্পোর্টসে নিয়ে আসার কথা ভাবছি।’

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

6h ago