‘বিজ্ঞপ্তি’ প্রকাশ ও প্রত্যাহারের গল্প

বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো পর্যবেক্ষণ করা কি করোনাভাইরাস মোকাবিলার একটি উপায়?

বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো পর্যবেক্ষণ করা কি করোনাভাইরাস মোকাবিলার একটি উপায়?

যে কর্মকর্তা এই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছেন আমরা তার নিন্দা করছি এবং যিনি এটি প্রত্যাহার করেছেন তার প্রশংসা করছি। কিন্তু, প্রশ্ন হচ্ছে এটা কেন করতে হলো?

পুরো বিশ্ব করোনাভাইরাস মহামারি নিয়ে আতঙ্কিত। আমাদের দেশও ভাইরাসটি মোকাবিলা করা নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। যখন সরকারের প্রতিটি বিভাগ এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুতিতে আছে (আশা করছি), তখন তথ্য মন্ত্রণালয় কি এভাবে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রস্তাব দিয়েছিল?

গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তথ্য মন্ত্রণালয় একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। করোনাভাইরাস নিয়ে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো কোনো ভুল তথ্য বা গুজব প্রচার করছে কি না তা পর্যবেক্ষণে একটি ‘সেল’ গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয় এতে। যদি কোনো চ্যানেল ভুল তথ্য বা গুজব প্রচার করে তাহলে মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তৎক্ষণাৎ সেই অনুষ্ঠান সম্প্রচার বন্ধ করবে ‘সেল’।

মন্ত্রণালয়ের চার অতিরিক্ত সচিব ও ১১ উপ-সচিবের প্রত্যেককে দুটি করে চ্যানেল পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। বিজ্ঞপ্তিটি প্রকাশের কয়েক ঘণ্টা পরই তা প্রত্যাহার করা হয়েছে।

প্রথমেই আমার মনে প্রশ্ন জেগেছে, এই ১৫ কর্মকর্তা কীভাবে পর্যবেক্ষণ করবেন? কোনটি ‘ভুল তথ্য’ ও কোনটি ‘গুজব’ তা তারা কীভাবে শনাক্ত করবেন? তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার মানদণ্ড কী হবে? এমন কি কোনো সাধারণ সংজ্ঞা আছে যা দিয়ে বোঝা যাবে কোনটি ‘ভুল তথ্য’ বা ‘গুজব’। তারা কীভাবে ‘ব্রেকিং নিউজ’ নিয়ন্ত্রণ করবেন?

এই কর্মকর্তাদের যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তা বাস্তবায়ন কার্যত অসম্ভব। আমদের আশঙ্কা এটা বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর কাজে আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপ বাড়িয়ে তুলবে এবং চ্যানেলগুলোর নিয়মিত কাজ ব্যাহত করবে।

বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে এমন নজরদারি কেন প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল? তথ্য মন্ত্রণালয়কে কেন এত তাড়াহুড়ো করে এই নজরদারি শুরু করতে হয়েছিল? আমাদের বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো কি ভিত্তিহীন সংবাদ প্রচার করে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে? তথ্য মন্ত্রণালয় কি এমন দায়িত্বহীন রিপোর্টের উদাহরণ উদ্ধৃত করতে পারে যার জন্য এই নজরদারির প্রয়োজন হতে পারে?

তাহলে কেন ‘নজরদারি’র সিদ্ধান্ত? এটা মিডিয়াকে অবিশ্বাস করা এবং মিডিয়ার ইতিবাচক ভূমিকাকে দেখতে ও স্বীকার করতে না চাওয়ার প্রবণতা ছাড়া আর কিছু নয়। উদাহরণ হিসেবে ধরা যায়, বর্তমান করোনাভাইরাস সংকটের কথাই। আমাদের সব টেলিভিশন চ্যানেল সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান এবং এ সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয় ২৪ ঘণ্টাই প্রচার করছে। একই কাজ করছে প্রিন্ট ও ডিজিটাল মিডিয়াও। আমরা বিনীতভাবে দাবি করি, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, ডেঙ্গুর মতো সব প্রাকৃতিক সঙ্কটে মিডিয়া সবসময় প্রশংসনীয় ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে।

মন্ত্রণালয়ের অবশ্যই জানা উচিত, আমরা সাংবাদিক হিসেবে শত শত তথাকথিত ‘সংবাদ’ পাই। আমরা কি তার সব সম্প্রচার বা প্রকাশ করি? অবশ্যই না। প্রতিটি সংবাদ প্রকাশের আগে আমরা যাচাই করে ও নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে সত্যতা নিশ্চিত করে নেই। কোনো ঘটনা যথাযথভাবে নিরীক্ষার পর প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত হলে পেশাদার সাংবাদিকরা তা লিখেন এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সাব-এডিটররা তা সম্পাদনা করেন। এই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হওয়ার পরেই কেবল একটি ঘটনা সম্প্রচারিত এবং প্রকাশিত হয়।

টেলিভিশন চ্যানেলগুলো যখন কোনো অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে, সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিয়েই করে। এমনকি, আইন অনুযায়ী অসত্য বা ভুল সংবাদ প্রকাশের দায় মিডিয়ার। প্রতিটি চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতিতে আমাদের বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর সামগ্রিক দায়িত্বশীল এবং পেশাদার কাজের আমি সাধুবাদ জানাই। এ জাতীয় ‘মনিটরিং সেল’ গঠন ও বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর প্রতিদিনের কার্যক্রমে হস্তক্ষেপের ক্ষমতা দেওয়া স্বাধীন গণমাধ্যমনীতি বিরোধী।

অসত্য তথ্য ও গুজব ছড়ানো হয় মূলত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। কয়েকটি ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে রামু (২০১২), পাবনা (২০১৩), ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর (২০১৬), রংপুর (২০১৭) এবং ভোলায় (২০১৯) সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি তৈরি করে বাংলাদেশে বিপর্যয় সৃষ্টি করা হয়েছিল। এই ধরনের বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করা উচিত সরকারের এবং যতদূর আমরা জানি তা হচ্ছে। এসব ঘটনা যে দুর্ঘটনা নয় এবং একটি স্বার্থান্বেষী মহল এসব ঘটিয়েছে তা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে। আজ পর্যন্ত তাদের কতজনকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে?

আমি আবারও বলছি, বাংলাদেশের মূলধারার মিডিয়াগুলোর বেশিরভাগ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পেশাদারদের মাধ্যমে পরিচালিত হয় এবং ‘মনিটরিং সেল’ স্থাপনের প্রয়োজন হয় এমন কিছু খুব কমই সম্প্রচার বা প্রকাশ করে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ করার বাধ্যবাধকতা থাকায় আমাদের কাজে অনেক সময় অনিবার্য ত্রুটি হয়ে যায়। এটা স্বীকার করতে আমরা কখনও পিছপা হইনি। এসব ত্রুটি সংশোধন করার জন্য প্রচলিত পদ্ধতি আছে এবং আমরা যখন কোনো ভুল করি তখন তা সেই পদ্ধতিতেই সবাইকে জানিয়ে দেই।

‘মনিটরিং সেল’ গঠনের পরিবর্তে তথ্য মন্ত্রণালয়কে ‘সহযোগিতার চেষ্টা’ চালানোর পরামর্শ দিচ্ছি। তথ্যমন্ত্রীর উচিত প্রিন্ট, টেলিভিশন ও ডিজিটাল মিডিয়ার সঙ্গে বসা এবং এই চ্যালেঞ্জিং সময়ে কীভাবে সবাই মিলে দেশকে সবচেয়ে ভালো কিছু দিতে পারি তা নিয়ে এক সঙ্গে কাজ করা। আমরা এই কাজটি ইতোমধ্যে নিজেরাই করছি। আমরা যে কোনোভাবে সরকারকে সহযোগিতা করতে সানন্দে প্রস্তুত।

আমাদের নিজস্ব নীতি থেকে এবং আমাদের দর্শক ও পাঠকদের কাছে আমাদের বিশ্বাসযোগ্যতা বজায় রাখতে ‘সংবাদ’ হিসেবে ভুল তথ্য বা গুজব প্রচারিত বা প্রকাশিত হওয়ার বিষয়ে আমরা অনেক বেশি উদ্বিগ্ন ও সচেতন। আমাদের উপর কোনো নজরদারির প্রয়োজন নেই। বরং এই ধরনের ব্যবস্থা ভিন্ন ধরনের পরিস্থিতি তৈরি করবে। মিডিয়া ও সরকারকে দাঁড় করিয়ে দিবে বিপরীতমুখী অবস্থানে। যেখানে আমাদের এক সঙ্গে কাজ করা দরকার।

পোস্ট স্ক্রিপ্ট

কয়েকদিন আগে, দুই জেলার দুই সরকারি কলেজের শিক্ষককে বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে  সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হলো। তাদের একজন সহকারী অধ্যাপক ও একজন প্রভাষক। তাদের অপরাধ কী ছিল? তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, তারা অনভিপ্রেত ও উস্কানিমূলক বক্তব্য ফেসবুকে পোস্ট করেছেন। বিভাগীয় তদন্তের প্রতি অসম্মান না করে আমরা জানতে চাই সরকারি চাকুরিজীবীরা তাদের বাকস্বাধীনতার মৌলিক অধিকারের কতটা আত্মসমর্পণ করেছেন? পোস্ট দুটি পড়ে আমাদের মনে হয়েছে সেখানে সরকারের বিরুদ্ধে কিছুই বলা হয়নি। একটিতে সাধারণ দুর্নীতির বিরুদ্ধে এবং অপরটিতে স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম না পাওয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছিল। কোনটিতেই সরকারের সমালোচনা করা হয়নি। কিন্তু তারপরও দুজনকেই সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে। আমাদের দুটি মতামত:

১. সরকারের পক্ষে কি এভাবে ব্যক্তিগত মতামত দমন করা ভালো? সরকারি চাকরি বিধি কি দেশকে ভালোবেসে কোনো প্রকার উদ্বেগ প্রকাশ করা থেকে শিক্ষিত পেশাদারদের বিরত থাকতে নির্দেশ করে? যেখানে তারা দুজনই শিক্ষক, আমলা নন।

২. সাময়িক বরখাস্তের পরিবর্তে যথাযথ ব্যাখ্যা চাওয়া যায় না?

কেন পারস্পরিক সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি না করে, ব্যবস্থা নেওয়া বা ‘শাস্তি’ দেওয়ার প্রবণতা এত বেশি গুরুত্ব পায়?

Comments

The Daily Star  | English

Over 5,500 held in one week

At least 738 more people were arrested in the capital and several other districts in 36 hours till 6:00pm yesterday in connection with the recent violence across the country.

14h ago