প্রকৃতির এই পরিবর্তন কতদিন?
সিঙ্গাপুর ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি অ্যান্ড ডিজাইনের (এসইউটিডি) ডেটা ড্রাইভেন ইনোভেশন ল্যাবের গবেষকেরা একটি বিশাল আশার সংবাদ শুনিয়েছেন। বলেছেন, প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মে মাসের মধ্যে শেষ হচ্ছে। বাংলাদেশ এ ভাইরাসটি ১৯ মের মধ্যে ৯৭ শতাংশ, ৩০ মে মধ্যে ৯৯ শতাংশ বিলীন হয়ে যাবে। আর সারা বিশ্ব থেকে করোনা পুরোপুরি বিদায় নিতে পারে ৮ ডিসেম্বরের মধ্যে। অস্বীকার করার উপায় নেই, এ মুহূর্তে সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে এটিই সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত সংবাদ।
পৃথিবী নামে এই গ্রহবাসীর জন্য আরেকটি বিশাল সুখবর দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। ইইউর পক্ষ থেকে কোপারনিকাস অ্যাটমসফিয়ার মনিটরিং সার্ভিস (সিএএমএস) ও কোপারনিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিস (সি৩এস) জানিয়েছে, বরফে ঢাকা উত্তর মেরুর আকাশে ওজন স্তরে ১০ লাখ বর্গ কিলোমিটারের যে বিশাল গর্ত সৃষ্টি হয়েছিল, সেটি নিজে নিজেই সারিয়ে তুলেছে। এই বিশাল গর্তটি নিয়ে বড় ধরনের বিপদের আশঙ্কা করা হচ্ছিল। কেননা উত্তর মেরুর আর্কটিক অঞ্চলের আকাশে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা হঠাৎ কমে যাওয়ায় সেখানকার পোলার ভর্টেক্স বা মেরু ঘূর্ণাবর্ত অনেকটাই স্থিতিশীল হয়ে পড়ে। সেইসঙ্গে অঞ্চলটিতে বায়ুমণ্ডলে ক্লোরিন ও ব্রোমিনের মতো বিষাক্ত কেমিক্যালের উপস্থিতিও বেড়ে যায়, যা ওজন স্তরকে নষ্ট করে দিতে সক্ষম। তবে ধারণা করা হচ্ছে, করোনাভাইরাসের কারণে সারা পৃথিবীর উৎপাদন-শিল্পায়ন ও ভোগবিলাসের চাকা স্থবির হয়ে পড়ায় পৃথিবীর পরিবেশ প্রকৃতি যে বিশ্রামের সুযোগ পেলো, তারই ফল এই ওজন স্তরের গর্ত ভরাট।
করোনা আক্রমণের পরে পরিবেশ-প্রকৃতি বদলে যাওয়ার এরকম আরও অনেক খবর গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে। এমনকি আপনি যদি পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত নগরী ঢাকা শহরের বাসিন্দাও হয়ে থাকেন, তাহলে সাম্প্রতিক সময়ে এই শহরের পরিবেশ বদলে যাওয়ার দৃশ্যটি আপনার চোখেও ধরা পড়েছে। কোথাও দূষণ নেই। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার মানুষও এখন ভোরবেলা পাখির কিচিরমিচির শোনে। এসবই করোনার ‘আশির্বাদ’। তবে এর বিনিময়ে সারা পৃথিবীতে অনেক মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে এবং হয়তো আরও অনেকের প্রাণ যাবে। অর্থাৎ অনেক মানুষের প্রাণের বিনিময়ে আমাদের ধরিত্রীমাতা একটু বিশ্রামের সুযোগ পেল। তার ওপর পৃথিবীর মানুষ প্রতিনিয়ত যে অত্যাচার ও নির্যাতন চালায়, সেটি কিছুদিন বন্ধ থাকায় পৃথিবী একটু শান্তিতে নিঃশ্বাস নিতে পারল। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তার এই শান্তির ঘুম বা বিশ্রাম কতদিন? যে ওজনস্তর ভরাটের কথা বিজ্ঞানীরা বলেছেন, সেখানে গর্ত সৃষ্টি হতে খুব বেশি কি সময় লাগবে? যে পাখিদের কিচিরমিচির কিংবা যে সমুদ্র সৈকতে বহুদিন পরে ডলফিনের দেখা মিলল, যে জনপদে বহু বছর পরে মানুষেরা হরিণের ছোটাছুটি দেখল, সেই দৃশ্য শূন্যে মিলিয়ে যেতে খুব বেশিদিন কি লাগবে?
কেননা পরিবেশ প্রকৃতির আশাব্যঞ্জক নানা খবরের পাশাপাশি পত্রিকা-টেলিভিশন ও সোশ্যাল মিডিয়ায় খেয়াল করলে দেখা যাবে, মানুষের আচার-আচরণে কোথাও কোনো পরিবর্তনের ইঙ্গিত নেই। একটি অদৃশ্য ভাইরাস সারা পৃথিবীর মানুষকে গৃহবন্দি করে ফেললেও, পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর মানুষটিকেও মৃত্যুচিন্তায় বিভোর করে দিলেও, মানুষের রিরংসা, লোভ, ক্ষমতার মোহ—কোনো কিছুই থেমে নেই। মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোয় আপাতত বোমার শব্দ নেই। কিন্তু করোনা চলে গেলে আবার সেখানে যে বোমাবাজি শুরু হবে না, হাজার হাজার নিরীহ মানুষের রক্তে ধূসর জমি রক্তাক্ত হবে না, তার নিশ্চয়তা কেউ দেয়নি।
করোনাভাইরাস সারা পৃথিবীর অর্থনীতিই ভয়াবহ চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছে। বলা হচ্ছে, বহু মধ্যবিত্ত যারা বেসরকারি খাতে চাকরি করতেন, ছোট ও মাঝারি ব্যবসা করতেন, তাদের মধ্যে যারা চাকরি হারিয়েছেন, মূলধন হারিয়েছেন, তারা মধ্যবিত্তর কাতার থেকে নিম্নবিত্তে নেমে আসবেন। বহু উচ্চবিত্তকে নতুন করে অনেক কিছু ভাবতে হবে। তবে দিনমজুরদের কাজের হয়তো অভাব হবে না। কিন্তু যে শিল্পায়নের চাকা এখন স্থবির, সেটি তো নতুন করে আবার চালু হবে। উন্নয়ন আর প্রবৃদ্ধির নামে করোনাপূর্ব পৃথিবীতে প্রাণ প্রকৃতি ধ্বংস করে যেরকম নির্লজ্জ আর বেপরোয়া কর্মকাণ্ড চলেছে, করোনাউত্তর পৃথিবীতে যদি সেভাবেই আবার সবকিছু শুরু হয়, তাহলে বুঝতে হবে, এই করোনাভাইরাস থেকে পৃথিবীর মানুষ কিছুই শিখল না, বরং মাঝখান দিয়ে প্রাণ দিতে হলো অসংখ্য মানুষকে।
গবেষকদের দাবি অনুযায়ী, আসলেই মে মাসের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে কি না, অথবা ডিসেম্বরেও পুরোপুরি স্বাভাবিক হবে কি না, তা হয়তো সময়ই বলে দেবে। কিন্তু ধীরে ধীরে পৃথিবীকে সচল করার উদ্যোগ নিতে হবে। কল-কারখানা সীমিতি পর্যায়ে এরইমধ্যে চালু হয়েছে। বিভিন্ন দেশে লকডাউন শিথিল করা হচ্ছে। রোজার ঈদ সামনে রেখে সবকিছু যতটা সম্ভব চালু করার চেষ্টা থাকবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, মানুষের নিরবতার কারণে যে প্রকৃতি সরব হয়ে উঠেছিল, মানুষের গৃহবন্দিত্বের কারণে যে হরিণেরা বন থেকে রাস্তায় ছুটে এসেছিল, দূষণ না থাকায় যে ডলফিনেরা সৈকতে চলে এসেছিল, পৃথিবীর উষ্ণায়নের জন্য দায়ী পরিবেশবৈরী উন্নয়নকর্মকাণ্ড স্থবির থাকায় যে ওজন স্তরের গর্ত ভরাট হয়ে গেলো—সেই পরিস্থিতি আসলে কতদিন টিকবে?
সাত শ কোটি মানুষ যদি আবারও করোনাপূর্ব পৃথিবীর মতোই আচরণ করে, যদি উন্নয়ন-প্রবৃদ্ধি আর ভোগবাদিতার জন্য তারা প্রাণ প্রকৃতি ধ্বংস করে পুনরায় উন্মত্ততা আর বেলেল্লাপনায় মেতে ওঠে, তার চেয়ে লজ্জার কিছু হবে না। অতএব বিশ্বনেতাদের ঠিক করতে হবে, তারা করোনউত্তর পৃথিবীকে কেমন দেখতে চান। উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনতে হবে। ভোগবাদিতার অবসান ঘটিয়ে জীবন-যাপনে পরিবর্তন আনতে হবে। এই ভাইরাস যেমন মানুষ থেকে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে, এখান থেকেই শিক্ষা নিতে হবে, আগামীর পৃথিবীর মানুষেরা কীভাবে পরস্পরের সঙ্গে আরও বেশি যুক্ত হতে পারে। কীভাবে তারা আরও বেশি মানবিক ও সংবেদনশীল হতে পারে। কীভাবে তারা অন্যের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। কীভাবে পৃথিবী নামক এই গৃহটিকে আরেকটু ভালো রাখা যায়; ওজনস্তরে যেন আর গর্তের সৃষ্টি না হয়, ডলফিন ও হরিণের সঙ্গে মানুষ যেন যুথবদ্ধভাবে বসবাস করতে পারে, প্রকৃতির সন্তানেরা যেন মানুষের উন্মত্তরা শিকার না হয়, সেরকম একটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান তৈরির দিকেই আমাদের নজর দিতে হবে।
আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, রংধনু টেলিভিশন।
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)
Comments