কয়রার ছবিটা আপনি দেখেছেন?

গতকাল পানিতে দাঁড়িয়ে ঈদের নামাজ আদায় শেষে মোনাজাত ধরেছেন খুলনার কয়রা উপজেলার বাসিন্দারা। ছবি: স্টার

হাঁটুসমান পানিতে দাঁড়িয়েছেন মুসল্লিরা। স্যান্ডো গেঞ্জি আর মাথায় টুপি পরা বয়সী ইমাম। মুখে সাদা দাড়ি। তার পেছনে যারা দাঁড়িয়েছেন, তাদের পোশাক-আশাকও সাদামাটা। অনেকের পরনে লুঙ্গি, গায়ে টি-শার্ট। সবার মাথায় টুপিও নেই। এই মানুষগুলো দাঁড়িয়েছেন ঈদের নামাজ পড়তে। স্থান খুলনার কয়রা উপজেলার ২ নম্বর কয়রা গ্রাম। যারা নামাজে দাঁড়িয়েছেন, তারা সবাই সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড় আম্পানে ক্ষতিগ্রস্ত। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে ভেঙে যাওয়া বাঁধ মেরামতের সময় নামাজের সময় হয়ে গেলে তারা পানির ওপরেই দাঁড়িয়ে যান।

ছবিটা দ্য ডেইলি স্টারসহ দেশের প্রধান প্রধান সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়েছে। যে দেশকে বলা হয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার রোলমডেল, সেই দেশে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের এভাবে পানির ওপরে সেজদা দেওয়ার দৃশ্যটি বড়ই বেমানান। এই ছবিটার প্রতীকী মূল্য অনেক। বলা যায়, এখানে প্রার্থনা আর মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম একাকার হয়ে গেছে।

যদিও অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, এই মানুষগুলো তো আশ্রয়কেন্দ্রেও নামাজ পড়তে পারতেন। তা না করে কেন পানির ওপরেই দাঁড়িয়ে গেলেন? পানির ওপরে সেজদা দিলেন কীভাবে? এই নামাজের পেছনে কোনো রাজনীতি আছে কি না— ইত্যাদি? প্রসঙ্গত, এই নামাজে ইমামতি করেছেন উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আ খ ম তমিজ উদ্দিন। তিনি খুলনা জেলা দক্ষিণ জামায়াতের সাবেক আমির। আর নামাজে অন্যান্যের মধ্যে অংশ নেন উপজেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান এস এম শফিকুল ইসলাম। তিনি কয়রা উপজেলা যুবলীগের সভাপতি। গত নির্বাচনে তিনি এখানে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন এবং জয়ী হন। এরকম ঘটনায় রাজনীতি থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না, সেটি যেমন ঠিক, তেমনি সব সময় সবকিছুতে রাজনীতি খুঁজলে অনেক সময় মূল ঘটনা আড়াল হয়ে যায়। তা ছাড়া, বেড়িবাঁধ ভেঙে যার ঘর তলিয়ে যায়নি বা যার ফসলের খেত ডুবে যায়নি, তার পক্ষে এই বাস্তবতা বা এই যন্ত্রণা উপলব্ধি করা কঠিন। সুতরাং পানিতে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ার এই ছবিটার নেপথ্যে কোনো রাজনীতি আছে কি না, সেই তর্কের বাইরে গিয়ে আমরা যদি প্রশ্ন করি এই ছবিটার প্রতিপাদ্য বা মূল ঘটনা কী, তাহলে দেখব এখানে মূল ঘটনা বা বিষয় হলো— বেড়িবাঁধ ভেঙে মানুষের দুর্ভোগ। সুতরাং সেদিকে দৃষ্টি দেওয়াই সঙ্গত।

স্মরণ করা যেতে পারে, এবার যেদিন এই উপকূলের হতভাগা মানুষগুলোর জীবনে ঈদ এসেছে, সেই ‘২৫ মে’ তারিখটি তাদের জীবনে আরও এক বিভীষিকার নাম। ২০০৯ সালের এইদিনে বৃহত্তর খুলনাকে লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল ঘূর্ণিঝড় আইলা। তার দেড় বছর আগেই প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডরও এই অঞ্চলের অসংখ্য মানুষের জীবন-জীবিকা ধ্বংস করে। অথচ ওই দুটি ভয়াবহ দুর্যোগের পরে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বেড়িবাঁধ নির্মাণ এবং ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধগুলো টেকসই করার দাবি পূরণ হয়নি প্রায় এক যুগেও। হয়নি বলেই রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলে যখন হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প চলছে, তখনও সেই হতভাগা বঞ্চিত মানুষগুলোকে পানিতে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তে হয়। উন্নয়ন মানে নির্দিষ্ট কোনো এলাকার বা নির্দিষ্ট কোনো একটি জনগোষ্ঠীর জীবনমানের ইতিবাচক পরিবর্তন নয়। বরং উন্নয়ন মানে যেখানে সবাই ভালো থাকে। ফলে প্রশ্ন হলো— উপকূলের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মানুষের জানমাল রক্ষায় সরকারের প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা কি যথেষ্ট নয়? এই খাতে সরকারের বরাদ্দ কি যথেষ্ট নয়? এই এলাকার জনপ্রতিনিধিরা এতদিন কী করেছেন?

প্রতি বছরের ১৫ নভেম্বর সিডর এবং ২৫ মে আইলা দিবসে গণমাধ্যমে একই সংবাদ প্রকাশিত ও প্রচারিত হয় যে, এখনো ঝুঁকিতে উপকূলের লাখো মানুষ। কেন এই ঝুঁকি? কারণ, অনেক জায়গায় বেড়িবাঁধ নেই। যেখানে ছিল, ভেঙে গেছে। অনেক বাঁধ দুর্বল হয়ে গেছে। অনেক সময় স্থানীয়দের অদূরদর্শিতা, বিশেষ করে মাছ চাষের জন্য বাঁধ কেটে বা ছিদ্র করে পানি ঢোকানোর মতো ঘটনায়ও বাঁধ দুর্বল ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যে কারণে জলোচ্ছ্বাস হলে ওইসব জায়গা থেকে গলগলিয়ে পানি ঢোকে। কিন্তু, বাঁধ যেভাবে সংস্কার করা হলে টেকসই হয়, অনেক সময় সেভাবে কাজ হয় না। হাওরে বাঁধ নির্মাণে অনিয়মের কারণে সেখানে ফসলের কী বিশাল ক্ষতি হয়েছিল, তা দেশবাসীর অজানা নয়।

স্থানীয়ভাবে জানা গেছে, এবার আম্পানে খুলনার কয়রা উপজেলায় মোট ১১৯ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে সাড়ে চার কিলোমিটার পুরোপুরি ভেঙে গেছে। ৩৩ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ আংশিক ভেঙে গেছে। কয়রা উপজেলার ৪৭ গ্রামের দেড় লাখ মানুষ এখন পানিবন্দি। গ্রামবাসীরা স্বেচ্ছাশ্রমে বেড়িবাঁধ মেরামত করছেন। এ ছাড়া, দাকোপ, পাইকগাছা, বটিয়াঘাটা ও ডুমুরিয়া উপজেলায় প্রায় ৮০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে ৪০-৫০ মিটার পুরোপুরি ভেঙে গেছে। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৪০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ। তিনটি পয়েন্টে সেনাবাহিনী বেড়িবাঁধ মেরামতের কাজ করছে।

২০০৭ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডর ও তার পরবর্তী পরিস্থিতির ওপর একটানা প্রায় তিন সপ্তাহ সরেজমিন রিপোর্ট করার সুযোগ হয়েছিল। তখন দেখেছি বেড়িবাঁধ ভেঙে গেলে মানুষের কী দুর্ভোগ হয়। ওই সময় দক্ষিণের  জেলা ঝালকাঠির যেসব এলাকায় বেড়িবাঁধ না থাকা বা দুর্বল বেড়িবাঁধের কারণে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে বলে তথ্য পেয়েছিলাম, এবার আম্পানেও দেখা গেল সেসব এলাকায় ক্ষতি হয়েছে। কারণ, সিডর ও আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত সুগন্ধা নদীর তীরবর্তী নলছিটির বারইকরণ এলাকার সাত কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সংস্কারের বাইরে জেলার কোথাও সেভাবে কাজ হয়নি। ঝালকাঠি সদর থেকে কাঁঠালিয়া উপজেলার বিষখালী নদীর ৪৮ কিলোমিটার এখনো অরক্ষিত। কোনো বেড়িবাঁধ নেই। অথচ ২০০৭ সালেও এই কথা লিখেছিলাম। সঙ্গত কারণেই এবার ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতেও কাঁঠালিয়া উপজেলার অনেক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হন।

বরগুনার সাড়ে নয় শ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা, মহাসেন, ফণী, বুলবুলের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রায় সাড়ে পাঁচ শ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সেগুলো সম্পূর্ণ মেরামত হয়নি। এরকম পরিস্থিতিতে আঘাত হানে আম্পান এবং প্রায় ১৪ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে যায়।

২০০৯ সালে আইলার সঙ্গে ধেয়ে আসা জলোচ্ছ্বাসে খুলনা ও সাতক্ষীরার চারটি উপজেলার ৬০০ কিলোমিটারেরও বেশি বেড়িবাঁধ ধসে যায়। টানা তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে মানুষ লোনাপানিতে আবদ্ধ থাকে। অনেকে এখনো ঘরে ফিরতে পারেননি। অথচ ১০ বছরেও উন্নয়ন হয়নি কয়রার ১২১ কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁধের। পানি উন্নয়ন বোর্ড খুলনা ও সাতক্ষীরার মধ্যে সীমানা জটিলতার কারণে এই দুর্ভোগ বলে স্থানীয়রা মনে করেন। অভিযোগ আছে, বাঁধ মেরামতে গত ১০ বছরে যে বরাদ্দ হয়েছে, তার সিংহভাগই লুটপাট হয়েছে।

দক্ষিণাঞ্চলের বিশিষ্ট সাংবাদিক গৌরাঙ্গ নন্দী তার ‘সুন্দরবন উপকূলের কথকতা’ বইয়ে (প্রকাশক: বেহুলাবাংলা, ২০২০) লিখেছেন, ‘বেড়িবাঁধই কি এই অঞ্চলের সকল কিছুর নিয়ন্তা? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের দিকে তাকাতে হবে। ১৯৬০’র দশকে উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণের (কোস্টাল ইমব্যাংকমেন্ট প্রজেক্ট-সিইপি) পর পরবর্তী দুই দশক ভালো ফলন হলেও এটি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রতিবেশের জন্যে একটি হুমকি বয়ে আনে। এ অঞ্চলের নদ-নদী দিয়ে বয়ে যাওয়া ৩০ মিলিয়ন টন পলি নদী-খাল-নালা বেয়ে কৃষিজমিতে যেতে না পেরে নদীর তলদেশে জমা হতে থাকে। এক পর্যায়ে বাঁধের বাইরের নদীর অংশ জমির চেয়ে উঁচু হয়ে যায়। কৃষিজমি পরিণত হয় জলাধারে। দেখা দেয় দীর্ঘমেয়াদি জলাবদ্ধতা। যশোর থেকে শুরু হয়ে ক্রমেই দক্ষিণের খুলনা ও সাতক্ষীরার বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে প্রতিবছর। এরপর ১৯৮০’র দশকে আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলোর ঋণের টাকায় শুরু হয় চিংড়ি চাষ। বাস্তবতা হলো, আইলায় বেড়িবাঁধ ভেঙে পড়ার পেছনে যেসব কারণ কাজ করেছে, তার প্রায় সবগুলোই চিংড়ি চাষ সম্পর্কিত। বাঁধের ভেতর দিয়ে নির্বিচারে পাইপ ও অবৈধ স্লুইস গেট নির্মাণ এবং বাঁধ কেটে লোনাপানি ঢোকানোর কারণে আগে থেকেই বেড়িবাঁধগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে। ভেতর দিকে অতিরিক্ত লবণাক্ততার প্রভাবে মাটির স্বাভাবিক শক্তিও নষ্ট হয়ে যায়।’

সুতরাং আমরা যখন বেড়িবাঁধ ভেঙে ঘরবাড়ি আর ফসলি জমি তলিয়ে মানুষের দুর্ভোগের কথা লিখি, তখন এই পরিস্থিতি কেন তৈরি হলো, সেগুলোরও নির্মোহে বিশ্লেষণ করা দরকার।

আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, রংধনু টেলিভিশন

[email protected]



(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

JP central office vandalised, set ablaze

A group of unidentified people set fire to the central office of Jatiyo Party in Dhaka's Kakrail area this evening

48m ago