লকডাউনের অর্থনীতি: প্রসঙ্গ রাজাবাজার

ছবি: স্টার ফাইল ফটো

করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারে ২১ দিনের লকডাউন শেষ হলো ৩০ জুন মধ্যরাতে। স্থানীয়দের অনেকে বলছেন, তিন সপ্তাহের কারাবাস শেষ হলো। কারণ ডাক্তার-নার্স-সাংবাদিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ছাড়া আর কেউই এই ২১ দিনে রাজা বাজারে ঢুকতে বা বেরোতে পারেননি। এই এলাকার মানুষের জন্য এটি একটি অভূতপূর্ব ও কষ্টকর অভিজ্ঞতা।

যে বিষয়টি এখন অনুসন্ধান করা প্রয়োজন, আগ্রহী সাংবাদিকদের কেউ যে জিনিসটি খতিয়ে দেখতে পারেন, তা হলো:

১. এই ২১ দিনের লকডাউনে এই এলাকার ফার্মেসি ছাড়া অন্য সবধরনের দোকানপাট বন্ধ থাকায় তাদের কী পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়েছে?

২. মুদি দোকানি, রাস্তার পাশে মাছ-মাংস-সবজি ও ফল বিক্রেতাসহ অন্যান্য ব্যবসায়ীদের এই ক্ষতি কীভাবে পোষানো হয়েছে বা হবে? সরকার কি এই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের কোনো আর্থিক সহায়তা দিয়েছে? যদি দিয়ে থাকে তাহলে তার পরিমাণ কত?

৩. এই ২১ দিনে যেহেতু নিত্য পণ্যের সব দোকানপাট বন্ধ থাকলেও কয়েকটি সুপারশপের গাড়ি প্রতিদিন রাজাবাজারে এসেছে এবং বাজার মূল্যের চেয়ে বেশি দামে এসব ট্রাক থেকে সবজি ও অন্যান্য পণ্য কিনতে হয়েছে। অনুসন্ধানের বিষয় হলো, এই তিন সপ্তাহে এই এলাকায় আসা সুপারশপের ট্রাক থেকে কত লাখ টাকার পণ্য বিক্রি হয়েছে?

৪. লকডাউনভুক্ত এলাকার কর্মহীন ও দিনমজুরদের তালিকা করা হয়েছিল। এই ২১ দিনে সেই মানুষদের কতজন খাদ্য সহায়তা পেয়েছেন এবং তাদের কী পরিমাণ সহায়তা দেওয়া হয়েছে? খাদ্য সহায়তার ভেতরে কী কী ছিল?

৫. লকডাউন বাস্তবায়নে শতাধিক স্বেচ্ছাসেবক কি বিনা পারিশ্রমিকে দায়িত্ব পালন করেছেন নাকি তাদের সম্মানি দেওয়া হয়েছে? যদি সম্মানি দেওয়া হয় তাহলে সেই টাকার পরিমাণ কত?

৬. লকডাউন বাস্তবায়নে স্থানীয় মানুষদের সহায়তা, স্বেচ্ছাসেবকদের সম্মানিসহ অন্যান্য খাতে সরকারের সর্বমোট কত টাকা খরচ হয়েছে? এই হিসাবটা এ কারণে জানা দরকার যে, অন্যান্য যেসব এলাকায় লকডাউন বাস্তবায়িত হবে, সেখানে কত টাকা খরচ হবে, তার একটা ধারণা পাওয়া যাবে।

৭. বলা হচ্ছে, লকডাউনের কারণে পূর্ব রাজাবাজার এলাকায় করোনার সংক্রমণ কমেছে। এটিই স্বাভাবিক। কারণ তিন সপ্তাহ একটি এলাকায় জনগণ ও যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় মানুষে মানুষে যোগাযোগ কম হয়েছে। কিন্তু, লকডাউন শেষ হওয়ার পরে এই এলাকায় সংক্রমণ লকডাউনের আগের অবস্থায় ফিরে যায় কিনা, সেদিকেও নজর রাখতে হবে।

এবার ওয়ারী:

করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারে যেদিন ২১ দিনের লকডাউন শেষ হয়, সেদিন ঘোষণা দেওয়া হয় যে, ৪ জুলাই থেকে ২১ দিনের লকডাউন শুরু হবে পুরান ঢাকার ওয়ারীর কিছু এলাকায়। প্রশ্ন হলো এই লকডাউনে রাজাবাজারবাসী কী পেল এবং ওয়ারিবাসী কীপাবে?

১. লকডাউন কার্যকরের পর রাজাবাজারে করোনা সংক্রমণের হার কমেছে বলে জানিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। ডিএনসিসির স্বাস্থ্যবিভাগ জানিয়েছে, ১০ জুন থেকে ২১ জুন পর্যন্ত ১১ দিনে মোট ২০৫ জনের করোনা পরীক্ষা করা হয়। এ থেকে ৪০ জনের শরীরে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া যায়। যা মোট আক্রান্তের সাড়ে ১৯ শতাংশ।

এই ১১ দিনের মধ্যে প্রথম সাত দিনে (১০ জুন থেকে ১৬ জুন) ১৩১ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। তার মধ্যে ৩৩ জনের শরীরে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি শনাক্ত হয়। যা আক্রান্তের ২৫ শতাংশ। আর শেষ ৫ দিনে (১৬ জুন থেকে ২১ জুন) পরীক্ষা করেছেন ৭৪ জন। তার মধ্যে ৭ জনের পজিটিভ আসে। যা আক্রান্তের সাড়ে ৯ শতাংশ। এর মধ্যে ১৮ জুন ২২ জনের পরীক্ষা করা হয়েছে। এতে কারো শরীরে করোনা শনাক্ত হয়নি।

গত ২০ জুন ১৯ জনের পরীক্ষা করা হয়েছে। ওইদিনও কারো করোনা শনাক্ত হয়নি। এই পুরো সময়ে উপসর্গ নিয়ে যারাই পরীক্ষা করার জন্য এসেছেন তাদের কাউকে ফেরত পাঠানো হয়নি। সবার নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। ওয়ারীর বাসিন্দারাও হয়তো করোনা পরীক্ষার এই সুবিধা পাবেন। তবে এখন করোনা পরীক্ষা নিয়ে যেসব অব্যবস্থাপনার কথা শোনা যাচ্ছে, সুতরাং ওয়ারীবাসী এর কতটুকু সুফল পাবেন, তা সময়ই বলে দেবে।

২. লকডাউনের কারণে ডাক্তার-নার্স-পুলিশ ও সাংবাদিক—এই চার পেশার মানুষ প্রতিদিন কর্মস্থলে গিয়েছেন এবং এসেছেন। সুতরাং এই যাওয়া-আসার পথে এবং কর্মস্থলে তারা যে আক্রান্ত হননি এবং এলাকায় এসে তারা যে অন্য কাউকে আক্রান্ত করেননি, তার নিশ্চয়তা কী?

৩. এই চার পেশার মানুষের বাইরে অন্য আরও অনেকেই নানা অজুহাতে, ছুঁতোয়-এলাকার বাইরে গিয়েছেন আবার ফিরে এসেছেন। ফলে তাদের মধ্যে কে কে আক্রান্ত হয়েছেন এবং অন্যকে সংক্রমিত করেছেন, তা জানা যাবে না।

৪. লকডাউন শুরুর আগের দিনেই রাজাবাজার থেকে প্রচুর মানুষ অন্য এলাকায়, অনেকে গ্রামের বাড়িতে চলে গিয়েছেন। কারণ তারা জানতেন ১৪ থেকে ২১ দিন তারা বাইরে বের হতে পারবেন না। একই ঘটনা ওয়ারীতেও ঘটবে। অসংখ্য মানুষ লকডাউন শুরুর আগের দিনই এলাকা ছাড়বেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যারা এলাকা ছাড়বেন তাদের মধ্যে একটা বড় অংশ থাকবেন বেসরকারি চাকরিজীবী।

সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী লকডাউন এলাকায় সাধারণ ছুটি থাকবে। অর্থাৎ ওই এলাকার বাসিন্দদের অন্য এলাকায় সরকারি-বেসরকারি অফিস থাকলেও তাদের সেখানে যেতে হবে না।

কিন্তু, সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য এটা কোনো অসুবিধা সৃষ্টি না করলেও অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানই তাদের কর্মীদের এই সুযোগ দিতে চায় না। ফলে যারা অফিসে না গেলে অসুবিধায় পড়বেন বলে শঙ্কা রয়েছে, তাদের অনেকেই এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকায় আত্মীয়-স্বজনের বাসায় গিয়ে উঠবেন। অনেকে ২১ দিন বন্দি থাকার ভয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে যাবেন।

যাদের শরীরে করোনা সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য লকডাউন ঘোষণা করা হলো, তাদের অনেকেই এলাকায় থাকবেন না।

৫. সারা দেশ পুরো ঢাকা শহর উন্মুক্ত রেখে বিচ্ছিন্নভাবে একটি-দুটি এলাকা লকডাউন করা হলে ওই এলাকায় হয়তো কিছুদিনের জন্য সংক্রমণের মাত্রা কম হবে, কিন্তু, অন্যান্য উন্মুক্ত এলাকায় তো করোনা ঠিকই ছড়াবে এবং ছড়িয়েছে। আবার যে এলাকা লকডাউন করা হবে, লকডাউন শেষ হলে ওই এলাকার মানুষতো অন্য এলাকায় যাবেন এবং অন্য এলাকার লোকও ওই এলাকায় আসবেন, তখন কি তারা করোনায় আক্রান্ত হবেন না?

সুতরাং এক সঙ্গে সব এলাকায় কঠোর লকডাউন যেহেতু বাস্তবায়ন করা যায়নি এবং সেটি করার সময়ই অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। অতএব বিচ্ছিন্নভাবে রাজধানীর ছোট্ট একটি-দুটি এমনকী, পাঁচটি এলাকায় লকডাউন করেও আখেরে করোনো মোকাবেলায় কী লাভ হবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দে হআছে।

আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, রংধনু টেলিভিশন।

 

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Awami League should be punished as a party: Fakhrul

He made the remarks after visiting a BNP man undergoing treatment at National Institute of Neurosciences and Hospital

27m ago