রাজশাহী কলেজের প্রাচীর ভেঙে চওড়া হচ্ছে রাস্তা
ঔপনিবেশিক যুগের স্থাপত্যশৈলীর ১৪৭ বছরের পুরনো ঐতিহ্য রাজশাহী সরকারি কলেজের সীমানা প্রাচীর ভেঙে রাস্তা চওড়া ও একটি নর্দমা তৈরি করছে রাজশাহী সিটি করপোরেশন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রয়োজনীয় অনুমোদন নেওয়ার নিয়ম অগ্রাহ্য করে কলেজ কর্তৃপক্ষ সরকারি জমিতে শহর উন্নয়নের এই কাজের জন্য করপোরেশনকে মৌখিকভাবে সম্মতি দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দ্য ডেইলি স্টারের কাছে এ কথা স্বীকার করেছেন।
যোগাযোগ করা হলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নুরুল কবির বলেন, ‘কাউকে কোনো যুক্তিতেই এই কলেজের কোনো অংশ ধ্বংস করার অনুমতি দেওয়া উচিত নয়। এই সিদ্ধান্ত অগ্রহণযোগ্য ও অবৈধ হবে। এটি একটি ঐতিহ্যের সত্যতা নষ্ট করবে। কলেজটির স্থাপত্যের ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক মূল্যের পাশাপাশি এর অর্থনৈতিক গুরুত্বও আছে।’
নূরুল কবির ঔপনিবেশিক স্থাপত্যকলা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ে বিস্তর গবেষণা করেছেন। দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে তিনি আরও বলেন, ‘১৮৭৩ সালে নির্মিত কলেজটি ঔপনিবেশিক যুগের প্যালাডিয়ান স্থাপত্য পদ্ধতির প্রমাণ বহন করে যা তৎকালীন বাংলার স্থানীয় স্থাপত্যকলার সঙ্গে মিশ্রিত হয়েছিল।’
‘ইউরোপীয় প্যালাডিয়ান স্থাপত্যকলা ১৬তম শতকের একটি যুগান্তকারী ঘটনা ছিল। এটি প্রাথমিকভাবে শাসকদের জন্য নির্দিষ্ট ও সাধারণদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে ঔপনিবেশিক শাসনের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে এই স্থাপত্যশৈলীর ধারণার অনুসারীরা এর নকশাকে সাধারণ মানুষের ব্যবহার উপযোগী করে গড়ে তুলেছিলেন। প্যালাডিয়ান শৈলীতে শাস্ত্রীয় রূপ, প্রতিসাম্য ও কঠোর অনুপাতের ব্যবহার রয়েছে। রাজশাহী কলেজের ভবনগুলো, এর খোলা জায়গাগুলো এবং অবশ্যই এর সীমানা প্রাচীর— সব কিছু জ্যামিতিক অনুপাত মেনে নির্মাণ করা হয়েছিল। অনুপাতগুলো স্থাপত্যকে নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে দর্শকদের কাছে দৃষ্টি-নন্দন ও আকর্ষণীয় করে তোলে। যে কারণে এর প্রাচীর ধ্বংস করা যাবে না’, বলেন নূরুল কবির।
এ প্রসঙ্গে রাজশাহীর মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, ‘শহরের ঐতিহ্য ধ্বংস করার বিন্দুমাত্র উদ্দেশ্য করপোরেশনের নেই। বরং করপোরেশন সেগুলো রক্ষা করতে চায়। শহরের অন্যতম প্রধান সড়কটি পথচারীদের সুবিধা বাড়াতে ও ক্রমবর্ধমান ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণের জন্য সম্প্রসারণের প্রয়োজন পড়েছে। আমরা ঐতিহ্যের অংশ নষ্ট করছি না। যেটি ভাঙা হচ্ছে সেটি পরে একই আদলে তৈরি করা। আমরাও যেটা নির্মাণ করে দেবো সেটি ঐতিহ্যের প্রাচীরের আদলেই তৈরি হবে।’
করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী গোলাম মোর্শেদ এই উন্নয়ন কাজের তদারকি করছেন। তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘করপোরেশন আড়াই কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্প সম্পাদন করছে। সিটি করপোরেশন কলেজের মূল ফটক থেকে বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর পয়েন্ট পর্যন্ত রাস্তার পাশে মূল সীমানা প্রাচীরটি প্রতিস্থাপনের জন্য প্রায় পাঁচ শ মিটার দীর্ঘ কংক্রিটের সীমানা প্রাচীর তৈরি করবে। দেয়ালের বাইরে ভূগর্ভস্থ নর্দমা তৈরি করা হবে। নির্মাণ কাজ শেষে কলেজের পুরানো সীমানা প্রাচীর ধ্বংস করা হবে। এতে ৪০ ফুট রাস্তা প্রসারিত হয়ে ৬০ ফুট হবে। চার লেন রাস্তার দুপাশে ফুটপাত ও মাঝখানে একটি দ্বীপ তৈরি করা হবে।’
‘আমাদের অগ্রাধিকার কলেজ শিক্ষার্থীদের জন্য একটি ফুটপাত তৈরি করা। কলেজের শিক্ষার্থীরা ফুটপাতের অভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কখনো কখনো দুর্ঘটনার শিকার হয়। তিন বছর আগে প্রকল্পটি হাতে নেওয়ার সময় আমরা কলেজের অধ্যক্ষের পরামর্শ নিয়েছি’— বলেন গোলাম মোর্শেদ।
প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নির্মাণ শ্রমিকরা ইতোমধ্যে মূল সীমানা প্রাচীরের পেছনে একটি নর্দমা এবং একটি কংক্রিট প্রাচীরের কাঠামো তৈরি করেছেন। শ্রমিকদের কাজের সময় শাস্ত্রীয় নকশার মূল প্রাচীরের একটি স্তম্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কলেজের হোস্টেলের একটি পুরাতন ডাইনিং রুম ভেঙে ফেলা হয়েছে।
শ্রমিকরা জানান, নির্মাণ কাজ শেষ হলে মূল সীমানা প্রাচীরটি ভেঙে ফেলার জন্য তাদের কাছে নির্দেশ রয়েছে।
কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক হবিবুর রহমান জানিয়েছেন, প্রাচীরটি পুনর্নির্মাণের জন্য করপোরেশনের প্রস্তাবকে তিনি ‘মৌখিকভাবে সম্মতি দিয়েছেন’।
তিনি বলেছেন যে, নির্মাণ কাজে সরকারি জমি দেওয়ার জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পূর্ব অনুমোদন চায়নি। কলেজটির পাঁচ শ মিটার দীর্ঘ সীমানা বরাবর প্রায় ছয় থেকে ১০ ফুট প্রশস্ত জমি প্রয়োজন হচ্ছে।
অধ্যাপক রহমান বলেন, ‘তবে, করপোরেশন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন চেয়েছিল।’
এ প্রসঙ্গে মেয়র লিটন বলেন, তারা তিন মাস আগে মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রয়োজনীয় অনুমোদন চেয়েছেন। অনুমোদন পাওয়ার আগে পর্যন্ত পুরানো প্রাচীরটি ভেঙে ফেলা হবে না।
আইন অনুযায়ী, ১০০ বছরের বেশি পুরানো যে কোনো ভবন ঐতিহ্যের অংশ এবং এ ধরনের প্রতিটি স্থাপনায় সরকারের স্বত্বাধিকার জন্মায়। প্রত্নতাত্ত্বিকরা বলছেন, সরকারের অনুমোদন ছাড়া কোনো কর্তৃপক্ষ ঐতিহ্য ধ্বংস করতে পারে না।
জাবি শিক্ষক নুরুল কবির বলেন, ‘ঔপনিবেশিক যুগের ভবনগুলির অর্থনৈতিক মূল্যও রয়েছে। অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা এই ভবনগুলো সুরক্ষার জন্য বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশকে অর্থ সহায়তা দেয়। আমরা ঔপনিবেশিক যুগকে তৎকালীন শাসকদের দ্বারা নিপীড়নের কারণে অভিশাপ হিসেবে বিবেচনা করি। কিন্তু এই সংস্থাগুলো সেই সময়ে নির্মিত স্থাপনাগুলো রক্ষা করে প্রমাণ করতে চায় যে সে সময়েও সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল। যদি সেসব ঐতিহ্যের মৌলিকত্য নষ্ট করা হয় তাহলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ এগুলো সুরক্ষার জন্য অর্থ আদায়ে ব্যর্থ হতে পারে বা সংস্থাগুলো ব্যয় করতে রাজি নাও হতে পারে। যে কোনো ঐতিহ্যবাহী স্থান সম্পর্কিত উন্নয়নমূলক কাজ করার আগে কর্তৃপক্ষের উচিত স্থাপত্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া। প্রত্নতত্ত্ব ও স্থাপত্য বিশেষজ্ঞরা নগরায়ণের জন্য প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া সম্পর্কে অন্ধ নন।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন বিশেষজ্ঞ আছেন যারা বিনা পারিশ্রমিকে তাদের দক্ষতা বিনিময়ের জন্য তৈরি হয়ে আছেন। দেশে ঐতিহ্য সংরক্ষণে কাজ করার জন্য দক্ষ কর্মীও তৈরি হয়েছে।’
যোগাযোগ করা হলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) রাজশাহী জেলা সভাপতি আহমেদ শফি উদ্দিন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘রাজশাহী সরকারি কলেজটি দেশের অল্প কয়েকটি প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি ছিল। যার একটি স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ার ইতিহাস আছে। কলেজটির ঐতিহ্য ধ্বংসের কাজটি এমন এক সময়ে হচ্ছে, যখন কলেজের ১৫০ বছর পূর্ণ হতে কয়েক বছর বাকি আছে। এটি কলেজের হাজার হাজার শিক্ষার্থীর স্মৃতিতে আঘাত করবে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা লক্ষ্য করছি যে নগরীর ঐতিহ্যগুলো একের পর এক নষ্ট করা হচ্ছে। ইতিহাস ধ্বংস করা একটি অমার্জনীয় অপরাধ। অবশ্যই এই প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে।’
অতীতে ভুবন মোহন পার্কের গেট, শাহ মখদুম কলেজের ফটক, রজনী কান্ত সেন, স্যার যাদু নাথ সরকার ও বিচারক লোকেন পলিতের বাসভবন যেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকেছেন, সেগুলো ধ্বংস করা হয়েছিল। পুরানো পৌরসভা ভবন, পাবলিক লাইব্রেরি, ঋত্বিক ঘটকের বাসভবন, রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে ঔপনিবেশিক যুগের ভবন এবং মহানগর পুলিশ (আরএমপি) সদর দপ্তরের সেই স্থাপনা ধ্বংস করা হয়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
Comments