‘গরিব মানুষের শ্রমের ওপরই দেশ টিকে আছে’

সমাজ পরিবর্তনের আবশ্যকতায় বিশ্বাসী অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। বাকস্বাধীনতা, মানবিক অধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচার বিষয়ক আন্দোলনের পুরোধা তিনি। দীর্ঘকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্য যাদের অবদানে উজ্জ্বল, তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত

সমাজ পরিবর্তনের আবশ্যকতায় বিশ্বাসী অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। বাকস্বাধীনতা, মানবিক অধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচার বিষয়ক আন্দোলনের পুরোধা তিনি। দীর্ঘকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্য যাদের অবদানে উজ্জ্বল, তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম।

গতানুগতিক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে বদলানোর স্বার্থেই, অর্থাৎ মানুষের সামাজিক মুক্তির চিন্তায় প্রশ্ন ও চিন্তাকে অন্যের কাছে নিয়ে গেছেন বিরতিহীনভাবে। কখনো লিখে, কখনো সম্পাদনা করে ও বলে প্রচার করেছেন এবং করছেন তার আদর্শ ও রাষ্ট্রের সংকট-সম্ভাবনা। পাশাপাশি তার সম্পাদনায় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে ‘নতুন দিগন্ত’। করোনার মতো ভয়াবহ সংকট ও চলমান পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার নানা দিক নিয়ে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলেছে দ্য ডেইলি স্টার

করোনা এসে গোটা পৃথিবীর চিন্তা-ভাবনা, জীবনধারা পরিবর্তন করে দিয়েছে। বলা হচ্ছে, শত বছর পর এমন মহাদুর্যোগ ফিরে আসে, তা থেকে যায়। আপনি কীভাবে দেখছেন বিষয়টা?

এটা মহাদুর্যোগ অবশ্যই। করোনাভাইরাস প্রকৃতি থেকেই এসেছে। কিন্তু, প্রাকৃতিক কারণে এর উদ্ভব হয়নি। হয়েছে মানুষের কারণে। মানুষ প্রকৃতিকে উত্ত্যক্ত করেছে; প্রকৃতি তার প্রতিক্রিয়া জানিয়ে দিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, প্লাবন, খরা সবকিছুই ঘটছে প্রকৃতির ওপরে মানুষের অত্যাচারের ফল হিসেবে। করোনাও ওই প্রতিক্রিয়াই; ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া। কাজেই শত বছর পরে এটা এসেছে সেভাবে না দেখে, দেখতে হবে শত বছর ধরে মানুষের ইতিহাস যে পথে এগিয়েছে, সেই অগ্রগতির ভেতরকার ভ্রান্তি থেকেই এই মহাদুর্যোগের আবির্ভাব। এক শ বছরে মানুষ অভূতপূর্ব উন্নতি করেছে; কিন্তু, সেই উন্নতি মানুষকে যে নিরাপত্তা দেয়নি, এটা তারই প্রমাণ। সভ্যতার পুঁজিবাদী কারিগররা মানুষ মারার অস্ত্র উদ্ভাবনে যে পরিমাণ মনোযোগ দিয়েছে, সে মনোযোগের সিকি ভাগও যদি রোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসার জন্য দিত, তাহলে এই মহাদুর্যোগ ঘটতো না।

পৃথিবীর অনেক দেশ কোভিড-১৯’কে মোকাবিলা করেছেন বেশ দক্ষতার সঙ্গে। সেখানে বাংলাদেশ সুযোগ পেয়েও গুরুত্ব দিলো না প্রাথমিকভাবে। অনেকে সমন্বয়ের অভাব বলছে। আপনি কী মনে করেন? ৫০ বছরে এ রাষ্ট্রের সমন্বয় কোথায় দাঁড়িয়েছে?

সমন্বয়ের অভাবে তো অবশ্যই। দায়িত্বজ্ঞানের অভাবও বটে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়া। রাষ্ট্রের কর্তারা তা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন না। তাদের চিন্তা ক্ষমতায় থাকা ও ক্ষমতাকে নিজেদের সুবিধার জন্য ব্যবহার করা। মানুষের একেবারে প্রাথমিক চাহিদা হচ্ছে খাদ্য, তারপরেই আসে আশ্রয়ের প্রশ্ন; কিন্তু খাদ্য ও আশ্রয় দরকার বেঁচে থাকার জন্যই; বেঁচে থাকা মানেই সুস্থ থাকা। জনগণের স্বাস্থ্যের বিষয়ে আমাদের রাষ্ট্র চিন্তিত নয়; যার ফলে চিকিৎসা এখন কেনাবেচার পণ্যে পরিণত হয়েছে। সেই কিনতে পারবে যার সামর্থ্য আছে। পাবলিকের জন্য যে চিকিৎসা ব্যবস্থা, সেটা ক্রমাগত দুর্বল হয়েছে।

রাষ্ট্রের পক্ষে দায়িত্ব উপেক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে কারণ রাষ্ট্রের জবাবদিহিতা নেই। জাতীয় সংসদ কার্যকর নয়। দেশে বিরোধীদল নামে আছে, কাজে নেই। গণমাধ্যমে তেমন স্বাধীনতা নেই যে প্রশ্ন করে ও জবাব চায়। সামাজিক মাধ্যম বিক্ষিপ্ত শক্তি, তাকে উপেক্ষা করা যায়। তদুপরি আছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, যা প্রয়োগ করে সরকার-বিরোধিতাকে রাষ্ট্রবিরোধিতা হিসেবে দাঁড় করানো খুবই সম্ভব। সর্বোপরি ভোট পাওয়া না-পাওয়া নিয়ে রাষ্ট্র শাসকদের কোনো দুশ্চিন্তা নেই।

জবাবদিহিতার দায় থাকলে রাষ্ট্রের কর্তারা হয়তো সতর্ক হতেন, ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যোগী হতেন। সমন্বয়হীনতা ঘটেছে দায়িত্বজ্ঞানহীনতার অভাবে এবং দায়িত্বজ্ঞানহীনতা প্রশ্রয় পাচ্ছে জবাবদিহিতার অনুপস্থিতির কারণে।

মানুষের মৌলিক অধিকার চিকিৎসা বিষয়ে একটি রাষ্ট্রের কতটা নাজুক ব্যবস্থা থাকতে পারে— তা প্রমাণ হয়েছে করোনায়। ভিআইপি ও সাধারণ সেবা— মানুষের মাঝে বৈষম্য দৃশ্যমান। অথচ এর বিরুদ্ধেই দেশ স্বাধীন হয়েছিল। তাহলে সামাজিক মুক্তি কার হাত ধরে আসবে?

হ্যাঁ, মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল মানুষের সঙ্গে মানুষের অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠা করার জন্যই। উন্নতি পাকিস্তান আমলেও হচ্ছিল; কিন্তু সে উন্নতি ছিল বৈষম্যমূলক। আঞ্চলিক বৈষম্য ছিল; ছিল শ্রেণিবৈষম্যও। আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি শুধু যে স্বায়ত্তশাসনের জন্য তাতো নয়, যুদ্ধ করেছি শ্রেণিবৈষম্য দূর করার জন্যও। শ্রেণিবৈষম্য দূর হবে কী, বরঞ্চ অনেক বেড়েছে।

করোনার আক্রমণ ওই বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে দেবে। পর্যুদস্ত অবস্থায় গরিব মানুষ আরও গরিব হবে এবং ধনীরা গরিব মানুষকে বঞ্চিত করে আরও ধনী হতে পারবে।

প্রতিকার হচ্ছে ব্যক্তি মালিকানার ব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা। তার জন্য প্রয়োজন সামাজিক বিপ্লবের। সংস্কার ও সংশোধনে কাজ হবে না। সে স্তর পার হয়ে গেছে; এখন দরকার সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তন। সামাজিক বিপ্লব আসবে ডোনাল্ড ট্রাম্প যাদের ‘রেডিক্যাল লেফট’ বলে চিহ্নিত করা শুরু করেছেন, তাদের হাত ধরেই। এই লেফট হচ্ছে বঞ্চিত মানুষ। বঞ্চিত মানুষই সমাজে বিপ্লব করবে; সঙ্গে থাকবে সংবেদনশীল মানুষ ও সচেতন বুদ্ধিজীবীরা।

কথায় কথায় আমরা দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নর কথা বলি। কিন্তু, করোনার সার্টিফিকেট প্রদানের বিষয় নিয়ে কেলেঙ্কারিতে পৃথিবীর বড় বড় মিডিয়ায় যে খবর প্রচারিত হলো, এতে কার দায়? দায়িত্ব নিয়ে কে ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনবে? তা ছাড়া, একটা দেশের চেতনা বা ভাবমূর্তি কারা রক্ষা করে?

করোনার ভুয়া সার্টিফিকেট দিয়ে ভাবমূর্তির যে ক্ষতি হয়েছে, তা মারাত্মক ও সুদূরপ্রসারী। প্রমাণ হয়েছে যে বাংলাদেশে অবাধে প্রতারণা চলে এবং প্রতারণা চলে মানুষের বাঁচা-মরার ব্যাপার নিয়েও। করোনার ভুয়া সার্টিফিকেট মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারে। প্রতারকেরা মানুষের বাঁচা-মরা বোঝে না, নিজেদের মুনাফা বোঝে।

দ্বিতীয় ব্যাপার যেটা সেটা হলো, প্রতারণা ঘটেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ক্ষমতাবান একটি গোষ্ঠীর কেবল জ্ঞাতসারে নয়, সক্রিয় সহযোগিতায়।

ভাবমূর্তির ক্ষতির জন্য কী আর বাকি থাকে? ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য যা করতে হবে তা হলো, আমাদের অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। এগিয়ে নিয়ে যাওয়া মুক্তির লক্ষ্যে; অর্থাৎ একটি পুরোপুরি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠার অভিমুখে। এই গণতন্ত্রেরই অপর নাম সমাজতন্ত্র, যার কথা আমাদের আদি সংবিধানে ছিল। কিন্তু যেখান থেকে রাষ্ট্র সরে এসেছে। আমাদের গত পাঁচ দশকের ইতিহাস উন্নতির আড়ালে সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য থেকে সরে আসার ইতিহাস। যত আমরা সরেছি, ততই আমাদের দুর্গতি বেড়েছে। মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনগণের যুদ্ধ; অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার কাজটা জনগণকেই করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক আন্দোলন। আন্দোলনের জন্য দরকার সংগঠন। সংগঠনের জন্য চাই সঠিক চেতনা ও লক্ষ্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা। নেতৃত্ব আন্দোলনের ভেতর থেকেই গড়ে উঠবে।

অভিন্ন সংকট নিয়ে বিজ্ঞানের প্রায় অসহায়ত্ব অবস্থা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) লাগামহীন মন্তব্য, রাষ্ট্রের সমন্বয়হীন কার্যক্রম— বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবনা থেকে কী বলবেন?

বিজ্ঞান চলে গেছে পুঁজিবাদের দখলে। তাই সে মানুষ মারবার কায়দায় কৌশল আবিষ্কারে যত ব্যস্ত, মানুষকে রক্ষা করার জন্য তত ব্যস্ত নয়। দোষটা বিজ্ঞানের নয়, দোষটা বিজ্ঞানের মাধ্যমে যারা মানুষের সভ্যতা শুধু নয়, মানুষের মনুষ্যত্বকেই ধ্বংস করে ফেলতে চায়, তাদের। এদের কাজ মুনাফা করা। এরা মুনাফা চেনে, মনুষ্যত্ব চেনে না। ডব্লিউএইচও পঙ্গু প্রতিষ্ঠান। কারণ, এর কোনো স্বাধীন অস্তিত্ব নেই; পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর চাঁদায় সে চলে, তাদেরকে চটাতে সাহস করে না; সে জন্য সমস্যার গভীরে যায় না। আসল ব্যাধি যে পুঁজিবাদ সেটা বলতে পারে না। তাই নানা কথা বলে মানুষকে সন্ত্রস্ত রাখে। সমাধান বলে না।

আর রাষ্ট্রের কথা তো বললামই। আমাদের রাষ্ট্র পুঁজিবাদী এবং তার কোনো দায় নেই জবাবদিহিতার। এটা খেয়াল করলেই রাষ্ট্রের আচরণের ব্যাখ্যা পেয়ে যাব।

লাখো মানুষ কর্মহীন, নগর ছাড়া হাজারো মানুষ। সংকটে রাষ্ট্রের ভূমিকা আশাবাদী করে তোলে না। বুদ্ধিজীবীরা নীরব, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ঘরে প্রায়। এমন পরিস্থিতিতে কার কী করণীয় বলে মনে করেন।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব নিয়ে আমি চিন্তিত নই। আমার চিন্তা পুঁজিবাদের প্রভাব নিয়ে। করোনাভাইরাস নিশ্চয়ই নিয়ন্ত্রণে আসবে। টিকা পাওয়া যাবে, চিকিৎসাও উন্নত হবে। কিন্তু, আগামীতে নতুন কোনো মহাবিপদ যে আসবে না, তার নিশ্চয়তা কী? আসবে, আসতে বাধ্য। অন্য কিছু না হোক, সেটা একটি মহানৈরাজ্য হিসেবে আসতে পারে। নৈরাজ্য যাতে না আসে, নৈরাজ্যের বদলে যাতে সুসংগঠিত বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে, সেটা দেখাই এখন কর্তব্য। এটা সব দেশের মানুষকেই দেখতে হবে এবং প্রত্যেক দেশেই সামাজিক বিপ্লব সম্পন্ন করা চাই। তাহলে নতুন এক আন্তর্জাতিকতা সৃষ্টি হবে, যেটি হবে সহযোগিতা ও সহমর্মিতার। সেই পৃথিবীটাতে নতুন কোনো বিশ্বযুদ্ধ বাঁধবে না। উৎপাদনের পুঁজিবাদী সম্পর্ক ভেঙে সামাজিক উৎপাদন ও সামাজিক বণ্টনের মাধ্যমে পৃথিবী প্রাচুর্যে ভরে উঠবে। মানুষের জীবনে সুখ, স্বস্তি ও অবকাশ, কোনো কিছুরই অভাব থাকবে না।

করোনার মাঝেও বাংলাদেশে বেশ কিছু আলোচিত ঘটনা ঘটেছে। এ নিয়ে পত্রিকায় কলাম লিখে মতামত দিয়েছেন বুদ্ধিজীবীরা। তা সত্ত্বেও নজরে নিয়েছেন বলে মনে হয় না রাষ্ট্রপক্ষ। বিষয়গুলো নজরে না নেওয়ার কারণ কী?

কারণ হলো এই যে আমাদের রাষ্ট্র জনগণের স্বার্থ দেখে না; স্বার্থ দেখে কতিপয়ের। এ রাষ্ট্র জনমতের তোয়াক্কা করে না। জবাবদিহিতার দায়ভার গ্রহণ করে না। যে অন্যায়গুলো ঘটছে, সেগুলো জনগণের জন্য বড় রকমের সমস্যা, কিন্তু রাষ্ট্রের জন্য নয়। রাষ্ট্র এগুলোকে তার নিজের জন্য কোনো হুমকি বলে মনে করে না।

দেখা যায় যে অপরাধীদের শাস্তি হয় না, যে জন্য অপরাধের মাত্রা বাড়তেই থাকে। অনুসন্ধান করলে জানা যাবে যে অনেক অপরাধ সরকারি লোকদের হয় আশ্রয়ে, নয় তো প্রশ্রয়ে ঘটে। সরকারি বলতে রাজনৈতিক ও বিভিন্ন ধরনের আমলাতন্ত্রের সদস্য— উভয়কেই বুঝতে হবে। শাসক শ্রেণি জনগণের সম্মতি নিয়ে দেশ শাসন করে না। কখনো কখনো তারা জোরজবরদস্তির ভেতর দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নেয়। যখন ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে, তখনো জনগণের স্বার্থ দেখবে এমন লোকেরা জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয় না; ভোটে জেতে তারাই যাদের টাকা আছে। টাকাওয়ালারা নির্বাচনে টাকা খরচ করে, জেতে, এবং জিতে আরও বেশি ধনী হয়। তা ছাড়া, এমন ঘটনাও তো ঘটে যে ভোটার আসে না, ভোট দেয় না, তবু কথিত জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হয়ে যান এবং দেশ শাসন করেন। সরকার যে টিকে থাকে, সেটা জনসমর্থনের দরুন নয়, ক্ষমতার জোরে ও দাপটে। বর্তমানে শাসক শ্রেণির জন্য জনসমর্থনের চেয়েও বিদেশি শক্তির সমর্থন অধিক জরুরি হয়ে উঠেছে। মোট কথা, রাষ্ট্রের দায়িত্ব দাঁড়িয়েছে শাসক শ্রেণির স্বার্থকে নিরাপত্তা দেওয়া। নিরাপত্তা বিধানের জন্য আইনকানুন, সরকারি-বেসরকারি বাহিনী, সবকিছুই মজুদ রয়েছে। আমাদের এই রাষ্ট্রকে তাই বুর্জোয়া অর্থেও গণতান্ত্রিক বলা যাবে না।

বুদ্ধিজীবীরা কথা বলেন ঠিকই, বলতে হয়, নইলে তারা বুদ্ধিজীবী কেন; কিন্তু তাদের অধিকাংশই কথা বলেন লাইন ধরে। একদল থাকেন সরকারের পক্ষে, কথা বলেন ইনিয়ে-বিনিয়ে, সরকারের মুখ চেয়ে। তারা হয়তো ইতোমধ্যেই সুবিধা পেয়েছেন, নয়তো পাবেন বলে আশা করছেন। সরকারের বিরুদ্ধে যারা বলেন, তারাও আশাবাদী; আশা রাখেন যে এখন পাচ্ছেন না ঠিকই, কিন্তু আগামীতে সুদিন আসবে এবং তখন সুবিধা পাবেন। তবে, তাদের কথায় তেমন জোর থাকে না। প্রথমত, গণমাধ্যম তাদেরকে তেমন একটা পাত্তা দেয় না, কেননা গণমাধ্যমের মালিকেরা সরকারের বিরুদ্ধে যেতে চায় না, ভয় পায়। দ্বিতীয়ত, সরকার নিজেও বিরুদ্ধ মত পছন্দ করে না, বিরোধীদের কণ্ঠ রোধ করতে পারলে খুশি হয়।

দুই দলের কোনো দলই জনজীবনের গভীরে যেসব সমস্যা রয়েছে, যেগুলো রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিকভাবে জড়িত, সেগুলোর দিকে যেতে চান না। দৃশ্যমান সমস্যাগুলো যে গভীর এক অসুখেরই প্রকাশ এবং সে অসুখের নাম যে বিদ্যমান পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও আদর্শের দৌরাত্ম্য, সেটা তারা মানতে চান না। মানলে তাদের খুবই অসুবিধা। তারা চান ব্যবস্থাটাকে যেমন আছে তেমনি রেখে দিয়ে নিজেদের যা প্রাপ্য সেটা বুঝে নিতে। সুবিধা ভাগাভাগির লড়াইটাকে তারা মতাদর্শিক লড়াইয়ের আবরণ দিতে চান; দেনও। কিন্তু, যতই লুকোচুরি খেলুক, তারা যে জনগণের পক্ষের শক্তি নন, এ সত্য মিথ্যা হয়ে যায় না।

তা ছাড়া, এটাও তো মানতে হবে যে, গভীর ও বৈজ্ঞানিক চিন্তার চর্চা আমাদের দেশে উৎসাহ পায় না। এখানে মতাদর্শিক বিতর্ক নেই। উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানে ছাত্রসংসদ নেই। জাতীয় সংসদ আত্মসন্তুষ্ট দম্ভোক্তি, চাটুকারিতা ও অনুপস্থিত প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বিষোদগারে সর্বক্ষণ মুখরিত থাকে। গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন ও ছবি যত পাওয়া যায়, চিন্তাসমৃদ্ধ রচনা তার শতভাগের এক ভাগও পাওয়া যায় না। জ্ঞানবিজ্ঞানের কদর নেই। শিক্ষাক্ষেত্রে তথাকথিত বিস্ফোরণ চিন্তার মানের ও জ্ঞান প্রকাশের ভাষাগত দক্ষতার বৃদ্ধি ঘটিয়েছে এমনটা বলা যাচ্ছে না, বরঞ্চ উল্টোটাই ঘটেছে বলে সন্দেহ।

দলীয় আনুগত্যের বাইরে যে বুদ্ধিজীবীরা রয়েছেন, যারা মনে করেন রাষ্ট্র ও সমাজকে গণতান্ত্রিক করতে না পারলে মানুষের মুক্তি আসবে না, তাদের সংখ্যা অল্প। যারা আছেন তারাও সুসংগঠিত নন, পরস্পর বিচ্ছিন্ন এবং তাদের বক্তব্য প্রচার পায় না। সরকার তাদেরকে অপছন্দ করে; গণমাধ্যম তাদেরকে অবাঞ্ছিত বলে জানে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে রাষ্ট্রের সঙ্গে সাধারণ মানুষের আন্তরিকতা যেমন নেই, তেমনি নেই বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গেও। এই সম্পর্ক বা যোগাযোগ রাষ্ট্র কী আবশ্যক মনে করে না?

রাষ্ট্রের সঙ্গে সাধারণ মানুষের যোগাযোগ অবশ্যই আছে। থাকতেই হবে। রাষ্ট্রের যা কিছু ক্ষমতা, আয় উপার্জন, সে তো সাধারণ মানুষের কারণেই। তবে, সম্পর্কটা একপাক্ষিক, দ্বিপাক্ষিক নয়। রাষ্ট্র হুকুম দেয়, জনগণ শোনে। জনগণ যা বলতে চায় রাষ্ট্র তা শোনে না। রাষ্ট্র শাসন করে, জনগণ শাসিত হয়। রাষ্ট্র তার সিদ্ধান্তগুলো বিনা বিচারে ও নির্দ্বিধায় জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়; জনগণের কিছু বলার থাকে না, তারা শুধু দেখে এবং সহ্য করে।

রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। আইন প্রণয়ন বিভাগে সত্যিকার জনপ্রতিনিধি বলতে প্রায় কেউই থাকে না। ওদিকে বিচার বিভাগ জনগণের বড় অংশের জন্য অনেকটা নিষিদ্ধই হয়ে আছে। আদালতে যেতে হলে টাকা লাগে, গেলে ন্যায়বিচার কতটা পাওয়া যাবে এবং কবে পাওয়া যাবে, সে বিষয়ে গভীর সংশয় রয়েই যায়। মামলা করে নিঃস্ব হওয়ার দৃষ্টান্ত বিরল নয়।

রাষ্ট্রের সঙ্গে সাধারণ মানুষের যোগাযোগ তাই মোটেই দ্বিপাক্ষিক নয়, একপাক্ষিক বটে। দুই পক্ষের যোগাযোগের একটি কার্যকর মাধ্যম হচ্ছে গণমাধ্যম। গণমাধ্যম পারে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা, ক্ষোভ-বিক্ষোভকে তুলে ধরতে; পারে কিছু পরিমাণে হলেও রাষ্ট্রকে জবাবদিহিতার জায়গাতে নিয়ে আসতে। কেবল যে পারে তা নয়, পারাটা উচিতও বটে। কিন্তু, আমাদের দেশে গণমাধ্যম সেই কাজটা করে না। সরকারের অর্জন, সরকারি ও সরকারপক্ষীয় লোকদের বক্তৃতা-বিবৃতি প্রচার করাটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে গণমাধ্যমের প্রধান দায়িত্ব। এর কারণ মালিকেরা সবাই সরকারপন্থি। এই পক্ষপাত মতাদর্শিক অনুপ্রেরণায় নয়, স্বার্থের টানে।

দেশে বেকার সমস্যা ক্রমাগত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। জনজীবনে নিরাপত্তার অভাব বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে মেয়েরা দুঃসহ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। অন্য সমস্যা তো বটেই, জনদুর্ভোগের এই দুটি বড় বিষয়ে গণমাধ্যমের কাছ থেকে যে সরবতা প্রত্যাশিত, তা পাওয়া যাচ্ছে না।

নৈতিক ভাবনায় বলা যায়, রাষ্ট্রের ধর্ম দুর্বলকে রক্ষা আর দুর্জনকে প্রতিরোধ; তার কোনোটাই বর্তমান সময়ে হচ্ছে না, এ থেকে উত্তরণের উপায় কী?

দুর্বলকে রক্ষা করা এবং দুর্জনকে দমন করা একটি আদর্শের কথা। এমন আদর্শ রাষ্ট্র পাওয়া কঠিন, এখন তো পাওয়া যাচ্ছেই না।

আমাদের রাষ্ট্র দুর্বলরা রয়েছে দুর্জনদের কর্তৃত্বাধীন। রাষ্ট্র ধনীদের ইচ্ছায় চলে। ধনীরা উৎপাদনের সূত্রে ধনী হয়নি। উৎপাদন যা করার করে মেহনতি মানুষ। ধনীদের অধিকাংশই ধনী হয়েছে প্রতারণা ও লুণ্ঠনের মধ্য দিয়ে। এরা দুর্বল নয়, এরা দুর্জন। এদের পক্ষে দুর্জন হওয়াটাই স্বাভাবিক। এই দুর্জনদের কারণেই দুর্বলরা দুর্বল থাকে এবং অসহায় বোধ করে।

এই অবস্থা থেকে উত্তরণের কোনো সহজ উপায় নেই। উত্তরণের জন্য আমরা দীর্ঘকাল সংগ্রাম করেছি, কিন্তু সফল হইনি। সফল না হওয়ার কারণ আমাদের দেশে কোনো সামাজিক বিপ্লব ঘটেনি। উপর-কাঠামোতে পরিবর্তন এসেছে, উন্নতিও হয়েছে, কিন্তু সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেনি। শাসক শাসিতের সম্পর্কটা রাজা ও প্রজার যে সম্পর্ক সে রকমেরই রয়ে গেছে। রাষ্ট্রের নাম বদলেছে, আয়তনে পরিবর্তন ঘটেছে, পুরানো শাসকদের জায়গায় নতুন শাসকেরা এসেছে, কিন্তু শাসক-শাসিতের সম্পর্কে মৌলিক রদবদল ঘটেনি। ধনীরা গরিবদের জ্বালাতন করে। এ ঘটনা আগেও ছিল, এখনও আছে। ধনবৈষম্য আগের তুলনায় কমে তো নাই, বরঞ্চ বৃদ্ধি পেয়েছে। রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন না-আসার কারণ সমাজে বিপ্লব না ঘটা। উত্তরণের জন্য সমাজ পরিবর্তনের অব্যাহত সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। এ বিষয়ে আপসের কোনো সুযোগ দেখি না।

রাষ্ট্রের উন্নয়ন, সমস্যা থেকে উত্তরণ, এসব বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে দেশপ্রেম। সেটি আমাদের মাঝে বিন্দুমাত্র নেই বলেই চলে। কেন, কী কারণে অনুপস্থিত বলে মনে করেন?

দেশপ্রেম একেবারেই নেই, এটা সত্য নয়। আছে, তবে সবার ক্ষেত্রে সমানভাবে নেই। ধনীদের ক্ষেত্রে দেশপ্রেম কমছে। দুই কারণে। ধনীরা নিজেদেরকে দেশের গরিব মানুষদের সমপর্যায়ের মনে করে না। ভাবে তারা স্বতন্ত্র, কারণ তারা ধনী। তারা যে স্বতন্ত্র এটা প্রমাণ করার জন্য দেশের ভেতরেই তারা বিদেশিদের মতো আচরণ করে। তাদের জীবনাচার, ভোগ-বিলাসিতা, সর্বোপরি মাতৃভাষার প্রতি অনীহা, অনেকক্ষেত্রে অবজ্ঞা, প্রমাণ করে যে তারা দেশপ্রেমিক নয়। এরা ধরেই নেয় যে এদেশের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। তাই সম্পদ, সম্পত্তি, সন্তান-সন্ততি সবকিছু এরা বিদেশে পাচার করে, বিদেশে ঘরবাড়িও তৈরি করে রাখে। তবে, ধনীদের মধ্যেও এক ধরনের দেশপ্রেম জেগে ওঠে যখন তারা বিদেশিদের দ্বারা অপমানিত হয়। তখন তারা মানসিকভাবে দাঁড়াবার জায়গা খোঁজে, কিন্তু পায় না।

ধনীরা পুঁজিবাদী। পুঁজিবাদ একটি বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত ও কর্তৃত্বকারী বাস্তবতা। পুঁজিবাদ মানুষকে উৎপাটিত করে, নিরাশ্রয় করে ছাড়ে।

গরিব মানুষের জন্য কিন্তু বড় বিশ্ব বলে কিছু নেই; তাদের জন্য নিজের গ্রাম, শহর, দেশ এগুলোই হলো বিশ্ব। মাতৃভাষাই তাদের একমাত্র ভাষা। অন্য কোনো দেশ নেই, অন্য কোনো ভাষাও নেই। এরা যখন বিদেশে যায় তখনো দেশপ্রেমিকই থাকে। দেশের জন্য তাদের মন কাঁদে, খেয়ে না-খেয়ে টাকা পাঠায়, যে টাকার অনেকটাই ধনীদের তৎপরতার দরুন বিদেশে ফেরত চলে যায়। গরিব মানুষের শ্রমের ওপরই দেশ টিকে আছে। নইলে ভেঙে পড়ত। ধনীরা দেশের ক্ষতি করে; তারা তাদের দেশপ্রেমের নিম্নগামিতাকে অন্যদের মধ্যে সংক্রমিত করে দেয়। তাদের অত্যাচার-অনাচারে দেশের সুনাম ভূলুণ্ঠিত হয়।

সার্বিক ভাবনায় সামাজিক মুক্তি কিংবা রাষ্ট্র দর্শনের জায়গা থেকে যদি বলেন, আমাদের বর্তমান সমাজ কোন দিকে এগিয়ে চলছে? উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের চরিত্র কেমন?

বর্তমানে অগ্রগামিতা মোটেই ভালোর দিকে নয়; খারাপ দিকে বটে। উন্নতি যা ঘটছে তা বৈষয়িক ও বাহ্যিক; অন্তরালে বাড়ছে বৈষম্য। যত উন্নতি তত বৈষম্য বৃদ্ধি, এটা হয়ে দাঁড়িয়েছে নিয়মবিধি। এমন সুবিস্তৃত বৈষম্য আগে কখনো দেখা যায়নি। অর্থনৈতিক বৈষম্য দারিদ্র্য ও ক্ষোভ দুটোকেই বাড়িয়ে দিচ্ছে। ধনীরাই আদর্শ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের দেশপ্রেমহীনতা ও ভোগবাদিতা বঞ্চিত মানুষদের মধ্যেও সংক্রমিত হচ্ছে।

করোনার মতো মানবিক সংকটে বা মানুষের উন্নয়নে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণার ভূমিকা হতাশাজনক। তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে, গবেষণা কেন্দ্রের দায়িত্ববোধ কোন খেয়ালে চলে?

দেখুন, আমাদের প্রায় বিশ্ববিদ্যালয় কৃত্রিম প্রতিষ্ঠান। অধিকাংশই রাজনৈতিক কারণে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সামাজিক চাহিদা অনুসারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শুরু হয়নি। সে কারণে তাদের যোগাযোগ সম্পর্ক বা কাজ সাধারণ মানুষের জন্য হচ্ছে না। আর এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের শিক্ষার্থীদের মাঝেও সামাজিক দায়িত্ববোধ তৈরি করতে ব্যর্থ। ফলে কেউ সমাজ নিয়ে ভাবে না, খেয়াল তো দূরের কথা। এইভাবে বেখেয়ালে, দায়িত্বহীনভাবে চলছে।

Comments

The Daily Star  | English

DMCH doctors threaten strike after assault on colleague

A doctor at Dhaka Medical College Hospital (DMCH) was allegedly assaulted yesterday after the death of a private university student there, with some of his peers accusing the physicians of neglecting their duty in his treatment

4h ago