পুলিশ কি এই প্রথম কাউকে মারল?
কক্সবাজারের টেকনাফে পুলিশের গুলিতে একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তার নিহত হওয়ার পর দুটি অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে; ১. নিহত মেজর রাশেদ সিনহার পরিবারকে ফোন করে সান্ত্বনা এবং ন্যায়বিচারের আশ্বাস দিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ২. এই ঘটনায় সেনা ও পুলিশ বাহিনীর মধ্যে যে সম্পর্কের কোনো অবনতি হয়নি, সেটি জানানোর জন্য যৌথ সম্মেলন করেছেন সেনাপ্রধান এবং পুলিশ মহাপরিদর্শক।
ঘটনার পরে রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ের এই ক্রিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখে এরকম একটি প্রশ্ন উঠতে পারে যে, পুলিশ কি এই প্রথম কাউকে গুলি করে হত্যা করল? মেজর রাশেদ সিনহাই কি দেশের প্রথম ব্যক্তি, যাকে বিনা বিচারে হত্যা করা হয়েছে? দ্বিতীয় যে প্রশ্নটি সামনে আসতে পারে তা হলো, টেকনাফে যে ঘটনা ঘটল, এরকম ঘটনা কি দেশের আর কোথাও কোনোদিন ঘটেনি?
টেকনাফের এই ঘটনার সঙ্গে অতীতের কথিত ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের ঘটনাগুলোর মূল পার্থক্য নিহত ব্যক্তির পরিচয়ে। অতীতে যারাই এভাবে বিনা বিচারে হত্যার শিকার হয়েছেন, তার প্রায় সবগুলো ঘটনাকে ‘জায়েজ’ করা হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতি পরিচিত বিবৃতি বা বয়ানের মাধ্যমে—যেখানে সব সময়ই একই গল্প বলা হয়েছে যে, নিহতরা মাদক ব্যবসায়ী, সন্ত্রাসী, ধর্ষণ বা খুনের মামলার আসামি ইত্যাদি। এমনকি রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে বা বিরোধী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের দায়ে এভাবে বিনা বিচারে হত্যার ঘটনাগুলোর বয়ানও একইরকম—যার মধ্যে কিছু ঘটনা সত্য হলেও সাধারণ মানুষের কাছে সেসব সত্য ঘটনাও এখন আর বিশ্বাসযোগ্য হয় না।
মেজর সিনহাকে হত্যার পরেও পুলিশের তরফে সেই একই রকম ‘ক্লিশে’ বিবৃতি দিয়ে প্রমাণের চেষ্টা করা হয়েছিল, তিনি অপরাধী। টেকনাফ থানায় দায়ের করা মামলায় বলা হয়, সিনহা মো. রাশেদ খান এবং তার সঙ্গে গাড়িতে থাকা সিফাত পরস্পর যোগসাজশে সরকারি কর্তব্যকাজে বাধা প্রদান করেছে এবং হত্যার উদ্দেশ্যে অস্ত্র দিয়ে গুলি করার জন্য তাক করা হয়েছে। অভিযোগে আরও বলা হয়, ‘ড্রাইভিং সিটে বসা সেনাবাহিনীর মেজর পরিচয়দানকারী ব্যক্তি কিছুক্ষণ তর্ক করে গাড়ি থেকে নেমে এক পর্যায়ে তিনি হঠাৎ করে তার কোমরের ডান পার্শ্ব হতে পিস্তল বাহির করে গুলি করার জন্য উদ্যত হলে আইসি স্যার নিজের ও সঙ্গীয় অফিসার ফোর্সদের জানমাল রক্ষার্থে সঙ্গে থাকা তাহার নামে সরকারি ইস্যুকৃত পিস্তল হইতে চার রাউন্ড গুলি বর্ষণ করে।’ কিন্তু ঘটনাটি এখানেই শেষ হয়ে যায়নি। বরং বিষয়টি নিয়ে নড়েচড়ে বসে রাষ্ট্রের শীর্ষ মহল।
অন্যান্য ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধ নিয়ে সাধারণ মানুষ খুব বেশি প্রতিক্রিয়া না জানালেও সিনহার এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে তোলপাড় শুরু হয় সোশ্যাল মিডিয়ায়ও। ঘটনার পরে হত্যা মামলা হয় এবং তাতে সাত পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্তও করা হয়। হয়তো প্রচলিত আইনে ফৌজদারি অপরাধে তাদের বিচারও হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, মেজর সিনহার পরিচয় পাওয়ার পরও পুলিশ কেন তাকে লক্ষ্য করে গুলি করল এবং মৃত্যু নিশ্চিত করল; কী এমন প্রতিহিংসা ছিল; এই হত্যার পেছনে আসলেই কী কারণ রয়েছে এবং এটি পূর্ব পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড কি না—সেসব প্রশ্নের উত্তর কি জানা যাবে? গোয়েন্দারা সেসব প্রশ্নের উত্তর জানতে পারলেও দেশের মানুষ কোনোদিন তা জানতে পারবে?
গণমাধ্যমের খবর বলছে, কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার যে মেরিন ড্রাইভে টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশের নেতৃত্বে মেজর সিনহাকে গুলি করে হত্যা করা হলো, গেলো দুই বছরে এই মেরিন ড্রাইভে আরও শতাধিক লোককে কথিত ক্রসফায়ারে বা বিনা বিচারে হত্যা করা হয়েছে। একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, টেকনাফে গত ২২ মাসে প্রদীপের হাতে ১৪৪টি ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২০৪ জন। তাদের অর্ধেকের বেশি লাশ পড়েছিল এই মেরিন ড্রাইভে। যদিও মেজর সিনহাকে হত্যার অভিযোগে মামলা হয়েছে এবং ওসি প্রদীপসহ বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য গ্রেপ্তার হয়েছেন। এখন প্রশ্ন হলো, ওসি প্রদীপের আমলে আরও যেসব লোক এভাব নিহত হয়েছেন, তাদের পরিবার যদি হত্যা মামলা করতে চায়, তাহলে পুলিশ সেই মামলা নেবে বা রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায় থেকে সেসব পরিবারকে ন্যায়বিচারের আশ্বাস দেওয়া হবে?
প্রশ্ন হলো, মাদক ব্যবসায়ী অভিযোগে এ যাবৎ যত লোককে হত্যা করা হয়েছে, তাদের মধ্যে কতজন আসলেই মাদক ব্যবসায়ী ছিলেন এবং কত লোককে ঘুষের টাকা দিতে না পারায় হত্যা করা হয়েছে, সেই পরিসংখ্যানটি কি জানা যাবে? রাষ্ট্র কি এসব ঘটনার সঠিক ও নির্মোহ তদন্ত করবে? সহজ উত্তর, না। কারণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বিনা বিচারে এসব হত্যা এরইমধ্যে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়ে গেছে।
ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার ঘটনাগুলোর প্রতি সাধারণ মানুষেরও একধরনের সমর্থন তৈরি হয়ে গেছে। কিন্তু কেন সাধারণ মানুষ এরকম বিনা বিচারে হত্যাকে সমর্থন করে বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে কোনো শীর্ষ সন্ত্রাসী, মাদক কারবারি বা ধর্ষণে অভিযুক্ত নিহত হলে কেন মানুষ খুশি হয়, সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলেও দেখা যাবে—প্রচলিত আইন ও বিচারব্যবস্থায় অনেক সময়ই অপরাধ প্রমাণ করা কঠিন এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার জোরে আইনের ফাঁক গলিয়ে অপরাধীদের বেরিয়ে যাওয়ার প্রবণতা রয়েছে। অনেক সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্বল তদন্ত প্রতিবেদনের সুযোগ নিয়েও অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। আর এসব তদন্তের দুর্বলতার পেছনেও রয়েছে একশ্রেণির অসৎ লোকের ঘুষ খাওয়ার অভ্যাস এবং সেই ঘুষের টাকা কতদূর পর্যন্ত যায়, তাও আন্দাজ করা কঠিন নয়। ফলে মানুষ যখন দেখে যে, প্রচলিত বা স্বাভাবিক পথে বড় অপরাধীদের যেহেতু বিচার হচ্ছে না বা বিচারে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হচ্ছে, তখন তাদের কেউ যখন ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়, তখন মানুষ খুশি হয়। অনেক সময় বড় কোনো অপরাধীর নিহত হওয়ার পরে মানুষের মধ্যে মিষ্টি বিতরণের খবরও গণমাধ্যমে এসেছে।
সমস্যা হলো, এ পর্যন্ত যাদের ক্রসফায়ারে বা বিনা বিচারে হত্যা করা হয়েছে তাদের সবাই অপরাধী ছিলেন না—নারায়ণগঞ্জের সাত খুন তার বড় উদাহরণ। অর্থাৎ সন্ত্রাস, মাদক, ধর্ষণসহ বড় বড় অপরাধের অজুহাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অনেক প্রকৃত অপরাধীকে বিনা বিচারে হত্যা করার মধ্য দিয়ে যে বাহবা ও জনসমর্থন আদায় করেছে, সেই ইমেজকে কাজে লাগিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি অংশই এই কাজকে টাকা আদায়েরও হাতিয়ার বানিয়েছে। ধরে এনে ক্রসফায়ারের হুমকি দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় নতুন কোনো ঘটনা নয়। অনেক সময় পদোন্নতির জন্য এরকম সাহসী ঘটনার নাটক সাজানোর অভিযোগও রয়েছে।
গ্রেপ্তার ওসি প্রদীপের ব্যাপারে যেসব খবর গণমাধ্যমে এরইমধ্যে এসেছে, তা খুবই লোমহর্ষক। দেশের একটি শীর্ষ সংবাদপত্র শিরোনাম করেছে, ‘‘বন্দুকযুদ্ধে’ ভর করে সর্বোচ্চ পদক’। খবরে বলা হয়, ২০১৯ সালে পুলিশের সর্বোচ্চ পদক ‘বাংলাদেশ পুলিশ পদক’ বা বিপিএম পেয়েছিলেন। পদক পাওয়ার জন্য তিনি পুলিশ সদর দপ্তরে ছয়টি কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের কথা উল্লেখ করেন। সব কটি ঘটনাতেই আসামি নিহত হন। ভিডিও বার্তায় তিনি চলতি বছরের ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে টেকনাফকে মাদকমুক্ত করতে মাদক ব্যবসায়ীদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও হামলার হুমকি দিয়েও আলোচনায় আসেন। গত বছরের ২৮ আগস্ট ‘টেকনাফে বন্দুকযুদ্ধ, হয়রানি, ভাঙচুর আর গুমের নেপথ্যে’ শিরোনামে প্রথম আলোতে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় ২৯ আগস্ট প্রদীপ কুমার দাশ টেকনাফ মডেল থানায় সভা ডাকেন। সেখানে তিনি ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধের’ পক্ষে বক্তব্য দেন।
তবে এসব ঘটনায় ওসি প্রদীপ এতদিন নিজের বাহিনীর ভেতরে বাহবা কুড়ালেও এবং গুরুত্বপূর্ণ পদক পেলেও এবার একজন সাবকে সামরিক কর্মকর্তাকে হত্যার ঘটনায় ‘ফেঁসে’ গেছেন। শেষ পর্যন্ত তার কী বিচার হবে, তা দেখার জন্য দেশবাসীকে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু যে প্রশ্নটি বারবারই ঘুরেফিরে আসছে তা হলো, দেশে বিনা বিচারে হত্যা বন্ধ হবে কি না এবং বিচারের দীর্ঘসূত্রতা, তদন্তের দুর্বলতাসহ যেসব কারণে বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ড একধরনের বৈধতা বা জনসমর্থন পেয়ে আসছে, রাষ্ট্র সেই দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করবে কি না? নাকি বড় ধরনের অপরাধ দমনের পাশাপাশি ক্রসফায়ারকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের প্রবণতাও অব্যাহত থাকবে?
মেজর (অব.) সিনহার নিহত হওয়ার ঘটনায় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ এবং পুলিশের মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদের কক্সবাজার সফরের পর আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘অনাকাঙ্ক্ষিত এই ঘটনায় বাংলাদেশ পুলিশও অত্যন্ত মর্মাহত এবং পুলিশের পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হয়েছে, এটাই শেষ ঘটনা। ভবিষ্যতে এ ধরনের কোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না।’ প্রশ্ন হলো, এই আশ্বাসটা কিসের—বিনা বিচারে হত্যা বন্ধের নাকি পুলিশের গুলিতে আর কোনো সাবেক সেনা কর্মকর্তা নিহত হবেন না—সেটির?
আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)
Comments