গির্জার কেলেঙ্কারি এড়াতে ‘ধর্ষণকাণ্ড’ সালিশে নিষ্পত্তির চেষ্টা

রাজশাহীর ক্যাথলিক খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ধর্মযাজক প্রদীপ গ্রেগরি ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে ধর্মীয় ও নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের নেতারা নীরব থাকার বিনিময়ে ধর্ষিত কিশোরী এবং তার পরিবারের সদস্যদের ভবিষ্যতের দায়িত্ব নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সালিশে বিষয়টি নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করেছিলেন।
rape logo
প্রতীকী ছবি। স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

রাজশাহীর ক্যাথলিক খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ধর্মযাজক প্রদীপ গ্রেগরি ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে ধর্মীয় ও নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের নেতারা নীরব থাকার বিনিময়ে ধর্ষিত কিশোরী এবং তার পরিবারের সদস্যদের ভবিষ্যতের দায়িত্ব নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সালিশে বিষয়টি নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করেছিলেন।

র‌্যাব-৫ এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এটিএম মাইনুল ইসলাম জানান, ১৫ বছরের এক আদিবাসী কিশোরীকে তিনদিন ধরে তানোর উপজেলার এক গির্জায় আটকে রেখে ধর্ষণের অভিযোগে প্রদীপকে নগরীর উমোরপুর এলাকার রাজশাহী ক্যাথলিক ধর্মপ্রদেশ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। 

ঘটনাটি প্রকাশ হলে, রাজশাহীর খ্রিস্ট ধর্মপ্রদেশের নেতারা আদালতের বাইরে ধর্ষণের ঘটনাটি সমঝোতার চেষ্টা করেছিলেন। যদিও ১০ বছর আগে তাদের দ্বারা একই ধরনের একটি সমঝোতার চেষ্টা ভয়ানক ভুল প্রমাণিত হয়েছিল।

২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে গোদাগাড়ী উপজেলার একটি গির্জায় সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার শেরাফিনা মার্ডির ওপর জোর করে একটি সালিশি সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার পরপরই কিশোরী নিজের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং তার মৃত্যু হয়।

সেসময় ধর্ষণের সহায়তাকারী হিসেবে সংশ্লিষ্ট গির্জার ধর্মযাজককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।

সাম্প্রতিক ঘটনায়, ২৯ সেপ্টেম্বর তানোরের ভুক্তভোগী কিশোরীর ভাই ধর্মযাজক প্রদীপ গ্রেগরির বিরুদ্ধে তার নিয়ন্ত্রণাধীন গির্জার ভেতরের বাসায় আবদ্ধ রেখে ধর্ষণ করেছিলেন বলে অভিযোগ করে তানোর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। ওই রাতেই প্রদীপকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব।

সপ্তম শ্রেণি পড়ুয়া কিশোরীর ভাই দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘২৮ সেপ্টেম্বর স্থানীয় লোকেরা গির্জার অভ্যন্তরে প্রদীপের বাসভবনে একজন মেয়েকে দেখার পর রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের যাজকরা সালিশ করতে গির্জায় গিয়েছিলেন।’

এর আগে, ওই কিশোরীকে তিন দিন ধরে পাওয়া যাচ্ছিল না।

তার ভাই অভিযোগ করেছেন, স্থানীয়রা গির্জায় মেয়েটিকে খুঁজে পাওয়ার পরও গির্জা কর্তৃপক্ষ তাকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে অস্বীকার করেছিল, পুলিশকেও জানায়নি।

সালিশে আদিবাসী মাহলে সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দও উপস্থিত ছিলেন বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, ‘ঘটনাটি নিয়ে নীরব থাকলে কিশোরী ও তার পরিবারের সবার দায়িত্ব নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সালিশে উপস্থিত ধর্মীয় নেতারা।’

বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) রাজশাহীর সমন্বয়কারী সামিনা বেগম বলেন, ‘নারী ও শিশু ধর্ষণ এবং নির্যাতনের মামলাগুলো দেশের আইন অনুসারে আদালতে নিষ্পত্তি করা বাধ্যতামূলক।’

ব্লাস্ট প্রায়শই এ জাতীয় মামলাগুলো পরিচালনা করে থাকে।

তিনি বলেন, ‘ধর্ষণের মামলা আদালতের বাইরে নিষ্পত্তি করা একটি অপরাধ। এই ধরনের কার্যকলাপে জড়িতদের ধর্ষণে সহায়তাকারী হিসেবে অভিযুক্ত করা যেতে পারে।’

কিশোরীর ভাই তানোর থানায় তার দায়ের করা মামলায় (এফআইআর) সালিশ সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন বলে জানান রাজশাহীর অতিরিক্ত এসপি মাহমুদুল হাসান।

তিনি বলেন, ‘আমরা মামলাটি তদন্ত করে দেখছি। কেউ যদি অপরাধীকে সহায়তার সঙ্গে জড়িত থাকে, তবে পুলিশ আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে। অপরাধীকে বাঁচানোর চেষ্টা করা মানে অপরাধীকে সহায়তা করা।’

দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের বিশপ জার্ভাস রোজারিও স্বীকার করেছেন যে, তিনি বিষয়টি তদন্ত করার জন্য তিন ঊর্ধ্বতন ধর্মযাজক পল গোমেজ, উইলিয়াম মুর্মু এবং ইমানুয়েল রোজারিওকে তানোরের গির্জায় পাঠিয়েছিলেন।

তিনি জানান, তারা সেসময় ধর্ষণের অপরাধ সম্পর্কে অবগত ছিলেন না।

‘ঊর্ধ্বতন ধর্মযাজকরা আমাকে জানিয়েছিলেন যে, তারা উভয় পক্ষেরই (মেয়ে এবং অভিযুক্ত পাদ্রী) দোষ খুঁজে পেয়েছিলেন। মেয়েটি প্রদীপকে বিরক্ত করছিল এই বলে যে, সে তার সঙ্গে থাকতে চায়। অপরদিকে প্রদীপ আমাদের কাছে ধর্ষণের ঘটনা অস্বীকার করেছিলেন’, বলেন তিনি।

তিনি জানান, বৈঠককালে মেয়েটি তাদের কাছে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল যে, এই ঘটনাটির পর তার পরিবার তাকে গ্রহণ করবে না। সে কারণে কর্তৃপক্ষ মেয়ে এবং তার পরিবারকে রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।

‘এ ছাড়াও, আমরা গির্জা সম্পর্কে কেলেঙ্কারি এড়াতে চেয়েছিলাম’, বলেন তিনি।

তবে বিষয়টি দেখার জন্য এই ধর্মপ্রদেশের পাঠানো যাজক পল গোমেজ বলেছেন, ‘মেয়েটি যে গির্জায় শোষিত হয়েছিল, সেটির পক্ষে পর্যাপ্ত তথ্য পাওয়া গিয়েছিল।’

তিনি বলেন, ‘একটি মেয়ে তিন দিন ধরে নিখোঁজ এবং প্রিস্ট গ্রেগরি নিজের বাসভবনের ভেতরে তার অবস্থান জানার পরেও কাউকে এ বিষয়ে জানাননি। গ্রেগরি অবশ্য দাবি করেছিলেন, তিনি জানতেন না যে মেয়েটিকে তার পরিবার খুঁজছে।’

‘আমরা গির্জার পবিত্রতা কলঙ্কিত করার জন্য গ্রেগরির সর্বোচ্চ ধর্মীয় মান্ডলিক শাস্তির সুপারিশ করেছি’, বলেন তিনি।

তিনি স্বীকার করেন যে, তারা বিষয়টি পুলিশকে জানাননি।

তিনি জানান, তারা সালিশের সময় মেয়েটির পরিবারকে সুরক্ষা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং মেয়েটিকে রক্ষা করার জন্যই পুলিশকে অবহিত করেনি।

বিশপ রোজারিও বলেন, ‘অভিযুক্ত পুরোহিতকে রাজশাহী ক্যাথলিক ধর্মপ্রদেশে পাঠানো হয়েছিল এবং তার যাজকের পদ সাময়িকভাবে প্রত্যাহার করা হয়েছিল।’

স্থানীয় সম্প্রদায়ের নেতা মাইকেল হেমব্রম, মহেশ মুর্মু এবং কামেল মার্ডিও সালিশে উপস্থিত ছিলেন বলে জানান মেয়েটির ভাই।

২৯ সেপ্টেম্বর কামেল মার্ডি সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘আমরা সবার মঙ্গলের জন্য বিষয়টি নিজেদের মধ্যে সমাধান করার চেষ্টা করেছিলাম।’ তিনি আর কোনো বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেননি।

জানতে চাইলে মেয়েটির ভাই বলেন, ‘বৈঠক চলাকালে আমি নিজেকে কোণঠাসা বোধ করেছিলাম। মনে হচ্ছিল যেন আমার বোনেরই সব দোষ ছিল। আমি বুঝতে পেরেছিলাম সেখানে আমরা ন্যায়বিচার পাব না। সুতরাং, আমি ঘটনাটি পুলিশকে জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।’

‘বৈঠক শেষে রাজশাহীর পুরোহিতরা গ্রেগরিকে সঙ্গে নিয়ে শহরে গিয়েছিলেন। তখন আমার মনে হয়েছিল যেন তারা তাকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন, যেহেতু স্থানীয়রা এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে শুরু করেছিলেন’, বলেন তিনি।

তানোর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রকিবুল হাসান জানান, তারা মেয়েটির মেডিকেল প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা করছেন।

তিনি বলেন, ‘মেয়েটি ইতিমধ্যে রাজশাহী আদালতে তার জবানবন্দী দিয়ে বলেছেন যে, তিনি গির্জায় আটক থাকাকালে ধর্ষিত হয়েছিলেন।’

Comments

The Daily Star  | English

At least 76 RMG workers injured in Cumilla

At least 76 garment workers were injured when they tried to rush to exit the factory building in Chauddagram of Cumilla after a 5.6 tremor jolted the country this morning

Now