অজানা ইতিহাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ‘রামমালা গ্রন্থাগার’

মানব জীবনে জ্ঞানই শক্তি। অজ্ঞানতাই সর্ববিধ দুঃখের মূল উৎস। তাই জ্ঞান অর্জনের জন্য গ্রন্থাগার খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এমনি একটি অসামান্য গ্রন্থাগার অখণ্ড ভারতের বাতিঘর, ঐতিহ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কুমিল্লার ‘রামমালা গ্রন্থাগার’। প্রতিষ্ঠাতা দানবীর মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য। গ্রন্থাগারের নামের পাশে তার নামও নন্দিতভাবে উচ্চারিত হচ্ছে পাঠকের কাছে।
1.jpg
রামমালা গ্রন্থাগার। ছবি: স্টার

মানব জীবনে জ্ঞানই শক্তি। অজ্ঞানতাই সর্ববিধ দুঃখের মূল উৎস। তাই জ্ঞান অর্জনের জন্য গ্রন্থাগার খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এমনি একটি অসামান্য গ্রন্থাগার অখণ্ড ভারতের বাতিঘর, ঐতিহ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কুমিল্লার ‘রামমালা গ্রন্থাগার’। প্রতিষ্ঠাতা দানবীর মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য। গ্রন্থাগারের নামের পাশে তার নামও নন্দিতভাবে উচ্চারিত হচ্ছে পাঠকের কাছে।

১৯১২ সালে প্রতিষ্ঠাতার কুমিল্লার বাড়ির বৈঠকখানা ঘরে একটি সংস্কৃত গ্রন্থাগার স্থাপিত হয়। সেসময় ঈশ্বর পাঠশালা টোলের অন্যতম পণ্ডিত শ্রীযুক্ত সূর্যকুমার স্মৃতিতীর্থ গ্রন্থাগারের কাজ পরিচালনা করতেন। কাশীধাম হতে মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত অন্নদাচরণ তর্কচূড়ামণি এবং কলকাতা হতে পণ্ডিত গুরুচরণ তর্কদর্শনতীর্থ গ্রন্থাগারের জন্য প্রয়োজনীয় শাস্ত্রগ্রন্থের তালিকা করে পাঠাতেন। তখন ৪-৫টি আলমারিতে পুস্তকসমূহ রক্ষিত থাকতো। অধ্যাপক দ্বিজদাস দত্ত, দেওয়ান বাহাদুর বঙ্গচন্দ্র ভট্টাচার্য, নবীনচন্দ্র ব্যাকরণতীর্থ এবং শ্রীযুক্ত সূর্যকুমার স্মৃতিতীর্থ প্রধানত শাস্ত্রগ্রন্থসমূহ পাঠ করতেন। সংস্কৃত ভাষায় লিখিত শাস্ত্রগ্রন্থ সাধারণ পাঠকের বোধগম্য হয় না, এ কারণে স্থানীয় কতিপয় বিশিষ্ট ব্যক্তির অনুরোধে কিছু কিছু বাংলা পুস্তক এবং প্রবাসী, ভারতবর্ষ প্রভৃতি প্রধান প্রধান মাসিক পত্রিকাও রাখতে শুরু করে। ক্রমে গ্রন্থাগারে হস্তলিখিত প্রাচীন পুঁথিও সংগৃহীত হতে আরম্ভ হয়। এ পুঁথিসমূহ ভোজ্যপত্র, ভোজপাতা, তলুট কাগজ ও তালপাতায় লেখা। প্রায় ২০০ বছরের আগের পুঁথি এখনো রক্ষিত আছে অখণ্ড ভারতের এই আলোকিত ঘরে।

ছবি: স্টার

গ্রন্থাগারের কথা বলতেই প্রিয় সাহিত্যিক রাজকুমার মুখোপাধ্যায়ের কথা মনে পড়ে। তিনি লিখেন, ‘অনেকে মনে করেন, আমেরিকার গ্রন্থাগারের উন্নতির মূলে রয়েছে রাষ্ট্র। কিন্তু তা সত্যি নয়, সেখানেও গ্রন্থাগারের সত্যিকার উন্নতি আরম্ভ হয় অ্যান্ড কার্নেগীর মহানুভবতার ফলে এবং আজও সোজাসুজিভাবে রাষ্ট্র গ্রন্থাগারের জন্য অর্থ ব্যয় করে না। ব্যাপারটায় যেন বেশ একটু আশ্চর্য লাগে! কিন্তু এতে আশ্চর্যান্বিত হবার কিছু নেই; তার কারণ, জনসাধারণের গ্রন্থাগার জনসাধারণের এবং জনসাধারণই গ্রন্থাগারের উন্নতির জন্য অর্থ ব্যয় করবে। গ্রন্থাগারের উন্নতির জন্যে যে সামান্য অর্থ ব্যক্তিগতভাবে ব্যয় করতে হয়, সে অর্থ ব্যয় করতে জনসাধারণ মোটেই বিমুখ হয় না। তার কারণ, জনসাধারণ সেখানে গ্রন্থাগারের মূল্য বোঝে- গ্রন্থাগার যে তাদের কতোটা প্রয়োজন মেটাতে পারে, সেখানকার জনসাধারণ জানে।’

তেমনি বাংলার এক কৃতি সন্তান মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য। মানব জীবনে মহৎ উদ্দেশ্য সাধনে যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে দেশ ও জনগণের মঙ্গলের জন্য জীবন উৎসর্গ করে গেছেন, দানবীর মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য তাদের অন্যতম। কঠোর শ্রম, ন্যায়পরায়ণতা, অধ্যবসায়, আত্মবিশ্বাস এবং মহৎ আদর্শের ওপর নির্ভর করে তিনি নিতান্ত দরিদ্র অবস্থা থেকে জীবন সাধনায় সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। একদা কঠোর দারিদ্রের জন্য লেখাপড়া করার সুযোগ না পেয়েও পরবর্তীতে অর্থ উপার্জন করে দেশের সেবা করে গেছেন। এই পুণ্যলোক মহাপুরুষ কুমিল্লা (প্রাক্তন ত্রিপুরা), অধুনা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর থানাধীন বিটঘর গ্রামে ১২৬৫ বঙ্গাব্দে ১৭ অগ্রহায়ণ জন্মগ্রহন করেন। তার পিতা ঈশ্বরদাস তর্কসিদ্ধান্ত সুপণ্ডিত ছিলেন এবং মাতা রামমালা দেবী দেব দ্বিজে ভক্তিপরায়ণ নারী ছিলেন। পিতা-মাতার সত্য ও ন্যায়ের আদর্শ তার জীবনে প্রভাব বিস্তার করেছে সবচেয়ে বেশী। মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য তার উপার্জিত অর্থ দেশ ও জনগণের সেবায় ব্যয় করে আমাদের সবার সম্মুখে যে আদর্শ স্থাপন করেছেন, তা অনন্য। ‘রামমালা গ্রন্থাগার’ তার অমর কীর্তির মধ্যে অন্যতম। প্রতিষ্ঠাতা মায়ের নামে ১৯১২ সালে জ্ঞানীদের তথা এ অঞ্চলের জ্ঞান পিপাসীদের গবেষণার সুবিধার্থে রামমালা গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেন। মফস্বলের গবেষক ও দরিদ্র ছাত্রদের কল্যাণে এই প্রতিষ্ঠান বিরাট ভূমিকা পালন করছে।

ছবি: স্টার

বর্তমানে এর তিনটি বিভাগ চালু আছে। যেমন: (১) গবেষণা বিভাগ: এ বিভাগ সম্পর্কে গ্রন্থাগারের বর্তমান দায়িত্বে থাকা ইন্দ্র কুমার সিংহ বলেন, ‘এ বিভাগটি ভারতীয় সংস্কৃতি, বেদ ও তুলনামূলক ধর্ম, এই তিন পাঠে বিভক্ত।’

ক. ভারতীয় সংস্কৃতি: প্রাচীন ভারতে এক অভিনব সভ্যতার উদয় হয়েছিল। এ সভ্যতার উজ্জ্বল নিদর্শন বিশাল সাহিত্য-সম্পদ। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের পণ্ডিতমণ্ডলীর সযত্ন গবেষণায় প্রাচীন ভারতের ধ্বংসপ্রাপ্ত সভ্যতার ওপর বহু দুর্লভ গ্রন্থ রচিত হচ্ছে। সুপ্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য-সম্পদ সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রচার এবং যুগে যুগে আসা মহামানবের দেখানো কিংবা গড়া তীর্থক্ষেত্রগুলো বিশ্বে আত্মপ্রকাশ করুক, এমনটিই ‘রামামালা গ্রন্থাগার’ প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য।

খ. বেদ: পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত, ভগবত, মনুসিংহতা, শকুন্তলম ও তন্ত্রম। কাব্য- কবি কালিদাসের সংস্কৃত ও অনূদিত গ্রন্থাবলী। বৌদ্ধধর্ম- ত্রিপিটক মূল, হীনযান ও মহাযান। জৈনধর্ম- মূল অনুবাদ। বৈদ্যক- চরম সংহিতা, সুশ্রুত সংহিতা। জ্যোতিষ- হোরাবিজ্ঞান, রহস্যম, জ্যোতিষ যোগতত্ত্ব, সূর্য সিদ্ধান্ত, ন্যায় ও মীমাংসা সাহিত্য দর্শন, প্রিঙ্গেল সূত্র, ক্লাসিক্যাল সাহিত্য, প্রাচীন বৃহত্তর ভারত, অর্থশাস্ত্র, নীতিশাস্ত্র, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, অলংকার সাহিত্য দর্শন।

গ. তুলনামূলক ধর্ম: The Sacred Books of the East, The Encyclopedia oF Religion and Ethics, The Sayings of Confucius, Confucianism and Taoism, The Divan of Hafiz, হাদিস (বঙ্গানুবাদ গিরিশচন্দ্র সেন), The Encyclopaedia of Islam, বৈঞ্চব ধর্মের ওপর বিশেষত গৌড়ীয় বৈঞ্চব ধর্মেও সংস্কৃত ভাষার রচিত শ্রীপাদ সনাতন গোস্বামী ও শ্রীপাদ অরূপ গোস্বামী রচিত অতি দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ, চৈতন্য চরিতামৃত, রাঁধা গোবিন্দ নাথ রচিত গৌড়ামী বৈঞ্চব দর্শন (৫ম খণ্ড) প্রভৃতি গ্রন্থ আছে।

শ্রীমদ্ভগবদগীতার মূল, অনুবাদ, বিদগ্ধ পণ্ডিতবর্গের আলোচনামূলক দুর্লভ গ্রন্থও গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে। এ ছাড়াও, গবেষণা বিভাগে পাওয়া যাচ্ছে- রবীন্দ্র রচনাবলী, অরবিন্দ সাহিত্য, শরৎ সাহিত্য, ইংরেজি নাটক, মহাকাব্য, কবিতা ও গদ্যসাহিত্য। H. G. Wells এর The Outline of History, Peoples of All Nations, The Historians' History of the World, Asoka and Inscriptions প্রভৃতি গ্রন্থরাজি রক্ষিত আছে।

(২) সাধারণ বিভাগ: এ বিভাগের গ্রন্থরাজি বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় লেখা। বাংলা ভাষায় লেখা সর্বসাধারণের পাঠোপযোগী ধর্ম, দর্শন, নীতিশাস্ত্র, ইতিহাস, প্রবন্ধ,  কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ সাহিত্য, স্বরুপানন্দ রচনা, দেশ-বিদেশের জীবনী, ভ্রমণকাহিনী, ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক, ছোটদের রূপকথা গ্রন্থসহ সাধারণ গ্রন্থ। রয়েছে বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি পত্রিকাসহ সাপ্তাহিক, মাসিক ও ত্রৈমাসিক সাময়িকী পত্রিকা।

বাংলা পত্রিকা: আনন্দবাজার, যুগান্তর, লোকসেবক, পূর্বদেশ, দেশ, প্রবাসী, বসুমতী, ভারতবর্ষী, মানসী, মর্মবাণী, উদ্বোধন, বণিক (মহেশ চন্দ্র পরিচালিত), সবুজপত্র, গৃহস্থ, গৃহলক্ষ্মী, মোহাম্মদী, স্বাস্থ্য-সমাচার, চুল্টাপ্রকাশ, ত্রিপুরাহিতৈষী, সংঘ-শক্তি, পূবার্শাসহ আরও অনেক সাময়িক পত্রিকা এ বিভাগে রয়েছে।

হিন্দি পত্রিকা: বৈদিক ধর্ম, কল্যাণ ধর্ম-দূত, হরিজন (বাংলা-ইংরেজি), চেরাগ, যুগধর্ম, সরস্বতী, চণ্ডী, চাঁদ ভূদান যজ্ঞ (বাংলা) এ বিভাগে রক্ষিত আছে।

ইংরেজি পত্রিকা: Prabuddha Bharat, The Modern Review, Calcutta Review, The  Indian Historical Quarterly, Indian Culture, Hindu College Magazine and Comilla Victoria College, The Journal of the Asiatic society of Bangal, The Philosophiacal Quarterly, Time and Annie Besant Centanary Book এ বিভাগে আছে।

ছবি: স্টার

(৩) পুঁথি বিভাগ: এ বিভাগে হস্তলিখিত প্রাচীন সংস্কৃত ও বাংলা পুঁথি সংগ্রহে আছে। এখানে আছে তিন থেকে চারশো বছর আগের অধিকাংশ সংস্কৃত বই, যার মধ্যে প্রায় দুই হাজার তালপাতায় লেখা। বাংলায়ও আছে দুই হাজারের কাছাকাছি। প্রতিষ্ঠাতা রামমালা গ্রন্থাগারের জন্য পুঁথি সংগ্রহের পরিকল্পনা করেছিলেন এবং ক্রমে প্রায় আট হাজার পুঁথি সংগৃহীত হয়। ত্রিপুরা (বর্তমানে কুমিল্লা), নোয়াখালী ও শ্রীহট্ট জেলা থেকে এ সব পুঁথি সংগ্রহ করা হয়েছে। যারা রামমালা পুঁথি বিভাগে পুঁথি দান করেছেন, তাদের নাম মুদ্রিতাকারে লিপিবদ্ধ করা আছে। মুদ্রিত তালিকা অনুসারে দেখা যায়, ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত ২৭ জন ব্যক্তি রামমালা পুঁথি বিভাগে পুঁথি দান করেছেন। সংগৃহীত পুঁথির বিষয় হচ্ছে- বেদ, তন্ত্র, কোষগ্রন্থ, কাব্য, ব্যাকরণ, জ্যোতিষ, ইতিহাস, পুরাণ, ধর্ম, রামায়ণ, মহাভারত, সত্যনারায়ণ পাঁচালী, সত্যপীরের পুঁথি ও শনির পাঁচালী প্রভৃতি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে এক চুক্তিতে রামমালা পুঁথি বিভাগের প্রায় আড়াই হাজার পুঁথি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য মাইক্রোফিল্ম করা হয়েছে। দেশ-বিদেশের বহু গবেষক রামমালা পুঁথি বিভাগে বিভিন্ন পুঁথির ওপর গবেষণার জন্য আসেন। রামমালা গ্রন্থাগারের সাবেক প্রধান গ্রন্থাগারিক পণ্ডিত প্রবর রাসমোহন চক্রবর্তী ১৯৪১ সালে মেহেরের সর্বানন্দ ঠাকুর বিরচিত ‘সর্বোল্লাস সংস্কৃত তন্ত্র’ পুঁথিটি সংকলন করে দেশের পণ্ডিত সমাজের প্রশংসা অর্জন করেন। সর্বোল্লাস তন্ত্রেও এ সংকলনটি ১৩৪৬ বাংলা আশ্বিন সংখ্যায় ‘উদ্বোধন’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। অনেকে মনে করেন- রামমালা গ্রন্থাগারের পুঁথি বিভাগ ভারতীয় উপমহাদেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সভ্যতার ধারণ, বহন ও প্রচারের এক বলিষ্ঠ মাধ্যম।

এ ছাড়া, বিভিন্ন ধর্মের ধর্মগ্রন্থ এই গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে, যাতে সাধারণ পাঠকের জন্য জীবন-চরিত্র গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। পুঁথি বিভাগে প্রাচীন সংস্কৃত ও বাংলা পুথি আছে। পাঠকের কাছ থেকে কোনো ধরণের ফি বা অর্থ গ্রহণ করা হয় না। যেকোনো পাঠক ও গবেষক এই গ্রন্থাগারে অধ্যয়ন করতে পারেন। এটি সবার জন্য উন্মুক্ত।

কবি ইসহাক সিদ্দিকী ১৯৮৭-৮৮ সালের দিকে নিয়মিত রামমালা গ্রন্থাগারে যাতায়াত করতেন। কবি জানান- রামমালা গ্রন্থাগারে দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ ছিল, যে গ্রন্থগুলো কলকাতায়ও পাওয়া যেত না। অসংখ্য মানুষ দূর থেকে এখানে আসতেন। প্রয়োজনীয় বইও সহজে পাওয়া যেত। কারণ- রামমালা গ্রন্থাগারের সব বইয়ের একটি পরিচ্ছন্ন সূচিপত্র ছিল, যা অন্য কোথাও নেই। ছিল অসংখ্য মোগল যুগের মুদ্রা এবং প্রত্নতত্ত্ব। তিনি বলেন, ‘পাঠক হিসেবে জানতে চাই- এগুলো কোথায়?’

বর্তমানে পুঁথি বিভাগের অমূল্য পুঁথিসমূহ (প্রায় আড়াই হাজার) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাইক্রোফিল্ম করে রেখেছে। এটি একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। আমাদের দেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে রামমালা গ্রন্থাগারের অবদান অসীম। গবেষক ও অনুসন্ধানীদের জন্য রামমালা গ্রন্থাগার প্রিয় থেকে সুপ্রিয়। বিখ্যাতদের অনেকে এই গ্রন্থাগার থেকে পড়ে গেছেন।

‘২৮ মার্চ ১৯৩৮ সালে অধ্যাপক হুমায়ূন কবির কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রামমালায় আসেন। মন্তব্য বইয়ে লিখে যান- ছাত্রাবাসের সঙ্গে যে গ্রন্থাগার, সেটিও বিস্ময়কর। মফস্বল টাউনে তুলনামূলক ধর্মালোচনার এরূপ সংগ্রহ আমি আর কোথাও দেখিনি। জ্ঞানান্বেষী ও গবেষকের জন্য অমূল্য সম্পদ এখানে সঞ্চিত। প্রতিষ্ঠাতাকে সশ্রদ্ধ অভিনন্দন জানাচ্ছি।’

কুমিল্লা শহরের উপকণ্ঠে শাকতলা নামক স্থানে (বর্তমানে কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের বিপরীতে) মূল রামমালা গ্রন্থাগার ভবন নির্মাণ করা হয়। ১৯৫৩ সালে সুদৃশ্য এই ভবনে রামমালা গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা এ অঞ্চলে এক বিরাট ঘটনা। শান্ত নিবিড় পল্লীর কোলে আলোয় জ্বলে উঠে রামমালা। আলোকিত হয় এই জনপদ। জ্ঞানের সাগর এই গ্রন্থাগারে পণ্ডিত প্রবর রাসমোহন চক্রবর্তীসহ অনেক জ্ঞানী-গুণী অধ্যয়ন ও গবেষণা করেছেন। জ্ঞানের আলোকে মনের অন্ধকার দূর করে চিরসুন্দর হয়ে সমাজ ও দেশের জনগণের মহান সেবায় ব্রতী বিদ্যার্থী ও গবেষকরা এই রামমালা গ্রন্থাগারে আসেন।

মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য চিন্তা করেছিলেন, গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করলে শিক্ষা ও গবেষণা অগ্রসর হবে। মানুষ জ্ঞানের মাধ্যমে পরস্পরকে জানতে ও বুঝতে পারবে। গ্রন্থাগারই একমাত্র প্রদীপ, যা সর্বদা আলো বিতরণ করে, কিন্তু কখনো কিছু প্রত্যাশা করে না। ধর্ম-দর্শন ও বিজ্ঞান আলোচনায় মানুষের ভ্রান্তি দূর হয় এবং জ্ঞানের শান্ত ছায়ায় মানুষ চির প্রশান্তি লাভে সমর্থ হয়। তিনি ১৯১২ সালে মায়ের নামে প্রতিষ্ঠা করেন ‘রামমালা গ্রন্থাগার’, সেখানে আবার বাবার নামে ১৯১৪ সালে প্রতিষ্ঠা করেন কুমিল্লা ঈশ্বর পাঠশালা এবং ১৯১৬ সালে রামমালা ছাত্রাবাস। বর্তমানে ছাত্রাবাসে ৮৪ জন ছাত্র আছে, যাদের খুব কম টাকায় থাকা-খাওয়া হচ্ছে। ১৯১৭ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন দেবালয়। ১৯১৯ সালে নিবেদিতা ছাত্রী নিবাস (৬২ জন ছাত্রী আছে বর্তমানে) ও প্রাথমিক বিদ্যালয়। তিনি ১৯২৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন নাট্য মন্দির। পরের বছর ১৯২৬ সালে রামমালা ছাত্রাবাসের ছাত্ররা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সংবর্ধনা দেয়। সেই ঐতিহ্যবাহী রামমালা গ্রন্থাগারে সুদূর ব্রিটিশ লাইব্রেরী থেকেও গবেষকরা আসেন। খুঁজে নেন আগ্রহের দুলর্ভ তথ্য।

গবেষণা বিভাগে ইসলাম ধর্ম দর্শন, বৌদ্ধ ধর্ম দর্শন, খ্রিষ্টান ধর্ম দর্শন এবং অপরাপর ধর্ম ও দর্শনের বিভিন্ন গ্রন্থ আছে। এ ছাড়া, ইতিহাস, বাংলা সাহিত্য ও দর্শনের গ্রন্থ আছে। সাধারণ বিভাগে ছাত্র/ছাত্রীসহ সাধারণ পাঠকের উপযোগী জীবন গ্রন্থ, ইতিহাস, ভ্রমণ বৃত্তান্ত, উপন্যাস প্রভৃতি গ্রন্থ ও পত্র-পত্রিকা আছে। পুঁথি বিভাগে সনাতন ধর্ম ও দর্শনের প্রাচীন শাস্ত্র গ্রন্থ ও সংস্কৃতি বিষয়ক হস্তলিখিত গ্রন্থ আছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে অর্থের বিনিময়ে এই পুঁথি সংগ্রহ করা হয়েছে।

লেখক: ইমরান মাহফুজ, কবি, গবেষক

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Over 5,500 held in one week

At least 738 more people were arrested in the capital and several other districts in 36 hours till 6:00pm yesterday in connection with the recent violence across the country.

14h ago