পরীক্ষা কার, সন্তানের না আপনার?

আমার মেয়ে রাজধানীর গ্রীন রোডের একটি স্কুলে নার্সারিতে পড়ে। করোনার কারণে গত মার্চ থেকে স্কুল বন্ধ। এবার বার্ষিক পরীক্ষাও হবে না। শিশুদের পরীক্ষা দূরে থাক, এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষাও হচ্ছে না। এরই মধ্যে সরকারি ঘোষণা এসেছে যে, মূল্যায়নের ভিত্তিতে ফলাফল দেওয়া হবে। মানে শত ভাগ পাস।

আমার মেয়ে রাজধানীর গ্রীন রোডের একটি স্কুলে নার্সারিতে পড়ে। করোনার কারণে গত মার্চ থেকে স্কুল বন্ধ। এবার বার্ষিক পরীক্ষাও হবে না। শিশুদের পরীক্ষা দূরে থাক, এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষাও হচ্ছে না। এরই মধ্যে সরকারি ঘোষণা এসেছে যে, মূল্যায়নের ভিত্তিতে ফলাফল দেওয়া হবে। মানে শত ভাগ পাস।

শিশুদের পরীক্ষা আদৌ প্রয়োজন কি না, বা কোন ক্লাস থেকে পরীক্ষা নেওয়া উচিত, সেই প্রশ্নটি বহু দিনের। তারও চেয়ে বড় প্রশ্ন, পরীক্ষার ব্যবস্থা না থাকলে শিশু এক বছরে কী শিখল, সেটির মূল্যায়ন হবে কী করে? পরীক্ষা মানে একটা চাপ। একটা ন্যূনতম চাপ না থাকলে তারা পড়তে চায় না। এটা নন অ্যাকাডেমিক পড়ালেখা নয় বা ‘রিডিং ফর প্লেজার’ কিংবা ‘রিডিং ফর রিসার্চ’ নয় যে, সে কেবল আনন্দ বা বিশেষ কোনো কাজের প্রয়োজনে পড়ালেখা করবে। বরং শিশুদের পড়ালেখায় প্লেজার বা আনন্দ থাকাটা যেমন জরুরি, তেমনি বছরে কয়েকটি পরীক্ষার ব্যবস্থা না থাকলে তাকে ওই পরীক্ষার ভয় না দেখিয়ে পড়ার টেবিলে নেওয়া মুশকিল।

শিশুদের পরীক্ষার পদ্ধতি কী হবে—সেটি বিভিন্ন ধরনের স্কুলের উপর নির্ভর করে। এ বিষয়ে সরকার একটি সমন্বিত বা একক পদ্ধতি ঠিক করে দেবে কি না, সেটি নিয়েও আলোচনা আছে।

আমাদের দুশ্চিন্তা ছিল, যেহেতু মার্চ মাস থেকে সন্তানের স্কুল বন্ধ এবং শিশুরা বাসায় খুব একটা পড়তে বসতে চায় না; অনলাইন ক্লাস হলেও তাতে তাদের মনযোগী করা কঠিন; তার ওপর সুরক্ষার কথা ভেবে দীর্ঘদিন ধরে গৃহবন্দী থাকতে থাকতে তারাও বিরক্ত—সব মিলিয়ে পরবর্তী ক্লাসে তারা কী করে উঠবে? বাস্তবতা বিবেচনায় স্কুল কর্তৃপক্ষ সবাইকে পাস করিয়ে পরের ক্লাসে নিশ্চয়ই নিয়ে যাবে, কিন্তু এই আগের ক্লাসে তাদের যেটুকু শেখার কথা ছিল, তা কি শিখতে পেরেছে? এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে স্কুলের নোটিশ পেয়ে গত ৮ অক্টোবর সকালে স্কুলে গিয়ে মূল্যায়ন ফরম এবং বই-খাতা নিয়ে আসি। সেই প্রসঙ্গে এই লেখা। এই লেখাটি যাদের সন্তানরা এরকম পরীক্ষা ছাড়াই উপরের ক্লাসে উঠে যাবে, তাদের জন্য।

স্কুল থেকে কয়েকটি খাতা এবং পরীক্ষার মূল্যায়ন শিট দেওয়া হয়েছে। সঙ্গে একটি নির্দেশনা। তাতে লেখা রয়েছে: বাসায় বসেই সন্তানের পরীক্ষা নেবেন অভিভাবকরা। অর্থাৎ অভিভাবকরাই এখানে পরীক্ষক। কিন্তু নিজের সন্তানের পরীক্ষা নেওয়ার ক্ষেত্রে তারা (অভিভাবক) যাতে সৎ থাকেন, সেই অনুরোধও রয়েছে।

ক্লাস অনুযায়ী নির্দিষ্ট তারিখে মূল্যায়ন শিট স্কুলে জমা দিয়ে আসতে হবে। তবে সরাসরি মূল্যায়ন শিটে পরীক্ষা দিয়ে যাতে শিশুরা কাগজটি নষ্ট করে না ফেলে বা খুব বেশি কাটাকুটি না করে, সেজন্য খসড়ার জন্য শিটও দেওয়া হয়েছে। সঙ্গে বাসায় চর্চার জন্য আরও কিছু খাতা। সব মিলিয়ে পদ্ধতিটা দারুণ। কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষ অনুরোধ জানিয়েছে, সন্তানের পরীক্ষা নেওয়ার ক্ষেত্রে অভিভাবকরা ‘সৎ’ থাকবেন। মানে যেহেতু স্কুলের শিক্ষক এই পরীক্ষাটি নিচ্ছেন না বা স্কুলে বসেও পরীক্ষাটি হচ্ছে না, তাই অভিভাকরাই সন্তানের পরীক্ষক হলেও পরীক্ষা নেওয়ার ক্ষেত্রে অভিভাবকের আচরণ যেন কোনোভাবেই পক্ষপাতদুষ্ট না হয়।

অভিভাবক হিসেবে আমার মনে কিছু প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। যে প্রশ্নগুলো সেইসব অভিভাবকের প্রতি, যারা এভাবে বাসায় বসে সন্তানের মূল্যায়ন পরীক্ষা নিয়ে স্কুলে পরীক্ষার খাতা জমা দেবেন বা দিচ্ছেন।

১. ছোট ছোট সন্তানের বার্ষিক পরীক্ষার ফাঁস হওয়া প্রশ্ন কেনেন বা দ্বিতীয় তৃতীয় শ্রেণির পরীক্ষার প্রশ্নও পরীক্ষার আগের রাতে কোথাও পাওয়া যায় কি না, এজন্য সোশ্যাল মিডিয়াসহ নানা জায়গায় খোঁজ-খবর করেন যে অভিভাবকরা…

২. স্কুলে অুনষ্ঠিত পরীক্ষায় সন্তানকে নকল সরবরাহ করেন বা এরকম মানসিকতা রাখেন যে অভিভাবকরা…

৩. সন্তানকে জিপিএ ফাইভ পেতে হবেই, না হলে জীবনটাই বৃথা—এই মানসিকতা লালন করেন যে অভিভাকরা…

৪. সন্তানকে ক্লাসে ফার্স্ট হতে হবে; গান-আবৃত্তি-অঙ্কন এমনকি দৌড় প্রতিযোগিতায়ও প্রথম হতে হবে বলে মনে করেন যে অভিভাবকরা…

৫. স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে কী শিখল, কতটুকু মানবিক ও দেশপ্রেমিক হলো, সেটি ভাবনার দূরে রেখে পড়ালেখা শেষ করেই সন্তান মোটা বেতনের ‘চাকর’ হবে এবং পারতপক্ষে দেশে থাকবে না; এই দেশে থাকলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার; এখানে কি মানুষ থাকে—ইত্যাদি মানসিকতা পোষণ করেন যে অভিভাবকরা…

৬. মোটা অঙ্কের ঘুষ দিয়ে বিশেষ স্কুলে সন্তানকে ভর্তি করেছেন যে অভিভাবকরা…

৭. অবৈধভাবে অর্জিত পয়সায় কেনা খাবার দিয়ে সন্তানের শরীর গড়ে তুলেছেন যে অভিভাবরা…

সেই অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের মূল্যায়ন পরীক্ষায় কতটা সৎ, পক্ষপাতমুক্ত ও নির্মোহ থাকতে পারবেন?

অতএব বাসায় বসে সন্তানের পরীক্ষা নেওয়ার এই পদ্ধতিটা দারুণ হলেও একজন অভিভাবক হিসেবে আমার মনে হয়েছে, এই পরীক্ষাটি যতটা না আমার সন্তানের, তার চেয়ে বেশি আমার এবং আমার স্ত্রীর। সে কারণে আমরা দুজন এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, চূড়ান্ত পরীক্ষা নেওয়ার আগে আমরা আমাদের সন্তানকে মূল্যায়ন শিটে উল্লিখিত প্রশ্নসমূহ শেখানোর চেষ্টা করব। কিন্তু যখন যে পরীক্ষাটি দেবে, তখন আমরা একশো ভাগ নিরপেক্ষ থাকব।

আমরা দুজনই এ ব্যাপারে স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, আমাদের সন্তান যদি স্কুল থেকে সরবরাহকৃত মূল্যায়ন শিটে উল্লিখিত প্রশ্নসমূহের ৫০ শতাংশ উত্তরও দিতে না পারে, আমরা সেভাবেই খাতাটি স্কুলে জমা দিয়ে আসব এবং স্কুল কর্তৃপক্ষ যদি মনে করে যে, আমাদের সন্তান পরের ক্লাসে ওঠার মতো যোগ্য নয়, তাহলে তারা বর্তমান ক্লাসে রেখে দিলেও আমাদের কোনো আপত্তি নেই। এ নিয়ে আমাদের কোনো খেদ থাকবে না এবং মেয়েকে পরের ক্লাসে নেওয়ার জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষকে আমরা কোনো ধরনের অনুরোধ বা চাপ প্রয়োগ করব না।

সবশেষ প্রশ্ন, কতজন অভিভাবক বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন যে, উপরের প্রশ্নসমূহের সুরাহা করে আপনি আপনার বাসায় বসে সন্তানের মূল্যায়ন পরীক্ষাটি নিরপেক্ষ এবং নির্মোহভাবে নিতে পারবেন?

আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Witnessing atrocities in Gaza on social media

Social media's addition as a new paradigm to news dissemination and consumption is not a recent development. Yet, with the ongoing Israeli attack and occupation of Gaza, it is playing a more prominent role than usual, given the deep differences that exist between how news from the region is being packaged by media outlets in the West and the rest of the world

48m ago