রূপসী বাংলার কবির ৬৬তম প্রয়াণ দিবস আজ
![](https://bangla.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/feature/images/jibanananda_das.jpg?itok=MmrQZOAp×tamp=1603351078)
বাংলার পাঠকদের কাছে জীবনানন্দ দাশ অনেক জনপ্রিয় একটি নাম। তাকে বলা হয়ে থাকে রূপসী বাংলার কবি। কখনো বলা হয় বনলতা সেনের কবি। প্রকৃতি প্রেমিক কবিও বলা হয়।
তার মতো করে প্রকৃতিকে কবিতায় আর কে তুলে আনতে পেরেছেন?
আজ কবি জীবনানন্দ দাশের ৬৬তম প্রয়াণ দিবস।
বুদ্বদেব বসু কবি জীবনানন্দ দাশকে অ্যাখ্যায়িত করেছেন নির্জনতম কবি হিসেবে।
অন্নদাশংকার রায় তাকে শুদ্ধতম কবি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
তবে, রূপসী বাংলার কবি হিসেবেই তিনি সবচেয়ে বেশি সমাদৃত। কেননা, তার কবিতায় গ্রামবাংলার অপরূপ সৌন্দর্য ও প্রকৃতির রূপ-লাবণ্যের কথা উঠে এসেছে অন্য যে কোনো কবির তুলনায় অনেক বেশি।
‘বনলতা সেন’ বাংলা ভাষার অন্যতম জনপ্রিয় কবিতা। এর মধ্যে দিয়ে চেনা যায় জীবনানন্দ দাশকে।
কীওনখোলা নদী পাড়ের শহর বরিশালে জন্ম এ কবির। ডাক নাম মিলু। মা কুসুমকুমারী দাশও একজন কবি ছিলেন। মায়ের অনুপ্রেরণায় কবিতা লিখতে উৎসাহী হন জীবনানন্দ দাশ।
জীবনান্দের প্রথম কবিতা ছাপা হয় ১৯১৯ সালে। কবিতার নাম বর্ষা আবাহন। তার প্রথম প্রকাশিত কবিতার বইয়ের নাম ঝরা পালক।
বরিশালে জন্ম হলেও জীবনানন্দ দাশ পড়েছেন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে, ইংরেজি সাহিত্যে। বাংলা কাব্য তাকে দিয়েছে অমরত্ব। তার কবিতার লাইন, ‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে….’।
সত্যি তিনি হাঁটছেন তার কবিতার ফেরিওয়ালা হয়ে।
কুসুমকুমারী দেবীর একটি কবিতার লাইন ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/ কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে’। জীবনানন্দ দাশ মাকে দিয়ে প্রভাবিত হয়ে লিখতে শুরু করেছিলেন। সেজন্য ছেলেবেলা থেকেই লেখালেখি শুরু হয়েছিল তার।
জীবনানন্দ দাশ কবিতার পাশাপাশি প্রবন্ধ, গল্প ও উপন্যাস লিখেছেন। কিন্তু, কবি হিসেবেই তার সবচেয়ে বেশি পরিচিতি এসেছে। সাড়ে আটশরও বেশি কবিতা লিখেছিলেন। কিন্তু, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা বা সংকলনে প্রকাশ করেছিলেন ২৬২টি।
জীবদ্দশায় তার প্রকাশিত কবিতার বইগুলো হচ্ছে: ঝরা পালক, ধূসর পান্ডুলিপি, বনলতা সেন, মহা পৃথিবী, সাতটি তারার তিমির, জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ট কবিতা।
কবিতার বাইরে বেশ কয়েকটি উপন্যাস লিখেছিলেন তিনি। অসংখ্য ছোট গল্পও রয়েছে তার। তবে জীবদ্দশায় সেসব প্রকাশ করেননি। তার বহুল পঠিত উপন্যাসের নাম মাল্যবান।
কবি জীবনান্দ অনেকগুলো প্রবন্ধ লিখেছিলেন। তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়েছিল প্রবন্ধের সংকলন কবিতার কথা।
দেশবন্ধু চিওরঞ্জন দাশ মারা গেলে তার স্মরণে জীবানন্দ দাশ একটি কবিতা লিখেছিলেন। কবিতার শিরোনাম ছিল ‘দেশবন্ধুর প্রয়াণে’। কবিতাটি পড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বুদ্বদেব বসুকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন, কবিতাটি চিত্ররূপময়।
অসাধারণ একজন কবি হয়েও জীবদ্দশায় জীবনানন্দ দাশ কোনো খ্যাতি পাননি। তার খ্যাতি, সুনাম, জনপ্রিয়তা শুরু হয় মৃত্যুর পর। কবিতা তাকে দিয়েছে অমরত্ব।
সংগ্রামমুখর জীবন ছিল তার। ছেলেবেলা ও কলেজজীবন কাটিয়েছিলেন বরিশালে। তারপর কলকাতায় যান উচ্চশিক্ষার জন্য।
অধ্যাপনাকে পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন তিনি। শুরুর দিকে কলকাতায় চাকরি না পেয়ে বাগেরহাটে প্রফুল্ল চন্দ্র কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। তবে খুব বেশি দিন সেখানে থাকা হয়নি তার।
বেকার জীবনও ছিল তার একসময়। চাকরি না পেয়ে গৃহশিক্ষক হিসেবেও কাজ করতে হয়েছে তাকে। অবশ্য সে সময় লেখালেখি করে পয়সা পেতেন, তা ছিল খুবই সামান্য।
তারপর দিল্লির রামযশ কলেজে অধ্যাপনা করেন মাত্র চার মাস।
দিল্লি থেকে ঢাকায় এসে বসেন বিয়ের পিঁড়িতে। লাবণ্য দেবীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বিয়ে হয়েছিল সদরঘাটের কাছে রামমোহন লাইব্রেরিতে। তার স্ত্রী লাবণ্য দেবী ঢাকার ইডেন কলেজের ছাত্রী ছিলেন। তবে বিয়ের পর কবি আর দিল্লি ফিরে যাননি। তার বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন বুদ্বদেব বসুসহ বেশ কয়েকজন স্বনামধন্য কবি-লেখক।
বিয়ের পর ফের বেকার হয়ে পড়েন জীবনানন্দ দাশ। টানা পাঁচ মাস কোনো কাজ ছিল না। সংগ্রামমুখর জীবনে সে সময়ে বীমা কোম্পানির এজেন্ট হিসেবেও কাজ করতে হয়েছিল তাকে। একসময় ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে কিছু অর্থ নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন এবং সেখানেও লোকসান গুণতে হয় তাকে।
জীবনানন্দ দাশ আবার বরিশালে ফিরে আসেন। সেখানে ব্রজমোহন কলেজে ইংরেজি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন।
দেশভাগের কিছুদিন আগে জীবনানন্দ দাশ কলকাতায় আসেন ছুটি নিয়ে। কলকাতায় এসে ছুটি বাড়িয়েও নেন। সেসময় তিনি কলকাতার দৈনিক স্বরাজ পত্রিকার সাহিত্য পাতা সম্পাদনা শুরু করেন। সাত মাস পর এই চাকরিটাও হারাতে হয় তাকে।
কলকাতার সিটি কলেজে টিউটর হিসেবে শিক্ষকতা শুরু করেন তিনি। কিন্তু, ভাগ্য কবির প্রতি সহায় ছিল না। কয়েকজন শিক্ষককে ছাঁটাই করা হলে তিনিও পড়েন এর মধ্যে। স্ত্রী লাবণ্য দাশও শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত ছিলেন।
কিন্তু, কোথাও জীবনানন্দ দাশের স্থায়ী চাকরি হয়নি। চাকরির জন্য কতো জায়গায় ঘুরেছেন তিনি। কঠিন সংগ্রামের জীবন ছিল তার।
প্রকৃতি প্রেমিক কবি জীবনানন্দ দাশ ১৯৫৪ সালের ১৪ অক্টোবর কলকাতার বালিগঞ্জে ট্রাম দূর্ঘটনার শিকার হন। হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ২২ অক্টোবর মারা যান তিনি।
মৃত্যুর অনেক বছর পর তার কবিতা ইংরেজি ও ফরাসিসহ ইউরোপের অনেকগুলো ভাষায় অনূদিত হয়। তার জীবন ও কর্মের ওপর অনেক লেখকরা লিখছেন, গবেষণাও করছেন।
মৃত্যুর অনেক পর তিনি বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। মৃত্যুর পর জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা বইয়ের জন্য দেওয়া হয় সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার।
রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ তার কবিতার মতো আজও হাজার বছর ধরে পথ হেঁটে চলেছেন। না থেকেও তিনি যেন ধানসিঁড়িটির তীরে বার বার ফিরে আসেন কবিতা দিয়ে।
Comments