বিপদজনক খেলায় মেতেছেন ট্রাম্প

‘আমি জিতলে নির্বাচন নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু এবং আমি হারলে কারচুপি হয়েছে।’ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আমাদের দেশে নির্বাচনের সময় এই বাক্যটি আমি বহুবার লিখেছি। তবে, কখনই ভাবিনি যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন সম্পর্কে লিখতে গিয়েও এই বাক্যটি লিখতে হবে। বড় রকমের কারচুপি বা জালিয়াতি হয়েছে বলে অভিযোগ তুলে পুনরায় নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন ট্রাম্প। এই নির্বাচনের ফলাফল তিনি মানছেন না। তিনি ‘বৈধ’ ভোট যাচাইয়ের জন্য মামলা করার পথ বেছে নিয়েছেন এবং বোঝাচ্ছেন যে ‘অবৈধ’ ভোট দেওয়া হয়েছে ও গণনা করা হয়েছে। যদিও এর স্বপক্ষে তিনি কোনও প্রমাণ দিতে পারেননি।
ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফাইল ফটো রয়টার্স

‘আমি জিতলে নির্বাচন নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু এবং আমি হারলে কারচুপি হয়েছে।’ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আমাদের দেশে নির্বাচনের সময় এই বাক্যটি আমি বহুবার লিখেছি। তবে, কখনই ভাবিনি যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন সম্পর্কে লিখতে গিয়েও এই বাক্যটি লিখতে হবে। বড় রকমের কারচুপি বা জালিয়াতি হয়েছে বলে অভিযোগ তুলে পুনরায় নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন ট্রাম্প। এই নির্বাচনের ফলাফল তিনি মানছেন না। তিনি ‘বৈধ’ ভোট যাচাইয়ের জন্য মামলা করার পথ বেছে নিয়েছেন এবং বোঝাচ্ছেন যে ‘অবৈধ’ ভোট দেওয়া হয়েছে ও গণনা করা হয়েছে। যদিও এর স্বপক্ষে তিনি কোনও প্রমাণ দিতে পারেননি।

ট্রাম্প সেটাই করছেন যেটা তিনি খুব ভালোভাবে করতে পারেন- বিঘ্ন ঘটানো বা সমস্যা তৈরি করা। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি তার পুরো মেয়াদকালে এটাই করেছেন এবং এখন পদ ছাড়ার সময়ও তাই করছেন। তবে তিনি একটি বিপদজনক খেলা খেলছেন। তিনি যদি সত্যই এই নির্বাচনের ফলাফল ‘অস্বীকার’ করেন, সেক্ষেত্রে সুন্দরভাবে ক্ষমতা স্থানান্তরে গুরুতর জটিলতা তৈরি হবে। এতে আমেরিকার রাজনীতি গভীর সংকটে পড়বে। আর এর মাধ্যমে তিনি যে তার দেশকে বিশ্বের কাছে উপহাসের পাত্র করে তুলবেন, তা তো বলার অপেক্ষাই রাখে না।

গণতন্ত্রের অনেক কিছুই নির্ভর করে নিয়ম, পদ্ধতি, শালীনতা অনুসরণ এবং নিয়ম অনুসারে কাজ করার ওপর। পদ্ধতির চেয়ে বড় কথা হচ্ছে গণতন্ত্র একটি মানসিকতা। এটি একটি মূল্যবোধের সমষ্টি, যার ভিত্তি ‘জনগণের ইচ্ছা’র প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া এবং তাদের ভোটের ফলাফল মেনে নেওয়ার ওপর। এই প্রক্রিয়ায় কোনও রাঘব বোয়ালের (এই ক্ষেত্রে ট্রাম্প) নিয়ম মানতে অস্বীকৃতি জানানোর অর্থ গণতন্ত্রের পুরো বিষয়টিকে গুরুতরভাবে অস্বীকার  করা। নির্বাচনের রায় মেনে নিতে ট্রাম্পের অস্বীকৃতি, নিয়মাতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় বহুবিধ সমস্যা তৈরি করবে। যা গণতন্ত্রের মূল ভিত্তির সঙ্গে পুরোপুরিভাবে সাংঘর্ষিক। ক্ষমতায় যাওয়ার প্রক্রিয়া রাজনীতি। আর জনরায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে শান্তিপূর্ণভাবে সেই ক্ষমতা হস্তান্তরই গণতন্ত্র। রিপাবলিকান পার্টির নেতৃত্বকে এ বিষয়ে অবশ্যই আরও সংবেদশীল হতে হবে এবং জনগণের পছন্দকে সম্মান দিতে হবে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যতিক্রমী সৌন্দর্য হলো- একজন পরাজিত হওয়ার পর নির্বাচনকে ‘স্বীকার’ করে নেওয়ার অনুশীলন। একদম শুরু থেকে প্রতিটি নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থী বিজয়ীকে ‘স্বীকার’ করে নিয়েছেন। সাধারণত মার্কিন প্রেসিডেন্ট দুটি মেয়াদ পূর্ণ করেন। প্রেসিডেন্টের দ্বিতীয় মেয়াদ শেষে যে নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয় সেখানে দুজন প্রতিযোগীই থাকেন নতুন, যাদের কেউই ক্ষমতায় নেই। তবে পরাজিত প্রার্থী যদি ক্ষমতাসীন থাকেন (যেমন ট্রাম্প চার বছরের এক মেয়াদ সম্পন্ন করে দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য নির্বাচন করেছেন), তাহলে বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। ক্ষমতায় থাকা বর্তমান প্রেসিডেন্টকে নতুন নেতৃত্বের কাছে ক্ষমতা স্থানান্তরের প্রক্রিয়াটি সুষ্ঠুভাবে সঞ্চালনের জন্য পরাজয় ‘স্বীকার’ করতে হবে।

ট্রাম্পের ঘোষণা অনুযায়ী তিনি যদি তার পরাজয় স্বীকার করে না নেন, তাহলে কী হবে? তখন বিষয়টি আদালতে গড়াবে এবং আদালতের রায়ই নির্ধারণ করবে পরবর্তীতে কী করনীয়। আমরা জানি না রায় কী হবে। তবে এটা নিশ্চিত হতে পারি যে ক্ষমতার পালাবদল যদি আদালতে গড়ায়, তাহলে ডেমোক্রেট এবং রিপাবলিকান পার্টির সম্পর্ক আরও তিক্ত হয়ে উঠবে। বাইডেন বলেছেন, ‘এখন আমাদের  বাকবিতণ্ডা না করে, একে অপরের দিকে তাকানোর সময়, একে অপরের কথা শোনার সময়।’ জনগণ আশা করেন যে বাইডেন ধৈর্য ধরে শান্ত থাকবেন এবং তিনি সম্ভবত তা করবেন। তবে আইনি প্রক্রিয়াটি কীভাবে হবে, কতটা দীর্ঘায়িত ও সময়সাপেক্ষ হবে, তার ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করবে। একটি ভালো ব্যাপার হচ্ছে নতুন প্রেসিডেন্টের শপথ গ্রহণের জন্য ২০২১ সালের ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় রয়েছে। আশা করা যায় ততদিনে সমাধান বেরিয়ে আসবে এবং দীর্ঘ দিনের প্রক্রিয়ার প্রতি সম্মান রেখে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হবে।

এবারের নির্বাচনের সবচেয়ে বড় বিষয়টি হলো, ‘নির্বাচনে ব্যাপক জালিয়াতি’র অভিযোগ উঠেছে এবং প্রেসিডেন্ট নিজেই ‘নির্বাচন চুরি করা হয়েছে’ বলে মন্তব্য করেছেন। এটা এমন এক বাস্তবতা যার মুখোমুখি মার্কিন ভোটাররা এর আগে কখনও হননি। এই পরিস্থিতি স্পষ্টত এটাই দেখাচ্ছে, আমেরিকার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নির্ভর করে এমন স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত দুটি রাজনৈতিক দলের বিভেদ এমন পর্যায়ে নেমে গেছে যে তারা একে অপরের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলতেও আর দ্বিধা করে না। সন্দেহ এত গভীর, এত প্রখর, এত সর্বগ্রাসী হয়ে উঠেছে যে তারা একে অপরকে ‘নির্বাচন চুরি করা’র মতো জঘন্য অভিযোগে অভিযুক্ত করার আগে দ্বিতীয়বার ভাবছেন না। তাহলে ভেবে দেখেন, রাজনৈতিক নীতি সম্পর্কে পারস্পরিক বোঝাপড়া নিয়ে সিনেট, হাউস, বিভিন্ন কমিটি বা দ্বিপাক্ষিক অন্যান্য জায়গাগুলোতে তারা কীভাবে কাজ করবেন। দলের নীতি বা মতাদর্শ এক বিষয় আর অপরাধী হিসেবে প্রতিপক্ষকে দায়ী করা ভিন্ন বিষয়। স্বাধীনতা অর্জনের প্রায় আড়াই শতাব্দীর মধ্যে মার্কিন রাজনীতি এতটা নিচে নামার উদাহরণ বিরল।

বাইরে থেকে যেমনটি দেখছি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনের পর দৃশ্যপট বদলে যাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মার্কিন রাজনীতিতে কী টেনে আনতে চলেছেন, তা নিয়ে আমরা শঙ্কিত। নির্বাচনে বাইডেন পেয়েছেন সাত কোটি ৪০ লাখ ভোট আর তিনি পেয়েছেন সাত কোটি ১০ লাখ ভোট। এটা নিয়ে তার সন্তুষ্ট থাকা উচিত। ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ এর মধ্যে লুকিয়ে থাকা ‘ট্রাম্প ফার্স্ট’ বার্তা থাকার পরও তিনি এত ভোট পেয়েছেন। নিজের লাগামহীন আত্মপ্রচারের পরও তিনি যে ৪৮ শতাংশ আমেরিকান ভোটারের আস্থা অর্জন করতে পেরেছেন, সেটা তার জন্য অনেক বড় পাওয়া। গণতন্ত্রে কোনও গড় কৃতিত্ব নেই। এটি অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় যে তার সমর্থকদের একটি বড় অংশ উগ্রপন্থী, সত্যতা নেই বা যৌক্তিক নয় এমন বক্তব্যে বিশ্বাস করে, উস্কানিমূলক আচরণে অভ্যস্ত, অনেকে সশস্ত্র এবং আহ্বান জানালেই রাস্তায় নামতে প্রস্তুত। ট্রাম্প তার সমর্থকদের বলেছিলেন ‘স্ট্যান্ড ব্যাক এন্ড স্ট্যান্ড-বাই’। তার এ আহ্বানের সত্যিকার অর্থটি আমরা শিগগির বুঝতে পারব।

ট্রাম্পের কল্যাণে আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম যে মার্কিন প্রেসিডেন্টরা বাকপটু হতে পারেন। ‘আমেরিকার জন্য আমি যতটা করেছি আর কেউ করেনি, আমার আমলে যত কাজের সুযোগ তৈরি হয়েছে তা আর কারও সময়ে হয়, কেউই করেনি... আমি যতটা করেছি....।’ গত চার বছর ধরে বিজ্ঞাপনের মতো বারবার এই কথাগুলোই শুনেছি। অল্প কিছু শব্দের সাহায্যে তৈরি এই কথাগুলোর মধ্যে ‘আমি’, ‘দুর্দান্ত’ এবং ‘এর আগে কখনও হয়নি’ শব্দগুলো মার্কিন প্রেসিডেন্টের মুখে বারবার শুনেছি, একজন সাংবাদিক হিসেবে আমাকে শুনতে হয়েছে। বারংবার একই শব্দ কানে, মস্তিষ্কে এবং সূক্ষ্ম সংবেদনশীলতার ওপর এক ধরনের চাপ তৈরি করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্টকে একটি আত্মপ্রশংসার ভাণ্ডারে পরিণত হওয়া দেখে ব্যথিত হয়েছি।

যাই হোক, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী জো বাইডেনের একটি বক্তৃতা সতেজতা এনেছে এবং পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে দিয়েছে। তিনি বক্তৃতায় সহজে অনুধাবনযোগ্য, মার্জিত-পরিশীলিত শব্দের সমন্বয়ে গুরুতর ও জরুরি সমস্যাগুলোর প্রতি আলোকপাত করেছেন। তিনি কী করতে চান, কীভাবে করতে চান তার মোটামুটি একটি চিত্র তুলে ধরেছেন। এমন কিছু তিনি বলেছেন, মানুষের যা শোনার প্রত্যাশা ছিল।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী বাইডেন বড় জয় পেয়েছেন, এটা এখন বলাই বাহুল্য। বিভক্ত জাতিকে একত্রিত করা স্পষ্টতই তার অগ্রাধিকারে থাকবে এবং এই চ্যালেঞ্জের জন্য তিনি সবচেয়ে উপযুক্ত বলেই মনে হয়। রাজনীতিতে তার রয়েছে ৪৭ বছরের অভিজ্ঞতা। সেইসঙ্গে দীর্ঘ সময় দ্বিপাক্ষিক কাজ করেছেন রিপাবলিকান পার্টির অনেক সদস্যের সঙ্গে। ফলে তাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত ভালো সম্পর্ক রয়েছে বাইডেনের। এটি তার কাজকে সহজতর করবে।

পুনশ্চ:

প্রশ্ন জাগতেই পারে, আমি একজন বাংলাদেশি সাংবাদিক হয়ে পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট কে হবেন সে সম্পর্কে এত মাথা ঘামাচ্ছি কেন? উত্তরটি সহজ। রাজনৈতিক ব্যবস্থার সর্বোত্তম পন্থা হচ্ছে গণতন্ত্র এবং জনগণের পছন্দ প্রকাশের সর্বোত্তম প্রক্রিয়া হচ্ছে নির্বাচন। এই বিষয়টি আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি। যেকোনও দেশে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, গণতন্ত্রের সাফল্য বা ব্যর্থতার প্রভাব আরও অনেক দেশে পড়বে।

মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার।

Comments

The Daily Star  | English

3 quota protest leaders held for their own safety: home minister

Three quota protest organisers have been taken into custody for their own safety, said Home Minister Asaduzzaman Khan

28m ago