তারাশঙ্করের ১৯৭১: বাংলাদেশ ভারতের অস্থির সময়!

‘কানে বাজছে শেখ মুজিবুর রহমানের সেই আশ্চর্য কণ্ঠ— ঘরে ঘরে তোমরা দুর্গ গড়ে তোল। যা পাও হাতের কাছে তাই নিয়ে যুদ্ধ কর। আমাদের সংগ্রাম চলছে— চলবে। আমাদের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম— আমাদের এ সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

‘কানে বাজছে শেখ মুজিবুর রহমানের সেই আশ্চর্য কণ্ঠ— ঘরে ঘরে তোমরা দুর্গ গড়ে তোল। যা পাও হাতের কাছে তাই নিয়ে যুদ্ধ কর। আমাদের সংগ্রাম চলছে— চলবে। আমাদের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম— আমাদের এ সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

মদ খেয়ে আমি এই বক্তৃতা সেদিন চীৎকার করে বলছিলাম ঘরের মধ্যে। ২৫শে মার্চ রাত্রি তখন অনেক। Mr. Officer আমি যে কখন সেদিন বাংলাদেশের একজন মানুষ হয়ে গেছি তা আমি নিজে বুঝতে পারিনি।’

কথাগুলো বলছিলেন মি. সেন।  খ্রিস্টান ধর্মের একজন পাকিস্তানি নাগরিক। একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে এসেছিলেন সংবাদ সংগ্রহ করতে। তারাশঙ্করের ‘১৯৭১’ নামক বইয়ের ‘একটি কালো মেয়ের কথা’র অন্যতম চরিত্রের হৃদয়খচিত বয়ান। তার মতো শতশত বিদেশি সেদিন এ দেশের মানুষের স্বাধীনতার উচ্চাশা আর সংগ্রাম দেখে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের ত্যাজে সব ভুলে স্বাধীনতাকামী হয়েই সামনে হেঁটেছিল। এখানেই বাঙালির বিজয়ের অন্যান্যতা। আর তা আবেগ ও বাস্তবতার মিশেলে উপস্থাপন করেছেন বাংলা ভাষার একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।

জাতীয় জীবনে আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন স্বাধীনতা। একটি জাতির সবচেয়ে বড় অর্জনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে ত্যাগ-তিতিক্ষার ইতিহাস। তার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই জড়িয়ে থাকে দেশের শিল্প ও সাহিত্য। আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতিতেও জড়িয়ে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসকে মর্যাদার সঙ্গেই শিল্প-সাহিত্যে তুলে ধরায় অংশ নিয়েছেন আমাদের কবি ও কথাসাহিত্যিকরা। রচনার মাধ্যমে তারা বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছেন।

শওকত ওসমানের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘জাহান্নাম হইতে বিদায়’, শওকত আলীর ‘যাত্রা’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘নিষিদ্ধ লোবান’, সেলিনা হোসেনের ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’, রশীদ হায়দারের ‘অন্ধ কথামালা’, আহমদ ছফার উপন্যাস ‘ওঙ্কার’, আল মাহমুদের ‘উপমহাদেশ’, শামসুর রাহমানের ‘অদ্ভুত আঁধার এক’, মাহমুদুল হকের ‘খেলাঘর’, আবুবকর সিদ্দিকের ‘একাত্তরের হৃদয়ভস্ম’।

রাবেয়া খাতুনের উপন্যাস ‘ফেরার সূর্য’, আবু জাফর শামসুদ্দিনের উপন্যাস ‘দেয়াল’, হুমায়ূন আহমেদের ‘শ্যামল ছায়া’, রফিকুর রশীদের উপন্যাস ‘দাঁড়াবার সময়’, তাহমিমা আনামের ‘সোনাঝরা দিন’সহ আরও বহু উপন্যাস রচিত হয়েছে বাঙালির সবচেয়ে বড় ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে।

একটা বিষয় মোটা দাগে বলা যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো পশ্চিমবঙ্গের লেখক ‘গণদেবতা’, ‘পঞ্চগ্রাম’, ‘কবি’, ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’সহ কালজয়ী সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলা ভাষার অনিবার্য একজন লেখক হিসেবে পরিচিত। তিনিই আবার আমাদের মহান স্বাধীনতা নিয়ে জীবনের শেষবেলায় কলম ধরেছেন। লিখে গেছেন সরল সমীক্ষণে ঐতিহাসিক ঘটনার মুহূর্ত। তার লেখায় ‘১৯৭১’ ইতিহাসের পাঠ উম্মোচন, অগণিত পাঠককে করবে মুগ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ চেতনার মানুষের জন্য ভিন্নরকম প্রাপ্তি।

ডেইলি স্টার বুকস থেকে প্রকাশিত ‘১৯৭১’ বিস্তারিত পড়ে জানা যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্তর্ধানের পূর্বে যখন ‘সুতপার তপস্যা’, অপরটি ‘একটি কালো মেয়ের কথা’ বই দুটি প্রকাশের কথা আলোচনা হচ্ছিল  তখন গুরুতর অসুস্থ অবস্থার মধ্যেই বললেন, ‘দুটো বই এক হয়ে বেরোবে, তার নাম হবে ১৯৭১।’ মনে হয় এটাই মহান শিল্পীর ‘শেষ কথা’ ছিল।

‘১৯৭১’র মর্মান্তিক ঘটনাবলী তাকে রোগশয্যাতেও অশান্ত ও উদ্বিগ্ন করে রেখেছিল, এই কথা কটি তারই প্রমাণ। এই রচনার মধ্যেও সে অস্থিরতা ও দুঃসহ বেদনার প্রকাশ আছে লেখাটির প্রায় ছত্রে ছত্রে।

‘একটি কালো মেয়ের কথা’ অধ্যায়ে বাংলাদেশের সময় চমৎকারভাবে তারাশঙ্কর উপস্থাপন করেছেন। যা সত্যিই অসাধারণ এবং কালের সেই মুহূর্তটি চরিত্রের কথায় ভেসে উঠে পর্দায়: ‘২৫শে মার্চ রাত্রিবেলা। কত রাত্রি তখন তা ঠিক খেয়াল ছিল না আমার; আমার হুঁশ ছিল না। এবং ঘড়িও নেই আমার। একজন নৌকোর মাঝিকে ঘড়িটা দিয়ে দিয়েছি। আর কিনিনি। আমার ঠিক দরকারও ছিল না আমি তখন ঘড়ি চলার তালে ছন্দে যে দিনরাত্রি এবং দুনিয়া চলে তার বাইরে বাস করতে চেষ্টা করছিলাম।

২৫শে মার্চ বিকেল বেলা থেকেই সারা ঢাকা শহর একেবারে আগুন দেওয়া বোমাবাজীর মত পলতেতে জ্বলতে জ্বলতে বোমটার দিকে এগুচ্ছে। শোনা গেছে চট্টগ্রাম নাকি জ্বলছে। এখানে প্রেসিডেন্ট খান সাহেবের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ সাহেবের কথা হচ্ছে। চব্বিশ দিন ধরে অহিংস সত্যাগ্রহ আন্দোলন চলছে। আশ্চর্য সে আন্দোলন। একটা দুর্দান্ত প্রচণ্ড বলশালী জন্তু যেন পঙ্গু পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে গেছে। সারা অঙ্গের কোন একটা স্থানেও কোন স্পন্দন নেই— চোখ দুটো মেলে চেয়ে আছে— দেখছে কি দেখছ না তাও বলা যায় না। শুধু শ্বাসপ্রশ্বাস পড়ছে এই পর্যন্ত। বাইবেলে সমুদ্র বিদীর্ণ হয়ে যাওয়ার কথা আছে। আমার কাছে এ সত্যাগ্রহ তেমনি একটা miracle মনে হয়েছিল।’

দীর্ঘ নয় মাসে বাঙালির সংগ্রাম পৃথিবীকে অবাক করে দিয়েছে। প্রতিটি মানুষের হদয়কে নাড়িয়ে দিয়েছে। কারণ, স্বাধীনতা লাভের পর মানুষ, বিশেষ করে স্বাধীনতার লাল-সূর্যটাকে ছিনিয়ে আনতে গিয়ে যে প্রত্যেকে তাদের আত্মীয়-অনাত্মীয় মিলিয়ে প্রায় ত্রিশ লাখ লোকের আত্মাহুতিকে একটি স্বাধীন দেশের জন্য সহজভাবে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। সেই দেশের ব্যাপক জনগোষ্ঠীর মানুষের ভাগ্যে কতরকম দৃশ্য দেখতে হয়েছে তা কষ্টের নয় কি! খুব চমৎকার বর্ণনা তুলে ধরেছেন খ্যাতিমান এ কথাসাহিত্যিক: ‘আমার চোখের সামনে সারা বাংলাদেশের ছবিটা ভাসছিল— আমি তো তিন-তিনবার ঘুরেছি এই দেশটার বুক মাড়িয়ে সেই দেখা ছবিটা যেন নতুন হয়ে ভেসে উঠল আমার মনে। এরা নিষ্ঠুর রকমের গরীব। পরনে লুঙ্গি— খালি গা খালি পা— গায়ের শ্যামলা রঙ পুড়ে কালো হয়ে গেছে, বুকের পাঁজরা বেরিয়ে আছে, চোখের কোলে কালি পড়েছে; ছিটেবেড়ার ঘর, টিনের চাল, বছরে বছরে সাইক্লোন এসে উড়িয়ে নিয়ে যায়, চাপা পড়ে ওরা মরে, নদীর বন্যায় গ্রাম ডোবে গরু-বাছুর ভেসে যায়; এদের বাঘে খায়, সাপে কাটে; এরা ধান ফলায়, পাট ফলায়—

তারাশঙ্কর তার ‘১৯৭১’ উপন্যাসে তুলে ধরেছেন একাত্তরের গ্রামীণ জীবনের চিত্র। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় নাজমা নামের একটি কালো মেয়ে এই উপন্যাসে হয়ে উঠেছে একাত্তরে হাজার নারীর প্রতীক। সেই সঙ্গে সহচরিত্র— রহিম,  মি. সেন ও ছায়ার মাধ্যমে সময়ের মুখ খুলে দিয়েছে এ কথাশিল্পী। যার পরতে পরতে রয়েছে হৃদয়ছোঁয়া মা-মাটি-মানুষের ভালোবাসা।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের ভূমিহীন মানুষের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। মজুর শ্রেণি গ্রামে তাদের প্রয়োজন মতো কাজ খুঁজে পায় না, ফলে গ্রামের অধিকাংশ মানুষ হয় ভূমিহীন আর না হয় কর্মহীন মজুরে পরিণত হয়েছে। এর উপর আছে দুর্ভিক্ষ— যা কখনো প্রকৃতি-সৃষ্টি এবং কখনো শোষক শ্রেণির অত্যাধিক লোভ থেকে সৃষ্ট— এসব বিষয়ও উঠে এসেছে নন্দিত কথাসাহিত্যিকের কলমে।

‘একটি কালো মেয়ের কথা’ অধ্যায়টিতে কথাশিল্পী একটি দৃশ্যের বর্ণনা দিয়েছেন অমায়িকভাবে। প্রসঙ্গটি না তুলে পারছি না:  ২৫শে মার্চ রাত্রি তখন কত! দশটা কি এগারটা। বিকেলবেলা বেলা তিনটে থেকে মিটিং শুনেছি। পুরানা পল্টনে মিটিং ছিল শ্রমিক ফেডারেশনের— তারপর সরকারী কর্মচারীদের মিটিং-এর পর পর মিটিং শুনে পথে পথে বেড়িয়েছি— সন্ধ্যেতে ফিরে এসে মদ খেয়েছি আর ভেবেছি দেশ স্বাধীন হচ্ছে। ইয়াহিয়া খাঁ যে মুজিবুর রহমানের কাছে হার মেনে মিটমাট করে ফিরে যাচ্ছে।

রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে পুবপাকিস্তানীরা ধ্বনি দিচ্ছে— বাংলাদেশ জিন্দাবাদ! বাংলাভাষা জিন্দাবাদ! তাদের হাতে বাংলাদেশের নয়া ঝাণ্ডা। জুলফিকার আলি ভুট্টো ঘাড় হেঁট করে ফিরে যাচ্ছে।’

বাঙালি বীরের জাতি তার আর্দশের কাছে তো অপশক্তিকে অবশ্যই মাথা নত করতে হবে। ফলে জুলফিকার আলি ভুট্টোর মতো লোকদের ঘাড় হেঁট করেই ফিরে যাবে সেটাই স্বাভাবিক। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বিষয়গুলো সাদামাটা শব্দে বুনন করে ফ্রেমবন্ধি করেছেন বাঙালির মননকে। যেটি কাল থেকে কালান্তর টিকে থাকবে। স্বল্প কথায় বলা যায়, পশ্চিমবঙ্গের অনিশ্চিত পরিস্থিতি, দিশেহারা সময়ের অস্থিরতা, তারুণ্যের শক্তিকে বাধা, তার উপরে দেশের ওপর মর্মান্তিক আঘাত, এই আঘাত থেকে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ লেখক দুটি স্বল্পদীর্ঘ উপন্যাস রচনা করেছেন। একটি ‘সুতপার তপস্যা’, অপরটি ‘একটি কালো মেয়ের কথা’।

১৯৬৫ সালের পর থেকে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে বিস্তৃত গোপন রাজনৈতিক তৎপরতাকে উপজীব্য করে ক্ষুদ্র উপন্যাস ‘সুতপার তপস্যা’ রচনা করা হয়েছে।  তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তৎকালীন সময়ের চিত্র তথা সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেছেন নিরেট অবস্থান থেকে সহজ ও সাবলীল ভাষায়। অন্যদিকে, বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির সংগ্রামকে বিষয়বস্তু করে তিনি রচনা করেন তার সর্বশেষ উপন্যাস ‘একটি কালো মেয়ের কথা’। এতে প্রকাশ পেয়েছে বাংলাদেশিদের ত্যাগ ও সংগ্রামের অনন্যতা।

‘১৯৭১’ এর মূল্যায়ণ করতে গিয়ে কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক লিখেন: বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম যখন চলছিল তার মধ্যেই বাংলা সাহিত্যের তিন দিকপাল সাহিত্যিকের একজন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যু হয়। সে জন্যে স্বাধীন বাংলাদেশে আসার কোনো সুযোগ তাঁর হয়নি। স্বাধীন বাংলাদেশে পশ্চিম বাংলার প্রায় সব কবি-সাহিত্যিকই একবার করে ঘুরে গেছেন। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আর যে দুজন বন্দ্যোপাধ্যায়ের উল্লেখ আমরা করি, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় আর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, দুজনেরই মৃত্যু হয়েছিল গত শতাব্দীর পাঁচের দশকে। তাঁদের তো স্বাধীন বাংলাদেশে আসার প্রশ্নই ওঠে না। তারাশঙ্কর আরো কিছুকাল জীবিত থাকলে হয়তো স্বাধীন বাংলায় একবার আসতেন। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসের এই মহৎ অর্জনটি কতো রক্তের বিনিময়ে পেতে হয়েছিল তার কিছু পরিচয় তিনি পেয়েছিলেন। এই বাংলাদেশ যে স্বাধীন হবে সে বিষয়ে তাঁর মনে সম্ভবত কোনো সন্দেহ ছিল না।

মৃত্যু শিয়রে রেখে তিনি ‘একটি কালো মেয়ের কাহিনী’ এবং ‘সুতপার তপস্যা’ নামে দুখানি মিলে ‘১৯৭১’ উপন্যাস লিখেছিলেন। মুক্তিসংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যে নিধনযজ্ঞ ঘটিয়েছিল তার বিবরণ একটি কালো মেয়ের কাহিনীতে বর্ণিত হয়েছে। এবং এখানে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত আছে যে বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই।

খ.

কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সুতপার তপস্যা’ পড়ে দেখা যায়, স্ত্রীর কাছে লেখা এক অনতিতরুণ যুবকের খোলা ভাষ্য। ভুলটা তোমারও বটে, আমারও বটে, আমাদের অভিভাবকদেরও বটে। তবে বিবাহ করেছি আমরা— ভুল আমাদেরই।

এ ভুল চিরকাল, মানে সেই আদিকাল থেকে করে আসছে মানুষ। রাজার ছেলে ঘুঁটেকুড়ানিকে বিয়ে করেছে, রাজকন্যা রাখাল ছেলেকে ভালোবেসেছে— সব বাধা-বিঘ্ন বুক দিয়ে ঠেলে বেড়ি ভেঙে প্রাসাদের ওপর থেকে লাফিয়ে পরিখার জলে পড়ে ওই রাখাল ছেলের পাশে দাঁড়িয়েছে।

রাজার ছেলে-রাজার মেয়ের বেলাতেও ভালোবাসার পথ মসৃণ ছিল না। সংযুক্তা-পৃথ্বিরাজের বিয়ের ব্যাপারটা ভেবে দেখ; চৌহান রাজবংশই শুধু ধ্বংস হয়নি, গোটা ভারতবর্ষ মুসলমানদের পায়ের তলায় এসে গেল। এখানে সংযুক্তার রূপের জন্য যুদ্ধ হয়নি, সংযুক্তার পিতৃপক্ষ ওই কন্যা পৃথ্বিরাজকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল বলে— মুসলমানদের ডেকে এনেছিল। সুভদ্রা-হরশ রুক্ষিণী-হরণ— এসব পুরাণের কথা।

সামাজিক যুগে, বড়লোকের ছেলে গরিব লোকের মেয়ে, বড়লোকের মেয়ে গরিব লোকের ছেলের বিয়ে অজস্র হয়েছে এবং তার ট্র্যাজেডিও মানুষের মুখে মুখে রয়েছে।

কথাগুলো এ গল্পের  অন্যতম চরিত্র সুতপাকে উদ্দেশ করে সুব্রতের লেখা। তবে সুতপা, সুব্রত, শিবানী চরিত্রের মাধ্যমে গল্পটি সামনে এগোলেও সেই সঙ্গে এটি পশ্চিমবঙ্গের অস্থির সময়ের নিরেট গল্প। আর সেই সময়টা ১৯৭১ সাল। ইতিহাসের পাতায় রক্ত ঝরছে দুই জায়গাতেই। মুক্তিযুদ্ধে ঝরছে এই বাংলার মানুষের রক্ত। পশ্চিমবঙ্গেও তাই। কিন্তু, তার চালচিত্র আলাদা। সেই অস্থির সময়ের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক কাঠামো ভাঙার পরিস্থিতি হয়েছিল। কংগ্রেস শাসনে আস্থা নেই, অথচ প্রায় গোটা ভারতবর্ষেই কংগ্রেসের শাসন চলছে। পশ্চিমবঙ্গে নকশাল আন্দোলন ও বাম রাজনীতির নাজুক অবস্থা। প্রাণ দিয়ে সবাই লড়ে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষের রক্ত ঝরছে। ভূমিকম্পে শততালা বিল্ডিংয়ে যেমন ফাটল ধরে যায় এ রকম নানামুখী হানাহানিতে পশ্চিমবঙ্গেও সব কিছু ধসে পড়ার লক্ষণগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। এই অবস্থাটিকে সামনে রেখেই তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় রচনা করেছিলেন ‘সুতপার তপস্যা’।

‘কালো মেয়ের কথা’ ও ‘সুতপার তপস্যা’ দুটো গল্পের প্রেক্ষাপট ও সময়ের মধ্যে ভূগোলের পার্থক্য থাকলেও প্রথম গল্পটি যেন একটি আরেকটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত, পরিপ্রেক্ষিত যতোই আলাদা হোক না কেন। দুটো থেকেই যেন একটিই হাহাকার আকাশ বিদীর্ণ করছে। কোনো হিসেব নেই, দেশের কথা নয়, বিদেশের কথা নয়, কথা একটাই— মানুষ মরছে। জন্মভূমি হয়ে ওঠেছে মৃত্যু উপত্যকা।

১৯৭১ সাল নিয়ে এ কথা বিশেষভাবে স্মর্তব্য যে তারাশঙ্কর তার ‘১৯৭১’ বইতে গল্পেগল্পে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিভিন্ন দিকগুলো মর্মভেদী দৃষ্টিতে দেখার এবং সেই সঙ্গে বিশ্লেষণ করার আন্তরিক চেষ্টা করেছেন। আগ্রহী পাঠককে বইটি পাঠের আমন্ত্রণ জানাই।

(১৯৭১, লেখক: তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রকাশক: ডেইলি স্টার বুকস। প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল। দাম ৩০০ টাকা। পৃষ্ঠা: ১৭২)

ইমরান   মাহফুজ , কবি   ও   গবেষক,   সম্পাদক  কালের ধ্বনি

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

9h ago