ঢাকায় প্রথম মুক্তচিন্তা চর্চার আন্দোলন

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীজুড়ে যখন আর্থ-সামাজিক বিন্যাস-বণ্টন বাস্তবতার নিরিখে স্বীকৃতি কিছুটা পায়, তখনো বাংলা মুল্লুকে সামাজিক মুক্তির চিন্তার বীজ বপন করা হয়নি।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীজুড়ে যখন আর্থ-সামাজিক বিন্যাস-বণ্টন বাস্তবতার নিরিখে স্বীকৃতি  কিছুটা পায়, তখনো বাংলা মুল্লুকে সামাজিক মুক্তির চিন্তার বীজ বপন করা হয়নি।

কালক্রমে দেরিতে হলেও ভারতীয় উপমহাদেশে সমাজতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনার বিস্তার ঘটে। বিশেষ করে ধর্ম সম্পর্কে যখন নতুন করে চিন্তা ভাবনার প্রয়োজন দেখা দেয়, তখন কলকাতার হিন্দু কলেজের (বর্তমান প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) মুক্তবুদ্ধি, যুক্তিবাদী শিক্ষক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও ইয়ং বেঙ্গল নামে ছাত্রদেরকে জ্ঞানানুরাগী হতে ও যেকোনো অন্ধবিশ্বাস ত্যাগ করার দীক্ষা দেওয়ার উদ্যাগ নেন। তিনি মনে করিয়ে দেন ‘সত্যের জন্য বাঁচা, সত্যের জন্য মরা’ কথাটি।

ঠিক এমনই ভাবনার পরম্পরায় ঢাকায় বুদ্ধির মুক্তির কথা প্রচার করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন প্রগতিশীল শিক্ষক ও ছাত্র।

১৯২৬ সালের ১৯ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম হলে বাংলা ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সভাপতিত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মুসলিম সাহিত্য সমাজ। সংগঠনটির পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ও বাণিজ্য বিভাগের অধ্যাপক আবুল হুসেন, মুসলিম হলের ছাত্র এএফএম আবদুল হক, ঢাকা কলেজের ছাত্র আবদুল কাদির (কম চেনা বড় মানুষ, কালের ধ্বনির সংখ্যা) সহ আরও কয়েকজনকে। তারা ছিলেন প্রথম কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য। নেপথ্যে দায়িত্ব পালন করেছিলেন ঢাকা কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক কাজী আবদুল ওদুদ ও যুক্তিবিদ্যার অধ্যাপক কাজী আনোয়ারুল কাদীর।

মুসলিম সাহিত্য-সমাজের মূলমন্ত্র ছিল বুদ্ধির মুক্তি। বুদ্ধির মুক্তি বলতে তারা বুঝতেন অন্ধ সংস্কার ও শাস্ত্রানুগত্য থেকে মানুষের বিচারবুদ্ধিকে মুক্ত করা তথা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে গিয়ে যাওয়া।

তাদের কার্যবিবরণী ও বার্ষিক মুখপত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়— সংগঠনটি যে নবজাগরণের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে সমাজকর্ম ও সাহিত্যচর্চায় নিয়োজিত ছিল তার মূলে ছিল আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা মুস্তফা কামাল পাশার উদ্যম, ভারতের নবজাগরণে বিভিন্ন মনীষীর প্রয়াস ও মানবতার উদ্বোধনে সর্বকালের চিন্তাচেতনার সংযোগ।

এ সংগঠনের লেখকরা তাদের চিন্তাধারাকে বাঙালি সমাজের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য তিনটি পথ অবলম্বন করেছিলেন: পত্রপত্রিকা প্রকাশ, সাময়িক অধিবেশন ও বার্ষিক সম্মেলনের ব্যবস্থা এবং গ্রন্থরচনা ও প্রকাশ।

প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রতিষ্ঠানের সম্পাদক আবুল হুসেন প্রথম বর্ষের বার্ষিক বিবরণীতে ঘোষণা করেছিলেন— চিন্তাচর্চা ও জ্ঞানের জন্য আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি এবং আবহমানকালের চিন্তা ও জ্ঞানের সঙ্গে সংযোগ সাধনই তাদের প্রধান লক্ষ্য।

মুসলিম সাহিত্য-সমাজের বার্ষিক মুখপত্র ছিল শিখা। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩৩৩ বঙ্গাব্দের চৈত্র মাসে। শিখা’র মোট পাঁচটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। প্রথম সংখ্যা সম্পাদনা করেছিলেন আবুল হুসেন, দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংখ্যা কাজী মোতাহার হোসেন, চতুর্থ সংখ্যা মোহাম্মদ আবদুর রশিদ এবং পঞ্চম সংখ্যা আবুল ফজল। শিখা’র প্রতিটি সংখ্যায় মুসলিম সাহিত্য-সমাজের সাময়িক অধিবেশন ও বার্ষিক সম্মেলনের বিবরণ ও সাহিত্য-সভায় পঠিত লেখাগুলো প্রকাশিত হতো। শিখা’র মুখবাণী ছিল: জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।

মুসলিম সাহিত্য সমাজের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য প্রসঙ্গে আন্দোলনের পুরোধা আবুল হোসেন এক প্রবন্ধে লেখেছিলেন, ‘কেহ হয়ত মনে করবেন এ সমাজের নাম মুসলিম সাহিত্য সমাজ হওয়ায় হিন্দু সাহিত্যিকগণের কোন সম্পর্ক এতে নেই। কিন্তু, এই বার্ষিক রিপোর্ট হতে আপনারা বুঝবেন যে এ সমাজ কোন একটি নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ নয় কিংবা এ কোন এক বিশেষ সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য গঠিত হয়নি। সাহিত্য সৃষ্টি এর উদ্দেশ্য, আর সেই সাহিত্যে মুসলমানের প্রাণ ও জীবন ফুটিয়ে তোলাই ইহার অন্যতম উদ্দেশ্য।’

গুণেমানে ঠিক এক না হলেও কলকাতার কল্লোল-গোষ্ঠীর (১৯২৩) মতো ঢাকায় সৃষ্টি হওয়া এ শিখা-গোষ্ঠির লেখকরা সংখ্যায় ছিলেন অল্প। কিন্তু, চিন্তার সংকীর্ণতা ও জড়তার ভিত্তিমূলে প্রচণ্ড জোরে আঘাত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

প্রকৃতপক্ষে এই সংগঠনের কাজ ছিল সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক। অন্ধবিশ্বাসে পিছিয়ে থাকা বাঙালি মুসলমানকে সঠিক পথের সন্ধান দেওয়াই ছিল এর মূলমন্ত্র। যার প্রমাণ মিলে ১৯২৭ সালে ঢাকায় প্রথম বার্ষিক সাধারণ সম্মেলনে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, চারুচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়, মোহিতলাল মজুমদার, ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ মনীষার অংশগ্রহণ। যা আবুল হুসেনসহ সমগ্র শিখা-গোষ্ঠীর অসাম্প্রদায়িক উদারমনা মানবতাবাদেরই পরিচয় বহন করে।

এছাড়াও, কাজী নজরুল ইসলাম তখন যৌবনশক্তির প্রতীক হয়ে জনগণ মন অধিনায়ক হয়ে বসেছিলেন। ১৯২৭ ও ১৯২৮ সালে দুই বার ঢাকায় এসে নজরুল শিখা-গোষ্ঠী তথা মুসলিম সাহিত্য সমাজের বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দিয়ে সবাইকে মাতিয়ে রেখে গিয়েছিলেন।

কাজী আবদুল ওদুদকে বলা হতো এ প্রতিষ্ঠানের মস্তক, আবুল হুসেনকে হস্ত আর কাজী মোতাহার হোসেনকে হৃদয়। বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন বলতে তারা কী বুঝতেন সে সম্পর্কে ড. কাজী মোতাহার হোসেন দ্বিতীয় বর্ষের কার্যবিবরণীতে বলেছিলেন, ‘আমরা চক্ষু বুঝিয়া পরের কথা শুনিতে চাই না বা শুনিয়াই মানিয়া লইতে চাই না; আমরা চাই চোখ মেলিয়া দেখিতে, সত্যকে জীবনে প্রকৃতভাবে অনুভব করিতে। আমরা কল্পনা ও ভক্তির মোহ আবরণে সত্যকে ঢাকিয়া রাখিতে চাই না। আমরা চাই জ্ঞানশিক্ষা দ্বারা অসার সংস্কারকে ভস্মীভূত করিতে এবং সনাতন সত্যকে কুহেলিকা মুক্ত করিয়া ভাস্বর ও দীপ্তিমান করিতে। এক কথায় আমরা বুদ্ধিকে মুক্ত রাখিয়া প্রশান্ত জ্ঞানদৃষ্টি দ্বারা বস্তুজগত ও ভাবজগতের ব্যাপারাদি প্রত্যক্ষ করিতে ও করাইতে চাই।’

অন্যদিকে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন মোতাহের হোসেন চৌধুরী। এমনকি, জীবনবিরোধী নৈতিকতাকেও তিনি বর্জন করেছিলেন যুক্তিনিষ্ঠার অনমনীয় শক্তি বলে। তাই তিনি অসামান্য সাহসিকতায় বলতে পেরেছিলেন, ‘বিবাহিত নর-নারীর প্রেমহীন স্থূল যৌনসম্ভোগে সমাজের আপত্তি নেই, কিন্তু অবিবাহিত প্রেমিক-প্রেমিকা যদি একটু হাতে হাত রাখে অথবা ঠোঁটে ঠোঁট ঠেকায় তবেই যত আপত্তি। প্রীতিকে বড় করে না দেখে নীতিকে বড় করে দেখায় এই স্থূল পরিণতি। বলা যাবে সমাজকে রক্ষা করতে হলে এই স্থূলতার প্রয়োজন আছে- অতএব, তা দোষাবহ নয়। উত্তরে বলব হ্যাঁ সমাজের কাজ তো এ পর্যন্তই। নিজের কাঠামোটুকু টিকিয়ে রাখাই তার কাজ, তার বেশি কিছু নয়। ব্যক্তির বিকাশের কথা সে যতটুকু ভাবে তার চেয়ে অনেক বেশি ভাবে নিজেকে টিকিয়ে রাখার কথা আর সমাজকে টিকিয়ে রাখা মানে সমাজের মোড়লদের টিকিয়ে রাখা, তাদের স্বার্থকে অক্ষত রাখা। মানুষ গোল্লায় যাক তবু মোড়লদের জবরদস্তি বজায় থাক এই তো সমাজের কাম্য। সমাজ মানুষের বৃদ্ধি চায় না, চায় একটা ছাঁচের মধ্যে ফেলে কোন ধরনের টিকিয়ে রাখতে, তার চূড়ান্ত বৃদ্ধিতে বাধা দিতে।’

মানবকল্যাণে যুক্তিবাদী মনোভাব ও প্রকাশ তাদের জীবনজুড়েই ছিল। তারা নানান সময়ে বলেছেন, লিখেছেন। এক কথায় শাস্ত্র-নিরপেক্ষ যুক্তিবাদ ছিল তাদের আদর্শ। গতানুগতিক অন্ধানুবর্তিতার পথ ছেড়ে যুক্তিনির্ভর মুক্তবুদ্ধি চর্চা করাই ছিল এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য। স্বীয় বিচার-বুদ্ধির আলোকে, বাস্তব অবস্থার যুগোপযোগী বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেশ ও জাতির সর্ববিধ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে একটি বলিষ্ঠ সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলাই ছিল তাদের কাম্য, যা থেকে সমাজ জীবনের সর্বতোমুখী বিকাশ সম্ভব।

এ সম্পর্কে সৈয়দ আবুল মকসুদ লিখেছেন, বাংলার মুসলমান সমাজের কুসংস্কার, অনগ্রসরতা ও অন্ধতার বিরুদ্ধে সংস্কারমুক্তির আন্দোলনে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ অবিস্মরণীয় অবদান রাখে। সাহিত্যজীবনের শুরুতেই দেখা যায় আবদুল কাদির আধুনিক ও প্রগতিশীলদের সঙ্গে ছিলেন; প্রাচীনপন্থি ও প্রতিক্রিয়াশীলদের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক ছিল না। তিনি ঢাকায় তখন এমন একটি পরিচ্ছন্ন পরিমণ্ডল তৈরি করেছিলেন যার প্রভাব পরবর্তীকালের অনেক প্রগতিশীল লেখকের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে। (সাহিত্য একাডেমি পত্রিকা, জুলাই-সেপ্টেম্বর, ১৯৮৫, ব্রাহ্মণবাড়িয়া)।

অন্যদিকে, ‘কাজী আবদুল ওদুদ: সাহিত্য ও জীবন দর্শন’ শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, মুসলিম শিক্ষিত সমাজে, বিশেষ করে জীবনের নব চেতনায় উদ্বুদ্ধ উদীয়মান ছাত্র সম্প্রদায়কে গতানুগতিক চিন্তাধারা থেকে মুক্তি দেওয়ার এই ছিল প্রথম সচেতন প্রচেষ্টা। ফলে অচিরেই এ প্রতিষ্ঠান রক্ষণশীলদের চক্ষুশূল হয়ে পড়ে। এমনকি, তৃতীয় বর্ষ থেকে মুসলিম হলে এর সভা পর্যন্ত নিষিদ্ধ হয়ে যায়। ঢাকার নবাব বাড়ি তখনো একেবারে হৃত-প্রভাব নন। ঢাকা-জীবনের নানা ব্যাপারে তাঁরা তখনো রীতিমতো মুরুব্বিয়ানা করতেন, অনেক সময় অনাহুতভাবেও। মহল্লার সরদার থেকে পুলিশের বড়োকর্তা, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভোস্ট-ভাইস চ্যান্সেলার পর্যন্ত তাঁদের কথায় ওঠা-বসা করত। সম্পাদক হিসেবে মুসলিম সাহিত্য সমাজের তথাকথিত ধর্মদ্রোহী মতবাদের জন্য নবাব বাড়িতে আবুল হোসেন সাহেবের তলব পড়েছিল এবং ওখান থেকে তাঁকে রীতিমতো জবাবদিহি করতে হয়েছিল।… এতসব বাঁধাবিপত্তি ও ভ্রুকুটি সত্ত্বেও সাহিত্য সমাজ দীর্ঘ দশ বছর ধরে নিজের অস্তিত্ব বজায় রেখেছিল— প্রথম সাত বছর বেশ সক্রিয়ভাবে এবং শেষের তিন বছর এক রকম জীবন্মৃত অবস্থায়। পরে অবশ্য সমাজে অধিকাংশ কর্মী ও নেতৃস্থানীয়রা, নিজ নিজ পেশাগত কারণে, ঢাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার ফলে সাহিত্য সমাজের অকাল মৃত্যু ঘটে। প্রতিক্রিয়াশীলতার বাধাও অন্যতম কারণ। (নির্বাচিত প্রবন্ধ সংকলন, আবুল ফজল)।

গবেষণায় দেখা গেছে, সংগঠনের দর্শনের মূল নির্যাস ছিল মুক্তচিন্তার অনুশীলন। স্বাধীন মত প্রকাশকে তিনি স্বদেশের স্বজাতির আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক মুক্তির পূর্বশর্ত বলে মনে করতেন। বাঙালি মুসলমানদের আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় অনীহার সমালোচনা করে আবুল হুসেন বলেছিলেন, ‘আমাদের শিক্ষাঙ্গনেই আমরা জ্ঞানের সঙ্গে বহুদিন হতে বিরোধ করে আসছি। দর্শন, বিজ্ঞান ও আর্টকে আমাদের শিক্ষা কেন্দ্র হতে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছি, এই ভয়ে- পাছে আমাদের ধর্ম নষ্ট হয়। ধর্ম আমাদের এতোই নাজুক।’

ধর্ম সব যুগের সব স্থানের সব মানুষের সব প্রয়োজন মিটাতে ও সব সমস্যার সমাধান দিতে পারে না বলে তারা মনে করতেন। এ প্রসঙ্গে আবুল হুসেন বলেছিলেন, ‘সে প্রয়োজন মিটাতে হবে আমাদের জ্ঞান বুদ্ধি খাটিয়ে’। তার প্রবন্ধের এটাই ছিল সারমর্ম। এতে তৎকালীন রক্ষণশীল মুসলিম সমাজে ভয়াবহ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। তারা আবুল হুসেনকে ইসলামের শত্রুরূপে আখ্যায়িত করেছিলেন। আহসান মঞ্জিলের এক সালিসিতে উপস্থিত হয়ে তাকে লিখিতভাবে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করা হয়েছিল। আবুল হুসেন পরেরদিন মুসলিম সাহিত্য সমাজের সম্পাদকের পদ এমনকি সদস্য পদও ত্যাগ করেছিলেন।

১৯৩২ সালে আবুল হুসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে কলকাতায় চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। তার ঢাকা ত্যাগের ফলে আন্দোলনে ভাটা পড়ে এবং ১৯৩৮ সালের পর সংগঠনটি বন্ধ হয়ে যায়।

বলে রাখা ভালো, যেকোনো বিষয়ে অন্ধবিশ্বাস বড় হয়ে ওঠলে মানুষের বিকশিত হওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যায়। এ সব চিন্তা থেকে বের হয়ে যাকে বলে প্রগতি সে পথেই (সংগঠন সংশ্লিষ্টরা) হেটেঁছেন আমৃত্যু। সর্বোপরি বাংলা ও বাঙালি তরুণদের মনে উদার মনোভাব সৃষ্টির জন্য নিরলসভাবে কার্যকর ছিল মুসলিম সাহিত্য সমাজ।

সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রায় সবাই এ দেশের সমাজ, সংস্কৃতি, শিক্ষা ও আইনকে যুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে আজীবন কাজ করেছিলেন। মানবকল্যাণে তাদের ভাবনা ছিল উপযোগবাদ। ঔপনিবেশিক ও সামন্তবাদী সমাজে নিপীড়িত কৃষকের অবস্থা সবিস্তারে বর্ণিত করায় তারা আজও স্মরণীয়।

 

তথ্যসূত্র:

আবদুল হক, সাহিত্য ঐতিহ্য মূল্যবোধ, ঢাকা, ১৯৬৮

সাহিত্য একাডেমি পত্রিকা, জুলাই-সেপ্টেম্বর, ১৯৮৫, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

খন্দকার সিরাজুল হক, মুসলিম সাহিত্য-সমাজ: সমাজচিন্তা ও সাহিত্যকর্ম, ঢাকা ১৯৯৮

হাবিব রহমান সম্পাদিত, মুসলিম সাহিত্য-সমাজ-এর বার্ষিক অধিবেশন: সভাপতির অভিভাষণ, ঢাকা, ২০০২

মুস্তাফা নূর-উল ইসলাম সম্পাদিত শিখা সমগ্র, ঢাকা, ২০০৩

আবদুল মান্নান সৈয়দ, নির্বাচিত শিখা সমগ্র ২০০৮

আবুল কাসেম ফজলুল হক, বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন ও উত্তরকাল ২০১০

মুসলিম সাহিত্য-সমাজ , সভার সংক্ষিপ্ত কার্যবিবরণী ১৯২৬-১৯৩৮। ২০১৫

কম চেনা বড় মানুষ, কালের ধ্বনি'র সংখ্যা ২০১৭

ইমরান মাহফুজ: কবি, গবেষক ও সম্পাদক কালের ধ্বনি

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

9h ago