অ্যা বিগ অ্যাকাডেমিক লস

Mizanur Rahman Khan
ছবি: সংগৃহীত

বিখ্যাত বা বিশিষ্ট কারো মৃত্যু হলে আমরা সব সময়ই বলি, ‘এটি অপূরণীয় ক্ষতি এবং এই শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়।’ অধিকাংশ সময়ই এই কথাটি নিরর্থক ও অন্তঃসারশূন্য। কারণ, অধিকাংশ মানুষের মৃত্যুই অপূরণীয় ক্ষতি নয়। এবার আমরা এমন একজন মানুষকে হারালাম, যার মৃত্যু আসলেই অপূরণীয় ক্ষতি। এই শূন্যতা ঠিক কবে পূরণ হবে— তা আমরা জানি না।

মাত্র ৫৩ বছর বয়সে বিদায় নিয়েছেন সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান। সবশেষ প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ও মৃত্যুর কাঙ্ক্ষিত বয়স বিবেচনায় ৫৩ খুব বেশি নয়। এই বয়সেও তিনি যা লিখেছেন, তা শুধু দেশের সাংবাদিকতার জন্যই নয়, বরং বাংলাদেশের ইতিহাস, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও সামগ্রিকভাবে পুরো জাতির মেধা ও মনন গঠনে বড় ভূমিকা রেখেছে এবং রাখবে।

মার্কিন নথি বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা ব্যর্থতা ও বঙ্গবন্ধু হত্যার যেসব শিহরণ জাগানো তথ্য তিনি উদ্ঘাটন করেছেন, তা বাংলাদেশের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে। এই কাজটি করার জন্য সুদূর মার্কিন মুল্লুকে গিয়ে দিনের পর দিন অধ্যবসায়, লোকজন খুঁজে খুঁজে সাক্ষাৎকার নেওয়া এবং সেই তথ্য ছেঁকে মানুষের সামনে ইতিহাসের অজানা অধ্যায় তুলে ধরে মিজানুর রহমান খান যে কাজ করেছেন, তাতে ঐতিহাসিকদেরও অনেক কাজ তিনি সহজ করে দিয়েছেন। অনেক গবেষকের জন্য নতুন চিন্তার খোরাক জুগিয়েছেন তিনি।

মিজানুর রহমান খান কেনো গুরুত্বপূর্ণ? কারণ, তার মতো পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব ও একইসঙ্গে সৎ, নির্লোভ ও অজাতশত্রু মানুষ এই সময়ে বিরল। সংবিধান ও আইন বিষয়ে তার বিশ্লেষণ শুধু সাংবাদিকদের জন্যই নয়, আইনজ্ঞদের জন্যও ছিল বিশেষ সহায়ক। সংবিধান ও আইনের জটিল বিষয়গুলো তিনি যেভাবে সহজ, সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় ব্যাখ্যা করতেন, তা ছিল অতি উঁচুমানের শিক্ষকতার শামিল।

একজন সাংবাদিক কয়েক ধরনের কাজ করেন। এর মধ্যে প্রধান কাজটি হচ্ছে— মানুষকে তথ্য দেওয়া। দ্বিতীয় কাজটি হলো: মানুষকে শিক্ষিত করা। প্রথম কাজটি সবাই করেন। অর্থাৎ তথ্য দেন। কিন্তু, তথ্য দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষকে শিক্ষিত করতে হলে যে মাপের শিক্ষিত হতে হয়, যে পরিমাণ গবেষণা করতে হয়, তথ্য ও জ্ঞান অন্বেষণে যে পরিমাণ ধৈর্য ও কঠোর অধ্যবসায়ের প্রয়োজন হয়— মিজানুর রহমান খানের মধ্যে এর সবই ছিল।

আমরা হয়তো অনেক জ্ঞানী মানুষকে চিনি, কিন্তু তিনি সেই জ্ঞানকে সহজ-সরল-প্রাঞ্জল ভাষায় মানুষের সামনে উপস্থাপন করতে পারেন না। আমরা অনেক ধৈর্যশীল মানুষকে চিনি, যিনি হয়তো ততটা জ্ঞানী নন। অথবা তার ধৈর্য ও জ্ঞান দুটিই আছে, কিন্তু তিনি লিখতে পারেন না। লিখলেও তা সাধারণ মানুষের উপযোগী হয় না বা মানুষের হৃদয় স্পর্শ করে না।

মিজানুর রহমান খান সংবিধান ও আইনের মতো খটমট বিষয় নিয়েও যেভাবে সাধারণ মানুষের উপযাগী করে লিখতেন, সেটি শুধু মানুষের তথ্য ও জ্ঞানের ভাণ্ডারই যে সমৃদ্ধ করেছে তা নয়, বরং তার লেখা অতি উঁচুমাপের সাহিত্যও বটে।

মিজানুর রহমান খান নিঃসন্দেহে একজন বড় মাপের শিক্ষক। তার কলাম পড়েই সংবিধান বুঝেছি— এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না। ব্যক্তিগতভাবে তার প্রতি আমার ঋণের শেষ নেই।

২০১১ সালের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী নিয়ে যে বইটি লিখেছিলাম, সেটির প্রথম পাঠক ছিলেন তিনি। কারণ, প্রকাশককে দেওয়ার আগে সেটি মিজান ভাইকে দিয়েছিলাম পড়ার জন্য। তিনি পড়েছেন। পরামর্শ দিয়েছেন এবং বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে দীর্ঘ বক্তৃতাও দিয়েছেন।

এরপর সংবিধান ও সংসদ নিয়ে আরও যা লিখেছি, সেখানে মিজান ভাইয়ের পরামর্শ নেওয়ার চেষ্টা করেছি। অতি ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি সময় দিয়েছেন। এত বড় একজন পণ্ডিত মানুষ, অথচ কী নিরহঙ্কার, শিশুর মতো সরল!

মিজান ভাইয়ের একটা বড় বৈশিষ্ট্য ছিল জোরে কথা বলা। এটা এক পর্যায়ে তার স্টাইলে পরিণত হয়। যদিও জোরে কথা বললেও সেটি কানে লাগতো না বা শ্রুতিকটূ মনে হতো না। কারণ তার জোরে কথার আড়ালে বিনয় ও ভদ্রতা ম্লান হয়ে যায়নি। বয়সে আমি তার অনেক ছোট। আবার জন্মসূত্রে একই জেলার মানুষ। কিন্তু, তা সত্ত্বেও অনেক অনুরোধ করেও সম্পর্কটা আপনি থেকে ‘তুমি’তে আনতে ব্যর্থ হয়েছি। তিনি সব সময় আমাকে ‘আপনি’ বলেই সম্বোধন করতেন।

সুতরাং মিজানুর রহমান খানের মৃত্যু শুধু দেশের সাংবাদিকতার জন্যই নয়, বরং পুরো দেশের জন্যই অপূরণীয় ক্ষতি এবং এটি আমাদের জন্য একটি বড় অ্যাকাডেমিক লস। এই শূন্যতা আসলেই পূরণ হওয়ার নয়।

তার মতো করে কে কবে আবার সংবিধান ও আইনের জটিল মারপ্যাঁচগুলো নিয়ে সহজ-সরল-প্রাঞ্জল ভাষায় লিখবেন; অতি স্পর্শকাতর বিষয়কে তার মতো করে কে আর ‘পরিহাস’ বলে লেখার সাহস দেখাবেন— তা আমরা জানি না। শুধু এটুকু জানি, মিজানুর রহমান খানের মতো লোক একটি জাতির জীবনে ঘনঘন জন্ম নেন না। একই সঙ্গে জ্ঞানী, অনুসন্ধিৎসু সাংবাদিক, পর্যবেক্ষক, সুলেখক ও ভালো মানুষ এবং শিশুর মতো সরল— এত সবকিছুর সন্নিবেশ একজন মানুষের ভেতরে কী করে ঘটে, সেটিই বরং বিস্ময়ের।

মিজানুর রহমান খানের মৃত্যুও আসলে এক বিস্ময়।

আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন

 

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয় লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না

Comments

The Daily Star  | English
NCP will not accept delay in Teesta master plan

Won’t accept any implementation delay: Nahid

National Citizen Party Convener Nahid Islam yesterday said his party would not accept any delay or political maneuver over implementing the Teesta master plan.

7h ago