নৃত্যচর্চার অনবদ্য দলিল: সুন্দর এই পৃথিবী আমার

উপমহাদেশের স্বনামধন্য নৃত্যগুরু ও নৃত্যাচার্য বুলবুল চৌধুরীর সহধর্মিণী নৃত্যশিল্পী আফরোজা বুলবুলের আত্মকথা ‘সুন্দর এই পৃথিবী আমার’। বইকে এ অঞ্চলের নৃত্যচর্চার অনবদ্য দলিল হিসেবে দেখা যায়।

বইটি থেকে জানা যায়, বুলবুল চৌধুরীর আগে বাঙালি মুসলমান সমাজে নাচের চর্চা ছিল না বললেই চলে। অথচ সেই ‘নিন্দিত ও নিষিদ্ধ’ শিল্পকে আমাদের সমাজে বুলবুলই প্রথম ‘জাতে তুলেছেন’, নৃত্যশিল্পকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তার সহধর্মিণী আফরোজা বুলবুলকে নিয়ে তিনি এ অঞ্চলের নৃত্যের প্রচার ও প্রসারে রেখে গেছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান।

মাত্র ৩৫ বছর বয়সে মারা যান নৃত্যাচার্য বুলবুল চৌধুরী। স্বামীর মৃত্যুর পর থমকে থাকেননি আফরোজা বুলবুল। স্বামীর মতো তিনিও নৃত্যকে হৃদয়ে ধারণ করে নৃত্যচর্চা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে আমৃত্যু কাজ করে গেছেন। তার বর্ণাঢ্য জীবনের স্মারক ‘সুন্দর এই পৃথিবী আমার’।

এ প্রসঙ্গে প্রয়াত ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেছিলেন, ‘বুলবুল চৌধুরীর মৃত্যুর পর আফরোজা বুলবুল নিবেদিত থাকেন নৃত্যশিল্পে। তার একান্ত প্রচেষ্টায়ই পাকিস্তানের করাচিতে প্রতিষ্ঠিত হয় বুলবুল ইনস্টিটিউট অব কালচারাল ও ঢাকায় বুলবুল ললিতকলা একাডেমি (বাফা)। বুলবুল চৌধুরীকে নিয়ে তার স্মৃতিচারণা আমাদের শিল্প-সংস্কৃতির জগতে মহামূল্যবান। ব্যক্তি বুলবুলের পাশাপাশি বইটিতে রয়েছে আমাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাস রচনার নানা উপদান।’

বুলবুল চৌধুরী দেশ-বিদেশে নৃত্য পরিবেশন করে সুনাম অর্জন করেন। বইটি থেকে আরও জানা গেছে, ১৯৩৪ সাল থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত অসংখ্য নৃত্যরূপ রচনা করেছিলেন তিনি। এদেশের নৃত্যশিল্পকে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে দিয়েছেন। তার ছোট বোন সুলতানা রাহমানের অনুপ্রেরণায় তিনি এ সুনাম অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নৃত্যরূপের মধ্যে রয়েছে ‘বিষের বাঁশি’, ‘সাঁওতালি নৃত্য’, ‘ভ্রমর’, ‘চাঁদ সুলতানা’, ‘আনার কলি’, ‘সোহরাব- রুস্তম’, ‘জীবন ও মৃত্যু’, ‘ফসল উৎসব’ ইত্যাদি।

তার নামে ঢাকা, করাচি, কলকাতা ও লন্ডনে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

মানিকগঞ্জ উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় এলাকায় আয়োজিত এক বিচিত্রানুষ্ঠানে ‘চাতকনৃত্য’ পরিবেশনের মধ্য দিয়ে নৃত্যশিল্পী হিসেবে বুলবুলের যাত্রা শুরু হয়। মঞ্চে একটি ছেলের নাচ, তাও আবার ছেলেটি মুসলমান পরিবারের!

আফরোজা বুলবুলের স্মৃতিকথা থেকে আরও জানা যায়, কলকাতায় বুলবুলের প্রথম নৃত্যানুষ্ঠান ছিল বেকার হোস্টেল কিংবা প্রেসিডেন্সি কলেজের এক বিচিত্রানুষ্ঠানে, যখন তিনি ওই কলেজের ছাত্র ছিলেন। এরপর একে একে ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হল, ক্যাম্পবেল মেডিকেল স্কুল রি-ইউনিয়নসহ নানা অনুষ্ঠানে তিনি নৃত্য পরিবেশন করেছিলেন। একজন শৌখিন নৃত্যশিল্পী হিসেবে এসব অনুষ্ঠানে তার পরিবেশনা, বিষয়-পরিকল্পনা, উপস্থাপনা রীতি শিল্পবোদ্ধাদের আকৃষ্ট করেছিল।

ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলের অনুষ্ঠানে বুলবুলের ‘সাপুড়ে নৃত্য’র সঙ্গে সংগীত পরিচালনা করেছিলেন সরোদশিল্পী সন্তোষচন্দ্র। যিনি উদয় শঙ্করের নৃত্যানুষ্ঠানেও তিমিরবরণের যন্ত্রীদলের হয়ে বাজিয়েছেন। পরে দেশ-বিদেশে বুলবুলের অনেক অনুষ্ঠানে তিনি অর্কেস্ট্রা পরিচালনা করেছিলেন। এ ছাড়া সাধনা বসু ও রুশ নৃত্যশিল্পী নিনা কিমটোভিচসহ অনেকের নাচের সঙ্গেও বাজানোর সুযোগ হয়েছিল তার। সেসব অভিজ্ঞতার আলোকে পরবর্তীকালে বুলবুল জীবনীকার নীলরতন মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি বেশ জোরের সঙ্গেই বলতে পারি যে আমাদের দেশে কোরিওগ্রাফার হিসেবে উদয় শঙ্করের পর বুলবুলই শ্রেষ্ঠ।’

তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান সফরকালে মুলতান ও লাহোরে বুলবুল ও তার দলের বিরুদ্ধে ধর্মান্ধ গোষ্ঠী বিক্ষোভ ও কালো পতাকা প্রদর্শন করেছিল। কিন্তু, কোনো কিছুই বুলবুলকে তার লক্ষ্য থেকে ফেরাতে পারেনি। এমনই ছিল তার আদর্শ ও নৈতিকতার সাহস, যা সবার জন্যে অনুপ্রেরণার।

শিল্পী হিসেবে বুলবুল ছিলেন ভীষণ রাজনীতি-সচেতন। তবে তিনি সরাসরি কখনো কোনো রাজনৈতিক দল বা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হননি। সাধারণভাবে গণমানুষের স্বার্থের পক্ষে ও তাদের মুক্তির লক্ষ্যে শিল্পচর্চায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। তার অনেকগুলো নৃত্যপরিকল্পনায় সে অঙ্গীকারের প্রতিফলন ঘটেছে।

সেই সময় মুন্সীগঞ্জ, বগুড়া, কুষ্টিয়া ও ফরিদপুরেও বুলবুলের নৃত্যানুষ্ঠানের বিরুদ্ধে ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর উদ্যোগে অপপ্রচার ও বিক্ষোভ দেখানো হয়েছিল বলে বইটিতে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু, কোথাও তিনি পিছু হটেননি। যেখানেই গিয়েছিলেন, সেখানেই বাধা অতিক্রম করে, স্থানীয় প্রগতিশীল যুবশক্তি ও প্রশাসনের ভেতরের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন লোকদের সহায়তা নিয়ে অনুষ্ঠান করেছেন। তার আদর্শ থেকে কখনো সরে আসেননি।

বুলবুল চৌধুরী ছিলেন একাধারে নৃত্যশিল্পী ও নৃত্য রচয়িতা। ঐতিহাসিক অনেক ঘটনাকে নৃত্যে রূপদান করে তিনি হয়েছেন চিরস্মরণীয়।

ফরিদ বুলবুলের প্রচ্ছদে প্রকাশনা সংস্থা অ্যার্ডন বইটি প্রকাশ করেছে।

Comments

The Daily Star  | English

India, Pakistan agree ceasefire: Trump

US President Donald Trump on Saturday said that India and Pakistan have agreed to a "full and immediate ceasefire," amid both countries launching strikes and counter-strikes against each other's military installations

24m ago