‘আমৃত্যু হাতের কলমটা যেন সচল থাকে’

জীবন্ত কিংবদন্তি গাজী মাজহারুল আনোয়ার। তিনি প্রায় ২০ হাজার গানের স্রষ্টা। বাংলা গানের সেরা গীতিকবিদের মধ্যে এই মানুষটি একাধারে একজন চলচ্চিত্র পরিচালক ও প্রযোজকও।
গাজী মাজহারুল আনোয়ার। ছবি: স্টার

গত বছর গাজী মাজহারুল আনোয়ারের ৭৮তম জন্মদিনে এই সাক্ষাৎকারটি দ্য ডেইলি স্টারে প্রকাশিত হয়েছিল। আজ রোববার এই কিংবদন্তি চলে গেলেন।

 

জীবন্ত কিংবদন্তি গাজী মাজহারুল আনোয়ার। তিনি প্রায় ২০ হাজার গানের স্রষ্টা। বাংলা গানের সেরা গীতিকবিদের মধ্যে এই মানুষটি একাধারে একজন চলচ্চিত্র পরিচালক ও প্রযোজকও।

প্রায় ৪১টি চলচ্চিত্র পরিচালনা ও প্রযোজনা করেছেন তিনি। বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্মলগ্ন থেকেই গান লিখছেন সেখানে। বিবিসির জরিপে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ২০টি বাংলা গানের তালিকায় তার লেখা গান রয়েছে তিনটি।

স্বাধীনতাযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য রাষ্ট্রপতি স্বর্ণপদক পেয়েছেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। পাঁচ বার পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। শিল্পে অসামান্য অবদানের জন্য ২০০২ সালে তাকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়।

আজ এই গুণীর ৭৮তম জন্মদিন। সম্প্রতি, তার বারিধারার বাসায় দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপ করেছেন নানা বিষয় নিয়ে।

গাজী মাজহারুল আনোয়ার। ছবি: স্টার

জন্মদিন উপলক্ষে একটি বই প্রকাশিত হচ্ছে। কী থাকছে সেই বইটিতে?

আমার লেখা বইটির নাম 'অল্প কথার গল্প গান'। সেখানে আমার রচিত ২০০ গান থাকছে। সঙ্গে থাকছে কালজয়ী ৫০ গানের কথা রচনার নেপথ্য গল্প। আমার জীবনের ফেলে আসা অনেক কথাই পাঠকরা জানতে পারবে এই বইটা থেকে।

বইটা আমার দুই সন্তান উপল ও দিঠির অনেকদিনের ইচ্ছার ফসল। 'অল্প কথার গল্প গান' বইটা প্রকাশ করছে ভাষাচিত্র প্রকাশনী। আমার গান সংরক্ষণের প্রক্রিয়া হিসেবে একে দেখছে আমার সন্তানেরা। তারা বলছে, এ বই প্রকাশের ধারা চলমান থাকবে। আমি তো জীবন সায়াহ্নে এসে পড়েছি। জীবনে আর কোনো চাওয়া-পাওয়াও নেই। মৃত্যুর দিন পর্যন্ত লিখে যেতে চাই। আমার হাতের কলমটা যেন সচল থাকে।

আপনার এই সৃষ্টির পেছনে পরিবারের ভূমিকা কতটুকু?

একজন সুখি মানুষ আমি। জীবনের কোনো অপূর্ণতা নেই। এক ছেলে ও এক মেয়ে আমার। রয়েছে ছেলের বউ। আমার স্ত্রীসহ সবাই আমার সৃষ্টির মূল্যটা বোঝে। তারা আমাকে প্রতিনিয়ত লেখালেখির পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছে। তাদের ভূমিকা বলে শেষ করা যাবে না।

আমার স্ত্রী জোহরা গাজী সেই অনেক আগে থেকেই বিটিভির সংবাদ পাঠিকা, মহিলাবিষয়ক সংস্কৃতি অনুষ্ঠানের উপস্থাপিকা ছিলেন। ইস্ট পাকিস্তান স্পোর্টসের নামকরা এক নারী তিনি। জাম্পে রেকর্ড করেছিলেন। ১৯৭২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর আমাদের বিয়ে হয়। বিয়ের পর সব ছেড়ে শুধু সংসারই করেছেন। তার প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নাই। তার জন্যই একজীবনে সবকিছু করতে পেরেছি।

আপনার জীবনে কোনো অপ্রাপ্তি আছে কী?

আমার কোনো অপ্রাপ্তি নেই। অনেক তৃপ্তি নিয়েই চির বিদায় নিতে চাই। এ বয়সেও লিখতে পারছি। কয়েক প্রজন্ম পেরিয়েও নতুন প্রজন্মের জন্য লিখেছি। পাঁচ বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছি। রাষ্ট্র একুশে পদক দিয়েছে। স্বাধীনতাযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য রাষ্ট্রপতি স্বর্ণপদক পেয়েছি সেই ১৯৭২ সালে। দেশ-বিদেশে বহু পুরস্কার-সম্মাননা পেয়েছি। যদিও কখনই পুরস্কারের জন্য কাজ করিনি। আমার ধারণা কেউ তা করেন না। এগুলো অনুপ্রেরণা হয়ে থাকে মাত্র।

দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য হয়তো কিছু করেছি। এজন্য সবাই আমাকে মূল্যবান মনে করে পুরস্কারগুলো দিয়েছেন।

আপনারা সংস্কৃতির স্বর্ণযুগের মধ্য দিয়ে এসেছেন। এখনকার সংস্কৃতির এই রুগ্ন দশা কেন বলে মনে করেন?

আমাদের এই সংস্কৃতির এ দৈন্যতা কেন?— এর উত্তর বের করে সমাধানের পথে হাঁটতে হবে আমাদেরই। স্বাধীনতার ৫০ বছরে পড়ছি। কী কারণে স্বাধীনতার এতো বছর পরও আমাদের দেশটা ভালোবাসা, হৃদ্যতাময় হয়ে উঠল না। এখনো আমরা কেন দলীয় পরিচয়ে পরিচিত হতে চাই। আমরা কেন সার্বিকভাবে বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে পরিচিত হতে চাই না।

এতো বড় ইতিহাস পৃথিবীর অন্য কোন দেশ পায়নি। বঙ্গবন্ধু যখন ডাক দিয়ে বলেছিলেন, 'এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। সেখানে আমি বোধ হয় প্রথম যে ঘোষণা দিয়ে বলেছিলাম, 'জয় বাংলা, বাংলার জয়'। তারপর আমার মনে একটা প্রশ্ন জেগেছিল কী কারণে স্বাধীনতা জরুরি হয়ে উঠেছিল? এটার ব্যাখ্যা না দিলে জনসাধারণ হয়তো স্বাধীনতার অর্থ নাও বুঝতে পারেন।

স্বাধীনতার অর্থ কী একটা পোশাক, না টাকা? তাই ৩১টি বিষয় সামনে এনে নতুন গান রচনা করি: বাংলার প্রতি ঘর ভরে দিতে চাই মোরা অন্নে।'

'জয় বাংলা বাংলার জয়' গানটার কথা লেখার ভাবনা মাথায় এসেছিল কিভাবে?

তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিলেন। দেশের মানুষ সেই ডাকে সাড়া দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বঙ্গবন্ধু ভাষণ শেষ করলেন 'জয় বাংলা' বলে। এই 'জয় বাংলা' ছড়িয়ে গেল সবখানে। সেদিনের সন্ধ্যাতেই ফার্মগেটের বিখ্যাত এক রেকর্ডিং স্টুডিওতে বসে আছি। সেখানে ছিলেন আমার স্কুলের শিক্ষক সালাহউদ্দিন স্যার। তিনি আমাকে বললেন, 'জয় বাংলা' নিয়ে একটা কাজ করতে পারো। এই সময়ে এটা খুব জরুরি। মানুষ অনেক উৎসাহ পাবে। আমি ভাবতে থাকলাম, 'জয় বাংলা' নিয়ে কি লেখা যায়। ভাবতে ভাবতে দ্রুতই গানটার কথা পেয়ে গেলাম। সুরকার আনোয়ার পারভেজকে ফোন করে স্টুডিওতে আসতে বললাম। সঙ্গে আনতে বললাম তার বোন শাহিনকেও (সংগীতশিল্পী শাহনাজ রহমতুল্লাহ)। আব্দুল জব্বারকেও আসতে বললাম।

হঠাৎ সেই স্টুডিওতে আসলেন আরেক বরেণ্য সুরকার আলতাফ মাহমুদ। তিনি এসে দেখলেন আমি লিখছি। কাগজটা হাতে নিয়েই বললেন, 'বাহ, দারুণ হয়েছে তো লেখাটা। দে সুর করি।' কাগজটা নিয়ে হারমোনিয়ামটা টান দিয়ে তিনি সুর করতে শুরু করলেন।

আমি বললাম, 'আনোয়ার পারভেজ আসছেন। আপনি বসেন।' পরে আনোয়ার পারভেজ, আলাউদ্দিন আলী, জব্বার, শাহিন সবাই এলো। সবাই মিলে গানটি তৈরি হলো। গানটির  সুর-সংগীত করল আনোয়ার পারভেজ। শাহিন আর জব্বার গাইল। সঙ্গে অনেক শিল্পীই ছিলেন।

গান তৈরি করে আমরা বঙ্গবন্ধুর কাছে নিয়ে গেলাম। তিনি শুনে খুব পছন্দ করলেন। বললেন, এই গান দিয়েই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র যাত্রা করবে। এভাবেই রাতারাতি সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে গেল 'জয় বাংলা বাংলার জয়' গানটি।

সিনেমায় গান লেখার গল্পটা কেমন ছিল?

আমার জীবনে আর্শীবাদ হয়ে এসেছেন সত্য সাহা। তার স্নেহ-ভালোবাসায় আমি ধন্য। তার হাত ধরেই সিনেমায় গান লেখার শুরু। মুক্তিযুদ্ধের আগে আমাকে তিনি সুভাষ দত্তের কাছে নিয়ে গেলেন। সুভাষ দত্ত আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, অল্প বয়স, গোঁফই উঠেনি। কিছুটা বিরক্ত হলেও সত্য সাহার জন্য কিছু বলতে পারলেন না। গানের বিষয়টা বুঝিয়ে দিয়ে তার রুমে গিয়ে বসলেন তিনি।

আমি আর সত্য দা তখন চেষ্টা করছি নতুন প্রেমের গান তৈরি করার জন্য। আমাকে সত্য দা টেনশন করতে নিষেধ করলেন। ভাবতে ভাবতেই পেয়ে গেলাম 'আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল' গানটার প্রথম লাইন। গানের কথায় সুর বসানো হলো, আরও কয়েক লাইন লিখলাম। গুনগুনিয়ে গানটি গাচ্ছেন সত্য দা। সেটা শুনে কাছে এসে সুভাষ দা বললেন, 'শুনি কী দাঁড়াল?' গান শুনেই তিনি বললেন, 'দারুণ হয়েছে। শেষ কর গানটা।'

এভাবেই আমি সিনেমার গানের সঙ্গে জড়িয়ে গেলাম।

বর্তমান সময়ের গান, সিনেমা, নাটক থেকে সৌন্দর্য কেন হারিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন?

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলতেন, গানকে পরিবারের মধ্যে আনতে হবে। কারণ, গান পরিবার থেকে বিচ্যুত হলে তার আয়ু খুব অল্প। এভাবেও বলা যায়, যে গান পরিবারের মধ্যে বেঁচে থাকে সেই গানই কালজয়ী হয়। এ কারণেই রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের গান কালজয়ী। তাদের গান পরিবার থেকে সারাদেশে ছড়াতো। একটা সময় ছিল যখন যে বাড়িতে গ্রামোফোন থাকতো সে বাড়ির বউয়েরা সপ্তাহে একদিন পাশের বাড়ির বউদের নিয়ে আয়োজন করে গান শুনতেন। নতুন কোনো রবীন্দ্র বা নজরুল সংগীত বাজারে এলে তা শোনার দাওয়াত দিতেন। এখন এসব নেই। এখন একটা পরিবারের সবাই মিলে গান, নাটক, সিনেমা দেখার মতো কী হয়? তাহলে সৌন্দর্য থাকবে কোথায়? আশা রাখি, বিষয়টা বোঝাতে পেরেছি।

চলচ্চিত্রের সুদিন কী ফিরবে বলে মনে করেন?

এখনকার চলচ্চিত্র ইন্ড্রাস্টি এমন কেন হলো? কী দারুণ ছিল আমাদের সবকিছু। আমাদের কি মেধা নেই? আছে। কিন্তু, যার যেখানে থাকার দরকার সে সেখানে নেই। অনেকেই বলেন, কেন ছবি প্রযোজনা করি না। কোথায় করবো? কী বানাবো? সে ছবি চালাবো কোথায়? জানি না এর উত্তরণ হবে কী করে। তবে আশায় আছি।

Comments