‘বাঙালি মুসলমানের বুদ্ধিবৃত্তিক বিভ্রম ও বিশ্বাসহীনতা’ ইতিহাসের অসামান্য দলিল

সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সাংবাদিকতার অসামান্য মানুষ সৈয়দ আবুল মকসুদের দেহান্তর ঘটেছে, কিন্তু রয়ে গেছে বেশ কিছু সৃষ্টি। সৃজন সংসারে মানুষের কাজ এমনই হয়। কীর্তি, স্মৃতি, দর্শন বিষয়ক চিন্তা কাল থেকে কালান্তর থেকে যাবে। বিশেষ করে তার প্রবন্ধসমূহ দেশের সংকট সম্ভাবনা, রাজনীতি, সমাজ, সাহিত্য সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা দিতে সক্ষম হবে প্রজন্মের মাঝে। কেবল তাই নয়, খ্যাতিমান সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদদের জীবনী ও কর্ম নিয়ে গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখেছেন। যা যেকোনো পাঠকদের পাঠে আগ্রহী করে তুলবে। বিষয়ভিত্তিক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। পাশাপাশি কাব্যচর্চাও করেছেন। তার রচিত বইয়ের সংখ্যা চল্লিশের ওপর। তার লেখা রয়েছে জার্নাল অব জার্মানি ভ্রমণকাহিনী। এই নিবন্ধে সংক্ষেপে আলোচনা করব গবেষণামূলক ‘বাঙালি মুসলমানের বুদ্ধিবৃত্তিক বিভ্রম ও বিশ্বাসহীনতা’ বইটি নিয়ে।
আমৃত্যু গবেষক ও কলাম লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ ইতিহাস-ঐতিহ্য-সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা করে গেছেন। তার ধারাবাহিকতায় ডেইলি স্টার বুকস প্রকাশ করেছিল ইতিহাসের অসামান্য দলিল ‘বাঙালি মুসলমানের বুদ্ধিবৃত্তিক বিভ্রম ও বিশ্বাসহীনতা’ গবেষণা গ্রন্থ। এটি প্রায় দুই বছর ধরে একটি দৈনিকে ধারাবাহিক ছাপা হয়। পাঠকদের কাছে ব্যাপক সাড়া জাগায়। বই হিসেবে পাওয়ার জন্য আকুল হয়ে উঠে। বিশেষ করে পাঠক বইটিতে পাবেন বাঙালি মুসলমানের অগ্রসর ও দূরদর্শী নেতৃত্বের অভাবের কথা। অথচ অবিভক্ত বাংলায় বাঙালি মুসলমান ছিল সংখ্যায় বেশি। অখণ্ড পাকিস্তানে বাঙালি মুসলমান ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। সংখ্যাগরিষ্ঠতা কোনো জনগোষ্ঠীর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে না। আর সেটি পূরণ হয়নি মুসলিম শাসক নবাবী আমলে, ইংরেজ আমলে তো নয়ই, পাকিস্তানি আমলেও হয়নি। আবুল মকসুদ বিশ্লেষণ করেন- বাঙালি মুসলমান ভাগ্য-বিড়ম্বিত তার নিজের স্বভাব-দোষে, ভাগ্যচক্রে এবং অন্যের কারণেও। বার বার হয়েছে সে ভাগ্য-বিড়ম্বনার শিকার। অন্যদিকে, পাকিস্তানের চব্বিশ বছর ছিল বাঙালি মুসলমানের জীবনে একটি ক্রান্তিকাল। এ সময়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ যদি সঠিক ও বাস্তবসম্মত না হয়, তা হলে পরবর্তী সময়টি অর্থবহ হয় না। কিন্তু সে ভুলের খেসারত জাতীকে এখন যে দিতে হচ্ছে তাই নয়, ভবিষ্যতে আরও মারাত্মকভাবে দিতে হবে।
বইটির ৩৬তম পর্বে ‘বিভ্রম ও বিশ্বাসহীনতা’ শিরোনামে সৈয়দ আবুল মকসুদ আরও লিখেন- কোনো জাতিই সত্যকে আড়াল করে মিথ্যার ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। সে চেষ্টা করলে সে জাতি মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না, হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাবে। মানুষ মাত্রই ভুলভ্রান্তি ও দুর্বলতার ঊর্ধ্বে নয়। বাঙালি মুসলমানের প্রতিভাবান অংশটি নানা বিভ্রান্তিতে তাদের শক্তির অপচয় করেছেন। তারা ভুল করেছে ব্রিটিশ আমলে, তারা ভুল ও বিভ্রান্তির মধ্যে ছিলেন পাকিস্তানি আমলে এবং বেদনার বিষয় তারা ভুল ও বিভ্রান্তির মধ্যে রয়েছেন স্বাধীন বাংলাদেশেও। বুদ্ধিবৃত্তির সততা ছাড়া কোনো জাতি উন্নতি করতে পারে না। সত্যের সাধনা ছাড়া জাতির কল্যাণ হয় না। এখনও সময় আছে, যদি বাঙালিদের নতুন প্রজন্ম তাদের পূর্বজদের ভুল থেকে শিক্ষা নেয়, তাহলে ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল, তা না হলে বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে বাঙালির কোনো স্থান থাকবে না।
তার যে ধারণা ও উপস্থাপন, তা যে কেউ মানতে বাধ্য। এতোটা যৌক্তিক বিশ্লেষণ ও ইতিহাস বোধ কম লেখকেরই থাকে। আর বইটির দারুণ একটি দিক হচ্ছে- পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে, সামরিক শাসন জারির আগেই, রোমান অক্ষর প্রচলনের আয়োজনের সময় ঢাকা তথা বাংলা ও বাংলাভাষা নিয়ে সেসব সমস্যা, সম্ভাবনা ও অসামান্য অবদান রাখা ব্যক্তিদের নিয়ে ধারাবাহিক বিশ্লেষণ চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। উঠে এসেছে বাংলা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী যুক্তফ্রন্টের উত্থানে মুসলিম জাতীয়তাবাদী চেতনার মূল দিক।
যেমন: ঐতিহাসিক একটি তথ্য- ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে এ কে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্ট যে ২১ দফা (আবুল মনসুর আহমদ প্রণীত) অঙ্গীকার করে তার ১৬ নম্বর দফায় বলা হয়েছিল: ‘যুক্তফ্রন্টের প্রধানমন্ত্রী বর্ধমান হাউসের পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত কম বিলাসের বাড়িতে বাসস্থান নির্দিষ্ট করিবেন এবং বর্ধমান হাউসকে আপাতত ছাত্রাবাস এবং পরে বাংলা ভাষার গবেষণাগারে পরিণত করা হইবে।’
একালে অনেকের কাছেই বিস্ময়কর মনে হবে, বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠায় পূর্ব বাংলার কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা নেই, জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদদের দ্বারাই এটি প্রতিষ্ঠিত। বিশেষ করে তখনকার প্রধান বিরোধীদল বাঙালি জাতীয়তাবাদী পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অবদান সবচেয়ে বেশি। তার সঙ্গে ছিলেন বাম-প্রগতিশীল সংগঠনগুলোর নেতারা। (বাঙালি মুসলমানের বুদ্ধিবৃত্তিক বিভ্রম ও বিশ্বাসহীনতা)
উঠে এসেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কাজী নজরুল ইসলাম, আবুল মনসুর আহমদ, মুহম্মদ আব্দুল হাই, শেখ মুজিবর রহমান, মুহম্মদ এনামুল হক, মাহবুব-উল আলম, কাজী মোতাহার হোসেন, আনম বজলুর রশীদ প্রমুখের জীবন ও কাজের ফিরিস্তি। অপেক্ষাকৃত তরুণদের মধ্যে শামসুদ্দীন আবুল কালাম, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সৈয়দ শামসুল হক, সৈয়দ আলী আহসান ও আবদুল গাফফার চৌধুরী, আল মাহমুদ ও শওকত আলী, শামসুর রাহমান, শহীদুল্লাহ কায়সার, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর ও নীলিমা ইব্রাহীম, সত্যেন সেন, হাসান আজিজুল হক, আনিসুজ্জামান, হাসান হাফিজুর রহমান, জহির রায়হান, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, আনোয়ার পাশা এবং মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী প্রমুখের কথাও।
তবে এই জার্নালধর্মী লেখাগুলোকে কোনো বিশেষ শ্রেণীতে ফেলা যাবে না হয়তো। ছোটো প্রবন্ধ বিশেষ, গবেষণামূলক রচনার উপাদান এতে যথেষ্টই আছে। উপনিবেশ পরবর্তী পূর্ব বাংলার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতি নিয়ে যারা বড় কাজ করবেন, তারা এগুলো থেকে তাদের প্রয়োজন মতো তথ্য নিশ্চয় পাবেন। সৈয়দ আবুল মকসুদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পাঠের আমন্ত্রণ রইল।
(বাঙালি মুসলমানের বুদ্ধিবৃত্তিক বিভ্রম ও বিশ্বাসহীনতা। লেখক: সৈয়দ আবুল মকসুদ। প্রকাশক: ডেইলি স্টার বুকস। পৃষ্ঠা: ২২০। দাম: ৪০০ টাকা। প্রচ্ছদ: মনন মোর্শেদ)
ইমরান মাহফুজ: কবি ও গবেষক
Comments