বঙ্গবন্ধুর আলোহীন ভালো নেই
বাংলাদেশের পাখিরা যদি গান গাইতে পারতো, তাহলে হয়তো মোলায়েম স্বরে গেয়ে উঠত ‘এত আলো জ্বালিয়েছ এই গগনে/ কী উৎসবের লগনে’। প্রত্যাশিত বেদনার বিষয় পাখিদের কণ্ঠে আছে, শিসে আছে, সুরেলা শব্দে আছে, ওদের নিজস্ব গানও আছে। নেই কেবল প্রান্তিক মানুষের বন্ধু, বাংলা ও বাঙালিকে জাগানো সারথি, দুঃখী মানুষের কণ্ঠস্বর!
বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বিস্ময় হচ্ছে- মাত্র ৫৫ বছরের জীবনের ১৩ বছরই তার কেটেছে কারাগারে। এর মধ্যেই এতো আলো জ্বেলেছেন, এতো সাড়া জাগিয়েছেন, এতো কিছু অর্জন করেছেন, যা কল্পনাকেও হার মানায়। নিজেকে উজাড় করে পৃথিবীকে অবাক করে দিয়েছেন। চারদিকে তার জয়ের প্রতিধ্বনি। বাংলার আকাশে বাতাসে জয় আর জয়, উৎসবে মাতোয়ারা কোটি মানুষের প্রাণ।
গতানুগতিক ভাবনায় ১৮ বছর শৈশব-কৈশোরের সময়কাল। সে হিসেবে পরবর্তী মাত্র ৩৭ বছরে তিনি নিজেকে গড়ে তুলেছেন সাহসী, বিচক্ষণ, সৎ চরিত্রের একজন অসাধারণ মানুষ হিসেবে। আর কারাগারের বাইরে পরিণত বয়সের মাত্র দুই দশকে দেশের মানুষকে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য সংগঠিত করেছেন, দিক নির্দেশনা দিয়ে প্রস্তুত করেছেন আপামর মানুষের স্বপ্নকে। জীবনের বাঁকে বাঁকে ত্যাগ ও ত্যক্ত গল্পে জাগিয়েছেন পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে। আলো জ্বেলেছেন ভেতর কিংবা বাইরে।
অন্নদাশঙ্কর রায়ের বই শুভদয়। তিনি ভূমিকায় লিখেন ‘শেখ শুভদয়া’ নামে একখানি প্রাচীন পুঁথির সন্ধান পাওয়া গেছে। সেই পুঁথির নাম অনুসারে আমার এই গ্রন্থের নামকরণ। এবারেও একজন শেখ বাংলাদেশের পূর্ব গগনে উদয় হয়েছেন। তার উদয়ও শুভদয়। তার নেতৃত্বেই বাংলাদেশ বলে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র উদয় হয়েছে। তার উদয়ও শুভদয়।
আসলেই তাই। প্রকৃত সময়ের নায়ক হিসেবে এসেছেন তিনি। ‘মুক্তির বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন মানুষের হৃদয়ে। তিনি কর্মের মধ্য দিয়ে মানুষের বিশ্বাস ও আস্থা অর্জন করেছেন। ছাত্র-কৃষক-শ্রমিক তথা সাধারণ মানুষকে পরিণত করেছেন একক রাজনৈতিক শক্তিতে। মানুষের মাঝে ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতার দাবি জানাবার সাহস বুনে দিয়ে শেষ পর্যন্ত তাদেরকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের পথে চলার নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি নিজে বিশ্বাস করেছেন, মানুষকে বিশ্বাস করিয়েছেন। আন্দোলন-সংগ্রাম ও ত্যাগের মহিমায় আধুনিক রাজনীতির ইতিহাসে নিজেকে সফল রাজনৈতিক নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি এমন একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক মহাকাব্য নির্মাণ করে গেছেন, লাখো বাঙালি শুধু যার স্বপ্নই দেখতেন। এমন স্বপ্ন যে সত্যি হতে পারে, সাধারণের পক্ষে তা বিশ্বাস করা ছিল কঠিনতর।’ (মাহফুজ আনাম: দ্য ডেইলি স্টার)
এইভাবে গড়ে উঠে আমিত্ববোধ! বঙ্গবন্ধু নতুন যুগের সূচনা করেন সত্য, কিন্তু তার পাটাতন গড়ে দেন শেরে বাংলা, ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক। রাজনীতিতে তার সুযোগ্য উত্তরসূরি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অন্যদিকে ১৯৫৬-১৯৬৭ টানা ১০ বছর মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান তখন যুগ্মসম্পাদক, পরে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তার সঙ্গে। শেখ মুজিবুর রহমানের মানস গঠনে তর্কবাগীশের প্রত্যক্ষ প্রভাব ছিল বলেও ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। তার রাজনৈতিক দর্শন, বক্তৃতার ধরণ, মানুষের প্রতি ভালবাসা, নিঃস্বার্থ দেশপ্রেম সবই ছিল তর্কবাগীশের প্রভাবে আচ্ছন্ন। এইভাবে সমমনা সবাই মিলে অনেক স্বপ্ন নিয়ে পাকিস্তান গঠন করেছিলেন। বলা যায় দেশভাগের পরের বছরেই স্বপ্নভঙ্গ হয়! ধর্মের কারণে ভাগ হলেও আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি হারাতে বসে। তখনি শুরু হয় নতুন আন্দোলন। তারপর বায়ান্ন, ঊনসত্তর, সত্তর ও একাত্তর।
সময় যায়। কিন্তু সবাই সব সময় সব পারে না। তবে অগ্রজের চেষ্টা, ত্যাগ, সংগ্রামকে বেগবান করে নেতৃত্ব দেন নবীন মুজিব। বাঙালির আশার শ্রেষ্ঠ ফসল স্বাধীনতা আনেন। এ স্বাধীনতা কেবল নেতার নেতৃত্বের ফলই নয়- জনগণের আশা ও অব্যক্ত বেদনার বহিঃপ্রকাশের সৃষ্টি মানচিত্র! অন্তর্নিহিত দাবিতে, রক্তে ঘামে পৃথিবীর বুকে জায়গা করে নেয় লাল সবুজের পতাকা।
শেরে বাংলা, ভাসানী, সোহরাওয়ার্দীর যুগ আর বঙ্গবন্ধুর যুগ- এই দুইয়ের মধ্যে আসমান জমিন ব্যবধান। সেটি কী করে সম্ভব! হ্যাঁ, সম্ভব। তাজউদ্দীনের মতো সারথি-চিন্তার উত্তরাধিকার থাকলে অবশ্য বিজয় তরান্বিত হয়। শতাব্দী ধরে অপেক্ষমাণ সূর্যও ধরা দেয় নিয়তির অমোঘ নিয়মে। বিস্ময়কর পরিবর্তন উজ্জ্বলতায় সাক্ষ্য দেয় প্রজ্ঞা, সাহস ও ত্যাগের। ফুল থাকে মালা হয় না, মৌ থাকে মধু দেয় না। সুযোগ থাকে সবাই কাজে লাগাতে পারে না। যারা পারে তারাই স্মরণীয়। এমনি কালে কালে অনেক নেতা নেতৃত্ব থাকলেও একাত্তরে মানুষের যন্ত্রণা আবেগ আশার মাঝে নেতৃত্ব ও যোগ্য সারথি পেয়েছে বলেই বাংলাদেশের জয় ও মুজিবের জয় একাকার হয়ে সোনালী স্বপ্ন হয়েছে। মুজিবের জনপ্রিয়তা মানুষের বিশ্বাস, সার্বিক উপলব্ধি ও দেশপ্রেম কল্পনাহীন আকাশকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে এঁকে দিলো সবুজের বুকে স্বাধীনতার সূর্য পতাকা।
বিশেষ করে স্বাধীনতার বীজ বপন করেছেন সাতচল্লিশ পরবর্তী বায়ান্নতেই! আর সে সময় ভাষার জন্য জেল খেটেছেন, আন্দোলন করেছেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের মতো মাতৃভাষার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। বিশ্বাস করতেন, প্রথমে মাতৃভাষা, পরে অপর ভাষা। মাতৃভাষাকে পাশ কাটিয়ে রাজনীতি, অর্থনীতিসহ প্রাত্যহিক জীবনের কোনো কাজই সঠিকভাবে করা যায় না।
বিদ্যাসাগর যেমন মাতৃভাষায় পাঠ্যক্রম চালু করার বিষয়ে দারুণভাবে আলোড়িত হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে বাংলা ভাষার প্রচলন, শিখন ও প্রয়োগের ওপর জোর দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু সংবিধান প্রণয়ন করে সহস্রগুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা। বাংলা একাডেমিতে (১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১) একুশের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি ঘোষণা করছি আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে সেদিন থেকেই দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে। বাংলা ভাষার পণ্ডিতরা পরিভাষা তৈরি করবেন, তারপর বাংলা ভাষা চালু হবে- সে হবে না। পরিভাষাবিদরা যতগুলো গবেষণা করুন আমরা ক্ষমতা হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষা চালু করে দেব। সে বাংলা যদি ভুল হয় তবে ভুলই চালু হবে। পরে তা সংশোধন করা হবে।’
নতুন রাষ্ট্র ও নতুন জাতির এই প্রথম সাধারণ নির্বাচনে যে বিপুল উল্লাস, উদ্যম ও উদ্দীপনা দেখা দিয়াছিল, সেটাও ছিল সবাক ও সর্বব্যাপী। আমাদের সংবিধানের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও প্রশংসনীয় বিধান আঠার বছর-বয়স্কদের ভোটাধিকার। এ বিধানের জন্য আমরা ন্যায়তই গর্ববোধ করিতে পারি। আফ্রো-এশিয়ান সমস্ত রাষ্ট্রের মধ্যে বাংলাদেশই সর্বপ্রথম ভোটাধিকারকে এমন গণভিত্তিক করিয়াছে। (আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর: আবুল মনসুর আহমদ)
এতোটা আন্তরিক আর সমাজ বিষয়ে সজাগ ছিলেন বঙ্গবন্ধু। আকাশচূড়া ভাবনা ছিল। তাছাড়া চিরকালই তার শক্তি, অনুপ্রেরণার কেন্দ্রবিন্দু জনগণ। একসময় দল-মত নির্বিশেষে সবার কাছে শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন প্রিয় ‘মুজিব ভাই’, ‘শেখ সাহেব’, ‘বঙ্গবন্ধু’ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের ‘জাতির পিতা’। সেই সঙ্গে কালের পরম্পরায় মুসলিম লীগ ঘরানার রাজনীতি থেকে বেরিয়ে সমমনা বয়োজ্যেষ্ঠ, কনিষ্ঠদের সার্বিক সহায়তায় প্রধান সংগঠক হিসেবে ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন প্রগতিশীল সংগঠনের। এর সুবাতাস বয়ে যায় চারদিকে। হাজার হাজার জনতা যুক্ত হতে থাকে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে।
দ্রুত আলো ছড়িয়ে পড়ে। কী ঘরে কী বাইরে। সর্বত্র তার বিচরণ। নিরাপত্তার কথাও ভাবতেন না। এমন জনপ্রিয়তা আর আবেগই তার জীবনের কাল হয়ে যায়। রক্তখেকোরা শেষ করে দেয় ত্যাগের দীর্ঘ জীবন! অথচ তিনিই কারাগারের রোজনামচা বইতে পাকিস্তান সরকারের উদ্দেশ্যে লিখেছিলেন: ‘মতের বা পথের মিল না হতে পারে, তার জন্য ষড়যন্ত্র করে বিরুদ্ধ দলের বা মতের লোককে হত্যা করতে হবে এ ভয়াবহ রাস্তা। এ পাপের ফল অনেককেই ভোগ করতে হয়েছে।’
খ.
অতীতের গৌরবময় স্মৃতি ও সেই স্মৃতির অনুরূপ ভবিষ্যতের আদর্শ- একত্রে দুঃখ পাওয়া, আনন্দ করা, আশা- এইগুলোই আসল জিনিস, জাতি ও ভাষার বৈচিত্র্য সত্ত্বেও এগুলোর মাহাত্ম্য বোঝা যায়... একত্রে দুঃখ পাওয়ার কথা এই জন্য বলা হইয়াছে যে, আনন্দের চেয়ে দুঃখের বন্ধন দৃঢ়তর। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: নেশন কী, আত্মশক্তি)
আমরা একাত্তরে দুঃখ সুখের সঙ্গে স্বাধীনতাও পেয়েছি। সেই সঙ্গে ভালোভাবে থাকার আশা ও ভরসার কথাও ভেবেছি। লিখিত আছে বাহাত্তরের সংবিধানে। জীবন দিয়ে অর্জন করা অসামান্য দলিলে মুক্তিযোদ্ধাদের গল্প লিপিবদ্ধ। নাগরিক তার গর্বিত মালিক। স্বাধীনতা, সাম্য, সুশাসন, আবাস, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি ও বৈষম্যহীন সমাজে সমানভাবে মানুষের বাঁচার অধিকার লেখা আছে ভাগ্য খাতায়।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, পিছিয়ে পড়া অঞ্চল তথা পূর্ববঙ্গ মূলত অর্থ ও ধর্মের কারণে ভাগ হয়। অর্থনীতির বৈষম্য হলেও দৃশ্যমান করে ধর্মপ্রাণকে। বৈষম্যবাদী পাকিস্তান নিয়ে সাধারণ মানুষের বিরোধিতা একটু একটু করে দানা বাঁধে। কৃষক-শ্রমিক-মধ্যবিত্ত-শিক্ষার্থীরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লে টানাপোড়নে আন্দোলন তুঙ্গে উঠে। বেগবান হয় একাত্তরের বজ্রকন্ঠে। বীরত্ব, সংগ্রাম, রক্ত, ত্যাগ ও অস্থিরতায় দীর্ঘ আশার ফসল স্বাধীনতাকে ঘরে তুলে জনতা।
হ্যাঁ, স্বাধীনতা পেয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু সামাজিক মুক্তি নিতে পারেনি। মুক্তি না হওয়ার প্রধান কারণ সামাজিক বৈষম্য, পুঁজিবাদ ও ক্ষমতা প্রদর্শন। ব্রিটিশ আমলে স্বাধীনতাকামীরা পুঁজিবাদ প্রত্যাখ্যান না করে বরং একাকার হয়ে ছিল। পাকিস্তান বিরোধীরা জাতীয়তাবাদী মনে জপলেও একইভাবে পুঁজিবাদকে সমর্থন করেছিল। আর মুক্তিযুদ্ধের সময় সমাজতন্ত্রকে সামনে হাজির করায় সাধারণ মানুষের মনে জায়গায় করে নেয়। সংবিধানের মূলনীতি হিসেবেও স্থান পেয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সেই পুঁজিবাদ হৃষ্টপুষ্ট হয়! সামাজিক মুক্তির বিষয় না ভেবে দলীয় কোন্দল, বাদানুবাদ ও নিজের আখের গোছাতে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
বলতে গেলে বিজয় আসার পরে আমাদের অন্যতম শত্রু পুরনো সমাজ ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক নেতাদের অগণতান্ত্রিক মতাদর্শ। এই ধারা আমরা চলতে দিয়েছি মুজিব আদর্শের নামে দিনের পর দিন। কোথাও কারো জবাবদিহিতা নেই। জনপ্রতিনিধিরা দায় ও ভারের ভান করে কাটিয়ে দিচ্ছে বছরের পর বছর। সরকারি আমলরা উদাসীন থাকে, নয়তো আইনের সুযোগ নিয়ে আয়েশি জীবনযাপন করে। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার বিপরীতে আশাটাও আঘাতপ্রাপ্ত হয়। ফলে রাজনীতিতে প্রতিহিংসা গুণে, পরিমাণে বেড়েছে দশকের পর দশক!
জাগ্রত মুজিবের আহ্বানে অমানবিক পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এ কোন রাষ্ট্র সৃষ্টি করলাম! যে সমাজ কারো মধ্যে এগিয়ে নিতে দেশপ্রেমের অনুভূতি নেই, নেই উৎসাহ উদ্দীপনা। অথচ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান অস্ত্রের চেয়ে বেশি ছিল আদর্শের বিরুদ্ধে আদর্শ। পাকিস্তান ছিল স্বৈরাচারী, আমার ছিলাম গণতান্ত্রিক। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি হাতিয়ারের বিরুদ্ধে আমাদের ছিল ধর্মনিরপেক্ষ ও ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ। এসব আমরা চেতনে, অবচেতনে ভুলে গেছি। প্রসঙ্গত ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদের অধিবেশনে বলেছিলেন: ‘কেবল শাসনতন্ত্র পাস করলেই দেশের মুক্তি হয় না। আইন পাস করলেই দেশে সমাজতন্ত্র কায়েম হয় না।’ আসলেই হয় না। আজ অবধি হয়নি। বাস্তবতা বড়ই নিদারুণ। রাষ্ট্র গণতন্ত্র এগিয়ে যাওয়ার মূল মন্ত্রের বাক্স ফাঁকা।
প্রসঙ্গত অধ্যাপক রেহমান সোবহানের বক্তৃতার অংশ, ‘বাংলাদেশের এই দুই সমাজের দুই প্রান্তে রয়েছে অভিজন আর অভাজন। অভিজন বা এলিটদের সংজ্ঞায়িত করার মতো পর্যাপ্ত সংখ্যাতাত্ত্বিক তথ্য নেই। তবে তাদের জীবন চলার ধরন থেকেই তাদের বোঝা যায়। বিশ্বায়নের ফলে অর্থনীতি গতিশীল হবে, বহুধা হবে, নয়া সুযোগ তৈরি হবে সেটিই স্বাভাবিক। কেউ কেউ বেশি উদ্যোগী হবেন। অন্যরা হবেন না। কেউ কেউ আরও বেশি করে উপরে উঠে যাবেন। সুতরাং বৈষম্য বাড়বেই। তবে আমরা আশা করেছিলাম যে অর্থনৈতিক এই বৈষম্য এমন মাত্রার হবে না যে তা পুরো জাতিকে দুই সমাজে ভাগ করে ফেলবে।’
‘যুগ যুগ ধরে পুঁজিপতিরা তাদের শ্রেণি স্বার্থে এবং রাজনৈতিক কারণে গরিব শ্রমিকদের মধ্যে দাঙ্গা-হাঙ্গামা, মারামারি সৃষ্টি করে চলছে।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী)। এহেন কর্মকাণ্ড মহান মুক্তিযুদ্ধের সাম্যের প্রতিশ্রুতি ন্যায় নীতি ও শেখ মুজিবের আদর্শকে ব্যঙ্গ করছে। ফলত নীতি ও নৈতিকতার আলো প্রয়োজন। এখানেই তার আলোহীন হয়ে কেউ কোথাও ভালো নেই।
সাহায্য নিয়েছি :
১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: নেশন কী, আত্মশক্তি, রচনাবলী।
২. আবুল মনসুর আহমদ: আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, আত্মকথা
৩. শেখ মুজিবুর রহমান: অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা
৪. রিজওয়ানুল ইসলাম: উন্নয়ন ভাবনায় কর্মসংস্থান ও শ্রমবাজার
৫. আতাউর রহমান: এক বাংলাদেশ দুই সমাজ
৬. মাহফুজ আনাম: বঙ্গবন্ধু ও সাম্যবাদ, দ্য ডেইলি স্টার
৭. ইউপিএল নির্বাচিত বাংলাদেশের প্রবন্ধ ১৯৯৯
৮. রাও ফরমান আলী খান: বাংলাদেশের জন্ম
Comments