খুঁড়িয়ে চলছে রেলওয়ের প্রকল্প

দুর্বল বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার কারণে বাংলাদেশ রেলওয়ের চলমান প্রকল্পগুলোর প্রায় ৫০ শতাংশই চলতি অর্থ বছর শেষে সংশোধন করতে হবে। এর ফলে রেল সেবা উন্নয়নের লক্ষ্যে হাতে নেওয়া এসব প্রকল্পের বেশিরভাগেরই ব্যয় বেড়ে যাবে।

দুর্বল বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার কারণে বাংলাদেশ রেলওয়ের চলমান প্রকল্পগুলোর প্রায় ৫০ শতাংশই চলতি অর্থ বছর শেষে সংশোধন করতে হবে। এর ফলে রেল সেবা উন্নয়নের লক্ষ্যে হাতে নেওয়া এসব প্রকল্পের বেশিরভাগেরই ব্যয় বেড়ে যাবে।

একইসঙ্গে নানা সমস্যায় জর্জরিত রেলওয়ে থেকে মানুষের উন্নত সেবা পাওয়ার প্রতীক্ষাও দীর্ঘায়িত হবে।

রাষ্ট্রায়ত্ত পরিবহন সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলছেন, ভূমি অধিগ্রহণ ও বিদেশি ঋণ অনুমোদনের দীর্ঘসূত্রিতা, প্রয়োজনীয় জনবলের অভাব ও করোনা মহামারির কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

তবে, বিশেষজ্ঞরা রেলওয়ে প্রকল্পের কাজ ধীরগতিতে চলার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন দুর্বল সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের মাধ্যমে তৈরি ত্রুটিপূর্ণ পরিকল্পনা, ব্যক্তিস্বার্থ এবং জবাবদিহিতা ও দক্ষ জনবলের অভাবকে।

২০০৯ সালের আগ পর্যন্ত কয়েক দশক ধরে রেলওয়ে বেশ অবহেলিতই ছিল। ওই বছর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট ক্ষমতায় আসার পর রেলওয়ের বরাদ্দ বাড়ানো হয়।

উন্নয়ন ও কারিগরি সহায়তা প্রকল্প বাবদ চলতি বছরসহ গত পাঁচ অর্থ বছরে রেলওয়েকে ৫৬ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকারও বেশি অর্থ বরাদ্দ দিয়েছে সরকার।

কিন্তু রেলওয়ের তথ্য অনুসারে, গত বছরের অক্টোবর পর্যন্ত মাত্র ৩০ হাজার ৪৯৩ কোটি ২৯ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে।

বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) প্রকল্প বাস্তবায়নে রেল মন্ত্রণালয়ের দুর্বলতার ইতিহাস দীর্ঘদিনের। নথি অনুসারে, ২০১৭-১৮ অর্থ বছর ছাড়া গত পাঁচ অর্থ বছরে রেল মন্ত্রণালয় একবারও গড় বাস্তবায়ন হার অর্জন করতে পারেনি।

নির্ধারিত সময়ে শেষ হচ্ছে না প্রকল্প

বর্তমানে রেলওয়ের ৩৯টি প্রকল্প চলমান রয়েছে। এসব প্রকল্পের ব্যয় এক লাখ ৪১ হাজার হাজার ৮৮৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা। যার বেশিরভাগই ভারত, চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও আরও কয়েকটি দেশের কাছ থেকে ঋণ হিসেবে নেওয়া হয়েছে।

প্রকল্পগুলোর মধ্যে ২০টি নির্মাণ, পুনর্নির্মাণ, রেল লাইন ও সেতু সম্প্রসারণ এবং সিগন্যাল ব্যবস্থা ও লেভেল ক্রসিং স্থাপন সংক্রান্ত।

এছাড়া, রেলের ইঞ্জিন ও বগি কেনা এবং সংস্কারের সাতটি, প্রস্তাবিত প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই গবেষণা পরিচালনার নয়টি এবং কারিগরি সহায়তা সংক্রান্ত তিনটি প্রকল্প চলমান রয়েছে।

রেলওয়ের নথি অনুসারে, চলতি বছরের জুনে এই ৩৯টি প্রকল্পের ২৪টির মেয়াদ শেষ হবে। এর মধ্যে মাত্র চারটি প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে পারবে বলে ধারণা করা হচ্ছে বলে সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন রেলের এক শীর্ষ কর্মকর্তা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘বাকি প্রকল্পগুলোর সবই সংশোধন করতে হবে। ইতোমধ্যে কয়েকটির সংশোধনী প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েও দেওয়া হয়েছে।’

যে চারটি প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে শেষ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তার মধ্যে তিনটিই সম্ভাব্যতা যাচাই প্রকল্প। এগুলো হলো- ঢাকার চারপাশে চক্রাকার রেললাইন নির্মাণ, ভাঙ্গা থেকে বরিশাল হয়ে পায়রা বন্দর পর্যন্ত রেললাইন তৈরি এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম দ্রুতগতির রেললাইন নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই প্রকল্প।

চতুর্থটি হলো, রেলওয়ের ৫৭৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সেকেন্ডারি লাইন বরাবর একটি অপটিক্যাল ফাইবারভিত্তিক টেলিকমিউনিকেশন ব্যবস্থা স্থাপন ও পরিচালনা সংক্রান্ত প্রকল্প।

গোবরা থেকে পিরোজপুর পর্যন্ত একটি নতুন রেললাইন তৈরি ও বাগেরহাটে রেল সংযোগ স্থাপন বিষয়ক আরেকটি সম্ভাব্যতা যাচাই প্রকল্প শুরু হয়। পরবর্তীতে কর্তৃপক্ষ এটি বাতিল করে দেয়।

নিয়মিতই হয় প্রকল্প সংশোধন

রেল প্রকল্পের নথি যাচাই-বাছাই করে দ্য ডেইলি স্টার দেখতে পায়, নির্ধারিত সময়ে শেষ হতে যাওয়া চারটিসহ জুনে যে ২৪টি প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে, তার মধ্যে ১৯টি প্রকল্প অন্তত একবার করে সংশোধন করা হয়েছে। কোনো কোনোটি সংশোধিত হয়েছে একাধিকবার।

উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, ২০১০ সালের ডিসেম্বরে অনুমোদন পাওয়া ৬৪ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার দীর্ঘ খুলনা-মোংলা বন্দর রেললাইন প্রকল্প। এটি তিন বছরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। ২৪টির মধ্যে এই প্রকল্পের কাজই সবার আগে শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রকল্পটির কাজ মাঠ পর্যায়ে শুরু হয় অনুমোদনের ছয় বছর পর।

ফলে প্রকল্পের খরচ প্রাথমিক ধারণার চেয়ে ১২০ গুণ বেড়ে তিন হাজার ৮০১ কোটি টাকা হয়ে যায়।

এখানেই শেষ নয়।

প্রকল্পটির কর্মকর্তারা সম্প্রতি রেলওয়ের কাছে একটি সংশোধনী প্রস্তাব দাখিল করেছেন। এই প্রস্তাবে চলতি বছরের জুনে শেষ হতে যাওয়া প্রকল্পটির মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানোর আবেদন করেছেন তারা। সঙ্গে বরাদ্দ চেয়েছেন আরও ৯৯৭ কোটি ৩৫ লাখ টাকা।

এ বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রকল্পটির ৭৮ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

চলমান প্রকল্পগুলোর মধ্যে বাকি যে ১৫টির মেয়াদ জুনে শেষ হচ্ছে না, তার মধ্যে ছয়টির ব্যয় ও সময়সীমা ইতোমধ্যে একবার করে সংশোধন করা হয়েছে।

এই প্রকল্পগুলো হলো- যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু নির্মাণ, চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ, ঢাকা-টঙ্গী তৃতীয় ও চতুর্থ লাইন তৈরি ও টঙ্গী থেকে জয়দেবপুর ডাবল লাইন নির্মাণ, পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা-যশোর রেললাইন নির্মাণ, কুলাউড়া-শাহবাজপুর অংশ পুনর্নির্মাণ এবং ৭০টি মিটার গেজ রেলের ইঞ্জিন ক্রয়।

যে নয়টি প্রকল্প এখন পর্যন্ত সংশোধন করা হয়নি সেগুলোর মেয়াদ শেষ হবে আগামী বছরের জুন থেকে ২০২৫ সালের জুনের মধ্যে।

নথি থেকে জানা যায়, এগুলোর বেশিরভাগেরই এখনও মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু হয়নি। যদিও এরই মধ্যে বড় একটা সময় পার হয়ে গেছে।

তার মধ্যে উদাহরণ হিসেবে ধরা যায় খুলনা থেকে দর্শনা পর্যন্ত তিন হাজার ৫০৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকার ডাবল রেললাইন প্রকল্প। মোংলা বন্দর হয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যিক কার্যক্রমে গতি আনতে এ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল।

২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের মধ্যে এর কাজ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু করা তো পরের কথা, অর্ধেক সময় পার হয়ে গেলেও প্রকল্প কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত একজন পরামর্শকই নিয়োগ দিতে পারেনি।

রেলওয়ের প্রকল্পগুলোর এ দুরবস্থার কারণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক ধীরেন্দ্র নাথ মজুমদার বলেন, ‘কাজ শেষ করা সম্ভব হয় না বলেই মেয়াদ বাড়ানো হয়। প্রকল্প ভেদে কারণ ভিন্ন হয়। হতে পারে কোনোটির কাজ ভূমি অধিগ্রহণের জন্য বিলম্বিত হচ্ছে। আবার দেরিতে তহবিল পাওয়ার জন্য হয়তো কাজ পিছিয়ে যাচ্ছে কোনোটির। এছাড়া, করোনারও একটা বড় ভূমিকা আছে।’

প্রকল্পের কাজ ত্বরান্বিত করার ব্যাপারে কোনো পরিকল্পনা আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘করোনা মহামারির মধ্যে এখন কী করতে পারি আমরা? এটা তো বৈশ্বিক একটা সমস্যা।’

দুর্বল পরিকল্পনা

বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক শামসুল হক মনে করেন, তথাকথিত সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের ভিত্তিতে তৈরি দুর্বল পরিকল্পনাই এসব প্রকল্পের সময় ও ব্যয় বৃদ্ধির মূল কারণ।

তিনি বলেন, ‘প্রয়োজনীয় সব উপাদান বিবেচনায় নিয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই করতে হয়। কিন্তু এটা এখন কেবলই আনুষ্ঠানিকতা ও উপহাসে পরিণত হয়েছে।’

অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, ‘ক্লায়েন্টদের ইচ্ছা অনুযায়ী পরামর্শকরা সম্ভাব্যতা যাচাই করে। এমন একটা প্রকল্প খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে পরামর্শকরা সম্ভাব্যতা খুঁজে পায়নি।’

এই পরিবহন বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এড়িয়ে যাওয়া হয় এবং অমীমাংসিত রাখা হয়। ফলে কর্তৃপক্ষ যখন প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু করে, তখন অনেক কিছুই পরিবর্তন করতে হয়। এটি সময় ও ব্যয় বাড়িয়ে দেয়।’

অধ্যাপক শামসুল হক মনে করেন, প্রকল্প কর্তৃপক্ষ, পরামর্শক ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে এসব কাজের জন্য কখনো দায়ী করা হয় না এবং তাদের জবাবদিহিতা নেই বলেই এ ধরনের অপচয় বাড়ছে।

এছাড়া কারিগরি জনবলের অভাবে রেলওয়েসহ সরকারের আরও অনেক সংস্থারই বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতা নেই বলে মনে করেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘দু-একটি প্রকল্পের মেয়াদ বা ব্যয় বাড়তে পারে। কিন্তু প্রায় সব প্রকল্পেরই যদি একই অবস্থা হয়, তাহলে বুঝতে হবে প্রক্রিয়াটাতেই গলদ আছে। আর উন্নয়নের ক্ষেত্রে এই গলদ আমাদের ঝামেলা বাড়াচ্ছে। এসব সমস্যা শুরুতেই সমাধান করতে হবে।’

Comments

The Daily Star  | English

How Islami Bank was taken over ‘at gunpoint’

Islami Bank, the largest private bank by deposits in 2017, was a lucrative target for Sheikh Hasina’s cronies when an influential business group with her blessing occupied it by force – a “perfect robbery” in Bangladesh’s banking history.

8h ago