একজন নার্সের গল্প: ‘ভয় আমাদের দায়িত্বের নিচে চাপা পড়ে গেছে’

গত এক সপ্তাহে করোনা সংক্রমণ বাড়তে থাকায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহসহ একটি শয্যা ক্রমেই দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠতে শুরু করেছে বলে দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।

গত এক সপ্তাহে করোনা সংক্রমণ বাড়তে থাকায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহসহ একটি শয্যা ক্রমেই দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠতে শুরু করেছে বলে দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।

কম মাত্রার অক্সিজেনের স্যাচুরেশন নিয়ে হাসপাতালে আসা মুমূর্ষু রোগীদের অনেককেই একটি খালি শয্যার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকছে না বলেও জানিয়েছেন তারা।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিট। ছবি: রাজু আহমেদ

হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছেন, ‘পরিস্থিতি সামলাতে হাসপাতালের করোনা ইউনিটে দফায় দফায় শয্যার সংখ্যা বাড়াতে হচ্ছে।’

এই হাসপাতালে রয়েছে নিজস্ব কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা। কিন্তু, শয্যা সংখ্যার অতিরিক্ত রোগীদের নির্ভর করতে হচ্ছে সিলিন্ডার থেকে সরবরাহ করা অক্সিজেনের উপর।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, দুই সপ্তাহ আগে যেখানে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আসা রোগীর সংখ্যা বেশি ছিল, সেখানে এখন রাজশাহী শহরের করোনা রোগী বাড়ছে।

মে মাসের মধ্যভাগেও ইউনিটের ছয়টি ওয়ার্ডে ১৫০টি শয্যা ছিল। গত ৩১ মে ১৫ শয্যার আইসিইউ ও কেবিনসহ মোট নয়টি ওয়ার্ডে শয্যা বাড়িয়ে করা হয়েছিল ২৩২টি।

গত ৭ জুন আইসিইউতে আরও তিনটি শয্যা বাড়ানো হয়। গতকাল বুধবার ৩৬ শয্যার নতুন একটি ওয়ার্ড করোনা ইউনিটে যোগ করা হয়। বর্তমানে করোনা ইউনিটের ১০টি ওয়ার্ডে মোট শয্যা সংখ্যা রয়েছে ২৭১টি। কিন্তু, শয্যা বাড়ানো হলেও রোগীর সংখ্যা কমছে না।

আজ বৃহস্পতিবার হাসপাতালের পুরো করোনা ইউনিটে মোট ২৭১ শয্যার বিপরীতে এখন পর্যন্ত রোগীর রয়েছেন ২৯১ জন, সক্ষমতার তুলনায় ২০ জন বেশি।

গত মঙ্গলবার হাসপাতালের পুরো করোনা ইউনিটের মোট শয্যা ২৩৫টির বিপরীতে ২৭৭ জন রোগী ভর্তি ছিলেন, সক্ষমতার তুলনায় ৪২ জন বেশি। গত ৩১ মে মোট রোগী ছিলেন ২০৫ জন।

হাসপাতাল পরিচালক বলেন, ‘পরিস্থিতি এখনো নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি। তবে, আরও শয্যা বাড়ানো দরকার।’

গত সোমবার বিকেলে হাসপাতালের করোনা ইউনিটের একজন নার্স বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন, তারা কীভাবে পরিস্থিতি সামলাচ্ছেন।

সিনিয়র স্টাফ নার্স দুলাল হোসেন (৩১) করোনা ইউনিটের ২৯ ও ৩০ নম্বর ওয়ার্ডে কাজ করছেন।

কর্মক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘কোভিড-১৯ রোগীদের একটি শয্যা পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে দেখে আমার খুব কষ্ট হয়।’

দুলাল যে ওয়ার্ড দুটিতে কাজ করেন, সেখানে ৪৮টি শয্যা রয়েছে। সেখানে তিন জনের বেশি রোগী প্রতিদিন অপেক্ষায় থাকেন।

তিনি জানিয়েছেন, হাসপাতালের করোনা ইউনিটের মোট ৫৫টি হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যনোলার ১৭টি দেওয়া হয় এই ওয়ার্ড দুটিতে।

ছবি: রাজু আহমেদ

দুলাল বলেন, ‘একটি ন্যাজাল ক্যানুলাও পড়ে থাকে না। ওয়ার্ড ভর্তি রোগী। বেশিরভাগ রোগীর উচ্চ-প্রবাহ অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়, কারণ তারা গুরুতর অবস্থায়ই হাসপাতালে আসেন।’

‘রোগীরা এক ফোঁটা অক্সিজেনের জন্য হাঁসফাঁস করেন। কিন্তু, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের অপেক্ষা করা ছাড়া কিছুই করার থাকে না। তারা অপেক্ষা করেন কখন একজন রোগী সুস্থ হয়ে উঠবেন এবং তিনি হাসপাতাল ছেড়ে গেলে সেই শয্যায় তিনি যেতে পারবেন,’ যোগ করেন তিনি।

এই নার্স আরও বলেন, ‘রোগীদের হাঁসফাঁস করতে দেখা খুব বেদনাদায়ক। কিন্তু, এ করুণ দৃশ্য দেখা ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার থাকে না।’

২০১১ সালে বাংলাদেশ নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কাউন্সিল থেকে ডিগ্রি অর্জন করে দুলাল কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন। পরে ২০১৬ সালে রামেক হাসপাতালে সিনিয়র স্টাফ নার্স হিসেবে যোগ দেন।

গত বছর মার্চে হাসপাতালে ৫০ শয্যার করোনা ইউনিট চালু হওয়ার পর থেকে তিনি সেখানেই কাজ করছেন।

তিনি বলেন, ‘প্রথমদিকে (মে মাসের আগে) রোগীর সংখ্যা কম থাকায় ভালোভাবে সেবা দিতে পারতাম। কিন্তু, সেবা দেওয়া ধীরে ধীরে জটিল ও কষ্টসাধ্য হয়ে উঠছে।’

মে মাসের শেষ সপ্তাহে পরিস্থিতি পরিবর্তন হওয়া শুরু করে এবং রোগী বাড়তে থাকে।

দুলাল বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে বেশিরভাগ রোগী কেবল চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা থেকে আসতো। এক সপ্তাহ পর রাজশাহীর গোদাগাড়ী ও তানোর উপজেলা থেকে রোগী আসতে শুরু করল। বর্তমানে রাজশাহী শহরের নানা এলাকা থেকে আসা রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।’

‘রোগীরা ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ অক্সিজেন স্যাচুরেশন নিয়ে মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে আসেন। এই পর্যায়ের রোগীদের তাৎক্ষণিক ও নিবিড় পরিচর্যা দরকার হয়। অনেক রোগী ওয়ার্ডের উচ্চ-প্রবাহ অক্সিজেনে ভালো বোধ করেন না। চিকিৎসকরা তাদের আইসিইউতে পাঠিয়ে দেন’, বলেন তিনি।

রামেক হাসপাতালের এই সিনিয়র স্টাফ নার্স আরও বলেন, ‘তিন জনেরও বেশি রোগী একটি শয্যার জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। একজন রোগী সুস্থ হওয়ার পর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার মুহূর্তে অপেক্ষমাণ রোগীদের পরিচারকরা তাদের রোগীর জন্য শয্যা নিশ্চিত করতে তদবির করতে থাকেন। আমরা কাকে বাদ দিয়ে কাকে সেবা দেব। সবাইকেই যতটুকু সম্ভব ততটুকু সেবা দিতে হয়।’

দুলাল জানিয়েছেন, অনেক রোগীদের শয্যা পাওয়ার জন্য চিকিৎসক, হাসপাতালের কর্মকর্তা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছেও তদবির করতে হয়।

গত সোমবার করোনা ইউনিট পরিদর্শনকালে স্থানীয় সাংবাদিক রাজু আহমেদ দেখেছেন যে, অনেক রোগীকে সিলিন্ডার থেকে অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়েছিল।

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘একজন রোগী ও তাদের পরিচারকরা আমাকে জানিয়েছেন, সিলিন্ডার দুই ঘণ্টার মধ্যে খালি হয়ে যায়, তখন সিলিন্ডার পরিবর্তনের সময় অক্সিজেনের অভাবে রোগীর পরিস্থিতির অবনতি হয়।’

এর আগের দিন সাংবাদিক এ এ এম রানা হাসপাতালে গিয়ে দেখেন, এক নারী করোনা ইউনিটের কাছে বারান্দায় বসে কষ্ট করে শ্বাস নিচ্ছেন। তার পরিচারকরা জানান যে, তাকে ভর্তি করা হয়নি কারণ আরও খারাপ অবস্থার রোগীতে ইউনিটটি পূর্ণ ছিল। পরে সাংবাদিকরা বিষয়টি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানালে, তাকে ভর্তি করে নেওয়া হয়।

নার্স দুলাল জানিয়েছেন, তার কর্মক্ষেত্রে সব থেকে ভালো যে ব্যাপারটি ঘটে তা হলো রোগীদের সুস্থ হওয়া।

‘এটা ঘটে সকাল সাড়ে ৮টা থেকে দুপুর দেড়টার মধ্যে, যখন বিশেষায়িত চিকিৎসকরা ওয়ার্ডগুলোতে রাউন্ড দেন এবং যারা ভালো হয়েছেন দেখেন, তাদের ছাড়পত্র দেন। যখন রোগীরা সুস্থ হয়ে উঠেন এবং আত্মীয়দের সঙ্গে বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নেন, তখন আমাদের অনেক ভালো লাগে’, যোগ করেন তিনি।

দুলাল ও তার সহকর্মীরা প্রতি ১৫ দিন পর পর টানা ১৫ দিন, প্রতিদিন ছয় ঘণ্টা পিপিই পরে দায়িত্বপালন করেন।

তিনি আরও বলেন, ‘পিপিই পরে ছয় ঘণ্টা কাজ করা কঠিন, তবে শ্বাসকষ্টের রোগীদের দেখে আমাদের কষ্ট ভুলে যাই।’

দুলাল জানান, তার জন্য সবচেয়ে ভীতিকর কাজ ছিল দিনের দায়িত্বপালনের পর বাড়ি ফেরা।

‘আমার ভয় হয়, ভাইরাসটি আমার পরিবারে ছড়িয়ে যেতে পারে। আমি গত এক বছর ধরে পরিবারের সদস্যদের থেকে দূরে আলাদা বাড়িতে একা থাকি।’

‘কতক্ষণ পরিবার থেকে দূরে থাকা যায়?’ প্রশ্ন রাখেন তিনি।

দুলাল আরও জানিয়েছেন, গত বছর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ১৫ দিনের কাজ শেষে দুই সপ্তাহ কোয়ারেন্টাইনে কাটানোর জন্য নার্সদের একটি থাকার ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু, এখন তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই।

‘আমি যখন দায়িত্ব শেষ করি, বাড়ি ফেরার আগে হাসপাতালেই গোসল করি। তবে ভয় থেকেই যায়,’ বলেন তিনি।

দুলাল বলেন, ‘করোনা ওয়ার্ডের দৃশ্যগুলো মাঝে-মধ্যে দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। ঘুমের মধ্যে আচমকা জেগে উঠি।’

করোনা ইউনিটে যারা কাজ করে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এমনকি, কোভিড-১৯ এর বিষয়ে কোনো বিশেষ প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়নি বলেও জানিয়েছেন তিনি।

‘আমরা দায়িত্বপালন করতে করতে সব শিখছি। প্রথম প্রথম অনেক ভয় পেয়েছি, কিন্তু, এখন ভয় আমাদের দায়িত্বের নিচে চাপা পড়ে গেছে’, বলেন এই নার্স।

এসব বিষয়ে রামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী বলেন, ‘করোনা ইউনিটে যারা কাজ করছেন, তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি নিয়ে আমরা আলোচনা করব।’

Comments

The Daily Star  | English

Dos and Don’ts during a heatwave

As people are struggling, the Met office issued a heatwave warning for the country for the next five days

3h ago