সিদ্ধান্তহীনতায় রাজশাহী অঞ্চলে ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়েছে

Coronavirus.jpg
ছবি: সংগৃহীত

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে যেসব রোগী ভর্তি হয়েছিলেন তাদের নব্বই শতাংশই সীমান্তবর্তী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জর অধিবাসী। করোনার ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়তে পারে এমন আশঙ্কা নিয়ে তখন থেকেই রাজশাহী ও এর আশেপাশের জেলাগুলোতে লকডাউনের সুপারিশ করে আসছিলেন হাসপাতালটির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী।

এরপর দুই সপ্তাহের বেশি সময় পার হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে স্থানীয় প্রশাসন কেবল রাজশাহী শহরে সাত দিনের সর্বাত্মক লকডাউন ঘোষণা করেছে। এই সময়ের মধ্যে করোনাভাইরাসের ভয়ঙ্কর ডেল্টা সংস্করণ যা ভারতীয় রূপ বলেও পরিচিত— তা শুধু রাজশাহী নয়, এর বাইরের এলাকাতেও ছড়িয়ে পড়েছে। রামেক হাসপাতালে যেমন রোগী বেড়েছে, তেমন বেড়েছে মৃত্যু।

আজ শুক্রবার রামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রি. জেনারেল শামীম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমরা প্রতিরোধের চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু পারিনি। এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। সংক্রমণটা যে ভয়ঙ্কর ভারতীয় ডেল্টা রূপের তাতে সন্দেহের আর কোনো অবকাশ নেই। সামাজিক পর্যায়ে এটা ছড়িয়ে গেছে। কত দূরে গিয়ে এটা থামবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।’

ভারতে মে মাসের মধ্যভাগেই যখন ডেল্টা রূপের করেনাভাইরাসের তাণ্ডব চলছিল, রামেক হাসপাতালের পরিচালকের কাছে খবর আসে যে সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে মানুষ প্রবেশ করছে। সে সময় ঈদ কেন্দ্রিক কেনাকাটার ভিড় বাড়ছিল এবং আমের ব্যবসার প্রস্তুতি চলছিল। ঈদের ছুটিতে অনেকে বাড়িতে আসেন। রাজশাহী অঞ্চলের অনেকে যারা দেশের নানা প্রান্তে কৃষি শ্রমিক হিসেবে ধান কাটার জন্য গিয়েছিলেন, তারাও ফিরে আসেন।

শামীম বলেন, তিনি ১৭ মে স্থানীয় প্রশাসনকে সতর্ক করেছিলেন। একইসঙ্গে লকডাউনের সুপারিশ করেছিলেন। পরের কয়েক দিনেও তিনি গণমাধ্যম ও অনান্য মাধ্যমে বারবার বলেছেন, সংক্রমণ ছড়ানো থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য লকডাউনের কোনো বিকল্প নেই।

চাঁপাইনবাবগঞ্জে ২৪ মে থেকে লকডাউন শুরু হয়। কিন্তু দুই সপ্তাহ পরে সেখানেও নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা হয়। ২৯ মে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও রাজশাহী অঞ্চলের চার জেলাসহ দেশের সীমান্তবর্তী আট জেলায় লকডাউনের সুপারিশ করে।

রাজশাহী, নওগাঁ ও নাটোরের স্থানীয় প্রসাশন তখন আরও সময় নিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের সিদ্ধান্ত নেয়। এই জেলাগুলোতে তখন আম ব্যবসার প্রস্তুতি চলছিল। পরে জমজমাট হয়ে ওঠে আমের ব্যবসা।

গত ২৯ মে রাজশাহীর জেলা প্রশাসক আব্দুল জলিল ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘লকডাউন মানেই ক্ষতির কারণ। কেউই এটা চায় না। আমরা মানুষের জীবনকে অবশ্যই জীবিকার চেয়ে অগ্রাধিকার দিতে চাই। কিন্তু সেটা আমাদেরকে আগে নিশ্চিত হতে হবে।’

গত ৩ জুন রাজশাহী ও নওগাঁয় নৈশকালীন লকডাউন ঘোষণা করা হয়, তবে দিনের বেলা সব নিষেধাজ্ঞা শিথিল ছিল।

এর মধ্যে গত ৬ জুন রাজশাহী শহরে র‌্যাপিড আন্টিজেন পরীক্ষা করা শুরু হয়। প্রথম দিনেই রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো মানুষের মধ্যে ২৯৭ জনের নমুনা পরীক্ষা করে দেখা যায়, অন্তত ২৭ জন করোনায় আক্রান্ত। অর্থাৎ রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো মানুষের মধ্যে করোনায় আক্রান্ত ছিলেন নয় শতাংশ। এর পরে বিকেল ৫টা থেকে লকডাউন শুরু হওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে রাত ৮টার আগে শহরের ব্যস্ততা কমতে দেখা যায়নি।

রাজশাহীর মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘জীবনের সাথে সাথে মানুষের জীবিকাও তো আমাদের রক্ষা করতে হবে। কোটি কোটি টাকার আম ব্যবসা চলছে। সাধারণ মানুষের জীবন এতে জড়িয়ে আছে। সব দিক বিবেচনা করে আমরা আরও কিছু দিন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

গতকাল রাতে জরুরি এক সভা শেষে রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনার হুমায়ুন কবির সার্কিট হাউসে সাংবাদিকদের বলেন, শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে রাজশাহীতে সর্বাত্মক লকডাউন ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

মে মাসের মধ্যভাগে রামেক হাসপাতালের করোনা ইউনিটে মোট শয্যা সংখ্যা ছিল ৬৫। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রাজশাহী অঞ্চলের সব জেলার পরিস্থিতি আঁচ করে আগাম প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। দফায় দফায় করোনা ইউনিটের ওয়ার্ড ও শয্যা সংখ্যা বাড়ানো হয়। পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা। 

আজ শুক্রবার পর্যন্ত হাসপাতালের ১০টি ওয়ার্ডে মোট ২৭১টি শয্যার বিপরীতে রোগী ভর্তি আছেন ২৯৭ জন। আজ সকাল ৮টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা ইউনিটে ১৫ জন মারা গেছেন। তাদের মধ্যে সাত জন করোনায় আক্রান্ত ছিলেন, বাকিরা উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন। এ নিয়ে গত ২৪ মে থেকে হাসপাতালের করোনা ইউনিটে মারা গেছেন মোট ১৫৭ জন। তাদের মধ্যে ৮৩ জন করোনায় আক্রান্ত ছিলেন।

রাজশাহীর দুটি আরটি-পিসিআর ল্যাবরেটরির বৃহস্পতিবারের রিপোর্টে দেখা গেছে, রাজশাহী জেলায় করোনা সংক্রমণের হার ৩৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ। নাটোরে এই হার ৬০ দশমিক ২৭ শতাংশ, নওগাঁয় ৫০ শতাংশ এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৩৯ শতাংশ।

‘আমরা দেখছিলাম যে, আমাদের চিকিৎসা দেওয়ার সক্ষমতা সীমিত। তাই আমরা সবাইকে সতর্ক হতে অনুরোধ করছিলাম। কিন্তু সেটা যখন হতে দেখিনি তখন আমরা যতটা সম্ভব সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করেছি’— বলেন রামেক হাসপাতালের পরিচালক।

তিনি আরও বলেন, ‘এই হাসপাতালের ১৮টি শয্যার নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) সব সময় পূর্ণ থাকছে। নতুন করে ভেন্টিলেটর যুক্ত করতে চাইলেও অবকাঠামো না থাকায় তা সম্ভব হবে না। মোট ২৭১টি শয্যার সব কটিতে সেন্ট্রাল অক্সিজেন আছে। এ ছাড়া, ১৮৩টি শয্যায় অক্সিজেন কনসেনট্রেটর আছে। ৭০০ অক্সিজেন সিলিন্ডার আছে। কিন্তু অক্সিজেন সিলিন্ডার খালি হলে পূর্ণ করে নিয়ে আসার লোকবলের অভাব। এখন আমরা যেটা করছি, নতুন আরও ওয়ার্ড করোনা ইউনিটে যুক্ত করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। এ জন্য প্রতিটি শয্যায় আমাদের অক্সিজেন সরবরাহ লাইন যুক্ত করতে হচ্ছে। রাত-দিন এই কাজই করতে হচ্ছে। মুমূর্ষু রোগী এলে তাকে তো ফেরানো যাবে না। তাকে তো চিকিৎসা দিতে হবে।’

শামীম ইয়াজদানী বলেন, ‘দেরিতে হলেও লকডাউনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। একেবারে না হওয়ার থেকে দেরিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া ভালো। সতর্ক হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। পরিস্থিতি এখনো সাধ্যের বাইরে না। এখনো আমরা সামলাতে পারছি। রোগী কমানো অসম্ভব হলে আমাদের আর কিছু করার থাকবে না।’

Comments

The Daily Star  | English

JP central office vandalised, set ablaze

A group of unidentified people set fire to the central office of Jatiyo Party in Dhaka's Kakrail area this evening

1h ago