স্বপ্নের জন্যে হতাশার চেয়ে বড় শত্রু আর নেই: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। বাকস্বাধীনতা, মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচার বিষয়ক আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। দীর্ঘকাল তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্য যাদের অবদানে উজ্জ্বল, তাদের মধ্যে অন্যতম তিনি।
আজ তার জন্মদিন। ১৯৩৬ সালের ২৩ জুন মুন্সিগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। গতানুগতিক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে বদলানোর স্বার্থেই, অর্থাৎ মানুষের সামাজিক মুক্তির চিন্তায় প্রশ্ন ও চিন্তাকে এগিয়ে দিয়েছেন বছরের পর বছর। কখনো লিখে, কখনো সম্পাদনা করে ও বলে প্রচার করেন তার আদর্শ। সঙ্গে রাষ্ট্রের সংকট সম্ভাবনা। করোনারা মতো ভয়াবহ সময়েও নিয়মিত প্রকাশ করছেন নতুন দিগন্ত। জন্মদিন, ছেলেবেলা, শিক্ষকতা, করোনা মহামারিতে জীবনধারাসহ নানা বিষয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সঙ্গে।
দ্য ডেইলি স্টার: আজ আপনার জন্মদিন। কিছু শুনতে চাই, জানতে চাই।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: করোনায় ঘরবন্দি অনেকদিন। সময় কাটে না। চারদিকে এত এত মৃত্যু খবর ভালো লাগে না। আবার তাতে অভ্যস্ত হয়েও পড়ছি। এর মধ্যে অনেকগুলো অনুভূতির একটি হলো জীবনে যে ঘটনা ও দুর্ঘটনা দেখলাম। কিন্তু, অন্য সবার সঙ্গে আমারও যে স্বপ্ন ছিল, সেটা বাস্তবায়িত হলো না। হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। হয়নি। সমাজে ফাটল ধরেছে, রাষ্ট্রে ভাঙচুর দেখলাম; কিন্তু, ব্যবস্থাটা আগের মতোই রয়ে গেল। ক্ষেত্রবিশেষে মনে হয় অবস্থা খারাপ হয়েছে। একাত্তরে খুব বড় মাপের আশা জেগেছিল, আশা ভেঙ্গে যাওয়াটা তাই খুবই বেদনাদায়ক হয়েছে। তবু আশা রাখি যে নতুন দিন আসবে। সেই অভ্যুদয় আমি হয়তো দেখে যেতে পারব না। কিন্তু, যারা থাকবে তারা দেখবে; এমন আশা বুকের মধ্যে ধারণ করি। স্বপ্নের জন্যে হতাশার চেয়ে বড় শত্রু আর নেই।
বাঁচার সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রামের অব্যাহত ধারা প্রবাহের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাবে, এ আশা সব সময়ই ছিল। এখন সেটা কমছে না, বরঞ্চ বাড়ছেই, দেখতে পাচ্ছি।
ডেইলি স্টার: ‘আমার পিতার মুখ’ বই আছে আপনার। মায়ের ব্যক্তিত্ব আপনার জীবনে কতটা প্রভাব ফেলেছে?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: এটা ভালো প্রসঙ্গ। তবে, বয়স যতই বাড়ছে, ততই বুঝতে পারছি যে আমার জীবনে বাবার প্রভাবের চেয়ে মায়ের প্রভাব গভীরতর। পরিমাপ করা যাবে না, সংজ্ঞায়িত করাও অসম্ভব। প্রভাবটা আছে গভীরে ও অদৃশ্য আকারে। অন্যসব পরিবারের মতোই আমাদের পরিবারও ছিল পিতৃতান্ত্রিক। বাবাকে আমরা আপনি বলে সম্বোধন করতাম, মাকে বলতাম তুমি। এতেই বোঝা যায় মায়ের সঙ্গে সম্পর্কটা ছিল নিবিড়। বাবা ছিলেন আব্বা, মা শুধুই মা। ওই ডাকের ভেতরও ব্যবধানটা ধরা পড়ে।
কিন্তু, আমি আমার পিতার কাছে বহুবিষয়ে ঋণী। অভিভাবক হিসেবে তিনি ছিলেন নিখুঁত এবং অনেক দিক দিয়েই আদর্শস্থানীয়। কী পড়বো, কোথায় পড়ব, কোন পেশাটা ঠিক হবে, এসব বিষয়ে তার পরামর্শ ছিল অত্যন্ত উপকারী। কিন্তু মায়ের কাছ থেকে পেয়েছি আমার স্বভাবের যেগুলোকে ভালো দিক বলে মনে করি, তার অনেকগুলো। সংবেদনশীলতা, ধৈর্য, বিপদে অস্থির না হওয়া— এসব মায়ের কাছ থেকে শেখা। দুঃখ এই যে যথেষ্ট পরিমাণে শিখতে পারিনি। পারলে ভালো হতো। মানুষ হিসেবে আরও ভালো হতাম। বিশেষ করে বিপদে অস্থির না হওয়ার শিক্ষাটা রপ্ত করতে পারলে স্বস্তি বাড়ত। কত যে চ্যালেঞ্জের ভেতর দিয়ে আমার মা তার ৯২ বছরের জীবন কাটিয়েছেন, কিন্তু, কখনো ধৈর্য হারাননি।
ডেইলি স্টার: সেই ধৈর্য থেকেই কি শিক্ষক হয়েছেন? শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা কেমন?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: চিরায়িতভাবে শিক্ষকের প্রধান কাজ তো তার পেশাগত পরিচয়েই রয়েছে। সেটা হলো শিক্ষা দেওয়া। কিন্তু, শিক্ষাদানের বেলায় দেখতে হবে শিক্ষার্থীরা আগ্রহী হচ্ছে কি না, শিক্ষা তারা গ্রহণ করছে কি না। সেজন্য শিক্ষার্থীর আস্থা অর্জনটা দরকার। শিক্ষার্থী চায় শিক্ষককে একজন ‘বীর’ হিসেবে দেখতে। বীর অর্থ শ্রদ্ধার ও অনুকরণের মানুষ। এই সম্মানটি অর্জনের জন্য শিক্ষককে জ্ঞানী হতে হবে, জ্ঞানের চর্চা দরকার পড়বে এবং সেই জ্ঞান বিতরণে আগ্রহও থাকা আবশ্যক হবে। শিক্ষক শিক্ষার্থীকে ভালোবাসবেন, শিক্ষার্থীর কাছ থেকেও তিনি শিখবেন। বিশেষভাবে গ্রহণ করবেন শিক্ষার্থীর উৎসাহ ও প্রাণবন্ততাকে।
ডেইলি স্টার: দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা কি অগ্রগামী, না পশ্চাৎমুখী, কী ঘটছে শিক্ষাব্যবস্থায়?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: আমাদের রাষ্ট্র জনগণের স্বার্থ দেখে না, স্বার্থ দেখে কতিপয়ের। এ রাষ্ট্র জনমতের তোয়াক্কা করে না। আর সামগ্রিকভাবে শিক্ষার মানে যে উন্নতি ঘটছে না সেটা বাস্তবিক সত্য। পরিমাণ যেভাবে বেড়েছে, গুণ সেভাবে বাড়েনি। অল্পকিছু শিক্ষার্থী পাওয়া যাবে যারা ভালো মানের। আগের তুলনাতেও উচ্চ মানের। কিন্তু, গড়পড়তা শিক্ষার্থীর জ্ঞান বাড়ছে না। তারা খবর রাখে। কিন্তু, খবর তো জ্ঞান নয়, খবর তখনই জ্ঞান হয় যখন সে সুগঠিত হয়, প্রাণবন্ত থাকে এবং ক্রমাগত বৃদ্ধি পায়, সেই সঙ্গে প্রযুক্তও হয়।
ডেইলি স্টার: করোনা এসে গোটা পৃথিবীর চিন্তা ভাবনা, জীবনধারা পরিবর্তন করে দিয়েছে। আপনি কীভাবে দেখছেন বিষয়টা?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: এটা মহাদুর্যোগ অবশ্যই। করোনাভাইরাস প্রকৃতি থেকেই এসেছে; কিন্তু প্রাকৃতিক কারণে এর উদ্ভব হয়নি, হয়েছে মানুষের কারণে। মানুষ প্রকৃতিকে উত্ত্যক্ত করেছে, প্রকৃতি তার প্রতিক্রিয়া জানিয়ে দিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, প্লাবন, খরা— সব কিছুই ঘটছে প্রকৃতির ওপরে মানুষের অত্যাচারের ফল হিসেবে। করোনাও ওই প্রতিক্রিয়াই, ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া। কাজেই শত বছর পরে এটা এসেছে, সেভাবে না দেখে দেখতে হবে শত বছর ধরে মানুষের ইতিহাস যে পথে এগিয়েছে, এটি সেই অগ্রগতির ভেতরকার ভ্রান্তি থেকেই মহাদুর্যোগের আবির্ভাব। এক শ বছরে মানুষ অভূতপূর্ব উন্নতি করেছে, কিন্তু, সেই উন্নতি মানুষকে যে নিরাপত্তা দেয়নি, এটা তারই প্রমাণ। সভ্যতার পুঁজিবাদী কারিগররা মানুষ মারার অস্ত্র উদ্ভাবনে যে পরিমাণ মনোযোগ দিয়েছে, সে মনোযোগের সিকিভাগও যদি রোগপ্রতিরোধ ও চিকিৎসার জন্য দিত, তাহলে এই মহাদুর্যোগ ঘটত না।
ডেইলি স্টার: লাখো মানুষ কর্মহীন, নগর ছাড়া হাজারো মানুষ। সংকটে রাষ্ট্রের ভূমিকা আশাবাদী করে তোলে না। বুদ্ধিজীবীরা নীরব। কার কী করণীয়?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: চতুর্থ শিল্প বিপ্লব নিয়ে আমি চিন্তিত নই। আমার চিন্তা পুঁজিবাদের তাণ্ডব নিয়ে। করোনাভাইরাস নিশ্চয়ই নিয়ন্ত্রণে আসবে। টিকা পাওয়া যাবে, চিকিৎসাও উন্নত হবে। কিন্তু, আগামীতে নতুন কোনো মহাবিপদ যে আসবে না, তার নিশ্চয়তা কী? আসবে, আসতে বাধ্য। অন্য কিছু না হোক, সেটা একটি মহানৈরাজ্য হিসেবে আসতে পারে। নৈরাজ্য যাতে না আসে, নৈরাজ্যের বদলে যাতে সুসংগঠিত বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে, সেটা দেখাই এখন কর্তব্য। এটা সব দেশের মানুষকেই দেখতে হবে এবং প্রত্যেক দেশেই সামাজিক বিপ্লব সম্পন্ন করা চাই। তাহলে নতুন এক আন্তর্জাতিকতা সৃষ্টি হবে, যেটি হবে সহযোগিতার ও সহমর্মিতার। সেই পৃথিবীটাতে নতুন কোনো বিশ্বযুদ্ধ বাধবে না। উৎপাদনের পুঁজিবাদী সম্পর্ক ভেঙে সামাজিক উৎপাদন ও সামাজিক বণ্টনের মাধ্যমে পৃথিবী প্রাচুর্যে ভরে উঠবে, মানুষের জীবনে সুখ, স্বস্তি ও অবকাশ, কোনো কিছুরই অভাব থাকবে না।
ডেইলি স্টার: সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমাজ নিয়ে দীর্ঘকাল বিশ্লেষণ-গবেষণা করেছেন। কতটা এগিয়েছে বলে মনে করেন?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইতিবাচক ঘটনা দেখছি সচেতনতা বৃদ্ধি। এখন দেশের অধিকাংশ মানুষই রাষ্ট্র ও তার কাজকর্ম সম্বন্ধে সচেতন। তরুণরা সচেতন বেশ ভালোভাবে। এই সচেতনতা মোহমুক্তির, একে দাবিয়ে রাখা হয়, তবে, হঠাৎ হঠাৎ, সাময়িক আন্দোলনে তার প্রকাশ ঘটে। এই তরুণরাই ভরসা। আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি শুধু যে স্বাধীনতার জন্য তা তো নয়। যুদ্ধ করেছি শ্রেণিবৈষম্য দূর করার জন্যও। শ্রেণিবৈষম্য দূর হবে কী, বরঞ্চ অনেক বেড়েছে।
ডেইলি স্টার: লিখে চলছেন অবিরত, কথা বলেন সাহসী কণ্ঠে, কোথায় খুঁজে পান এত প্রাণরস?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: আমার ক্ষেত্রে লেখাই বেশি ঘটেছে, বলা কম। অবশ্য লেখার ভেতরেও বক্তব্য থাকে। লিখি কিছুটা অভ্যাসবশত, অনেকটা এর চেয়ে ভালো কোনো কাজ করার ক্ষমতা নেই বলে। তবে, সূত্রাকারে বলতে গেলে বলতে হয় বাইরের অবস্থা ও ভেতরের সংবেদনশীলতাই দায়ী লেখা, পত্রিকা সম্পাদনা, সংগঠন গড়ে তোলা ইত্যাদি কাজে আমার যুক্ত থাকার জন্য।
আরও পড়ুন:
স্বকীয়তায় উজ্জ্বল সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পর্যালোচনা নয়, বাতিল করতে হবে’
বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণেই ত্বকীদের হত্যার বিচার হয় না: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
ক্যাম্পাসে ভিন্নমত না থাকায় ভয়ংকর অন্ধকারের দিকে যাচ্ছি: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
Comments