বঙ্গবন্ধু সেতুর টোল বাড়ছে প্রায় ১৭ শতাংশ, বাড়ছে মুক্তারপুর সেতুর টোলও
রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় মেটানো ও ঋণ পরিশোধের জন্যে আয় বাড়ানোর লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু সেতুর টোল প্রায় ১৭ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া, ২০০৮ সালে উদ্বোধনের পর প্রথমবারের মতো মুন্সিগঞ্জের মুক্তারপুর ব্রিজের টোলও বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সভাপতিত্বে সেতু কর্তৃপক্ষ বোর্ডের ১১০তম সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
তবে, সংশোধিত এ টোল হার কার্যকর করার আগে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন দরকার হবে। তার অনুমোদন পেলে আগামী অক্টোবর থেকে নতুন এ টোল হার কার্যকর করা হতে পারে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
টোল বাড়ানোর এ সিদ্ধান্ত এমন সময়ে নেওয়া হলো, যখন দেশে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ চলছে এবং অর্ধেক যাত্রী নিয়ে চলাচল করার কারণে ইতোমধ্যেই বাস ভাড়া ৬০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। নতুন সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে ওই দুটি সেতুর ওপর দিয়ে চলাচলকারী যানবাহনের ভাড়া আরও বাড়তে পারে।
তবে, প্রকল্প কাজ এখনো শেষ না হওয়ায় নির্মাণাধীন পদ্মা সেতুর টোল হার প্রস্তাবের অনুমোদন দেয়নি সেতু কর্তৃপক্ষ বোর্ড। বোর্ড সূত্র জানিয়েছে, সেতুটি যানবাহন চলাচলের জন্যে খুলে দেওয়ার তিন বা চার মাস আগে এর টোল হার নির্ধারণের সিদ্ধান্ত হয়েছে সভায়। আগামী বছরের জুনে এটি যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হতে পারে।
যোগাযোগ করা হলে সেতু কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক এবং সেতু বিভাগের সচিব আবু বকর ছিদ্দীক বলেন, তারা টোল হার ‘কিছুটা’ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু সেতুর টোল গড়ে প্রায় ১৭ শতাংশ বাড়বে।’
তবে, মুক্তারপুর সেতুর টোল হার তাৎক্ষণিকভাবে মনে করতে পারেননি আবু বকর ছিদ্দীক। তিনি বলেন, ‘আমাকে কাগজপত্র দেখতে হবে। তবে, এটিও সম্ভবত বঙ্গবন্ধু সেতুর মতোই বেড়েছে।’
চার দশমিক আট কিলোমিটার দীর্ঘ বঙ্গবন্ধু সেতু ১৯৯৮ সালে যানবাহন চলাচলের জন্যে খুলে দেওয়া হয়। যমুনা নদীর ওপর নির্মিত এ সেতু দেশের পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের মধ্যে সড়ক, রেল, বিদ্যুৎ ও টেলিকমিউনিকেশন যোগাযোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। তিন হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়।
গত ৬ জুন ওবায়দুল কাদের সংসদে বলেন, ২৩ বছর আগে উদ্বোধনের পর থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু সেতু ব্যবহারকারী যানবাহন থেকে টোল হিসেবে ছয় হাজার ৪৩৪ কোটি টাকা আদায় করা হয়েছে।
এক সংসদ সদস্যের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ সময়ের মধ্যে সেতুটির পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচ এবং ডিএসএল (ডেবট সার্ভিস লায়াবিলিটি) প্রদান বাবদ চার হাজার ১০৪ দশমিক ২১ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। সেতুটি নির্মাণের জন্য উন্নয়ন অংশীদারদের কাছ থেকে নেওয়া ঋণ আগামী ২০৩৪ সালের মধ্যে পরিশোধ করে দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
এ ছাড়া, ধলেশ্বরী নদীর ওপর নির্মিত দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ মুক্তারপুর সেতুটি ২০০৮ সালে খুলে দেয় সেতু কর্তৃপক্ষ। মুন্সিগঞ্জকে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের সঙ্গে সংযুক্ত করতে ২০৮ দশমিক ৩৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের আওতায় এ সেতু নির্মিত হয়।
সংশোধিত টোল হার
২০১১ সালে সংশোধিত বঙ্গবন্ধু সেতুর টোল রেট অনুসারে, বর্তমানে সেতুটি ব্যবহারের জন্য একটি মোটরসাইকেলকে ৪০ টাকা, ব্যক্তিগত গাড়িকে ৫০০ টাকা, মিনিবাসকে ৬৫০ টাকা, বাসকে ৯০০ টাকা, ছোট ট্রাককে ৮৫০ টাকা ও বড় ট্রাককে এক হাজার ৪০০ টাকা দিতে হচ্ছে।
সেতু কর্তৃপক্ষ দুই বার এ হার বাড়ানোর চেষ্টা করেছিল। তবে, সে চেষ্টা সফল হয়নি। গত বছরের নভেম্বরে কর্তৃপক্ষ যখন টোল হার সংশোধনের প্রস্তাব দেয়, তখন দেশের মহামারি পরিস্থিতি বিবেচনা করে তা গ্রহণ করেনি সেতু কর্তৃপক্ষ বোর্ড।
মুক্তারপুর সেতুর টোল বাড়ানোর প্রস্তাবও ওই সভায় নাকচ করে দেওয়া হয়।
বর্তমান টোল হার অনুসারে, সেতুটি ব্যবহারের জন্য মোটরসাইকলকে ১০ টাকা, অটোরিকশাকে ২০ টাকা, ব্যক্তিগত গাড়িকে ৪০ টাকা, মিনিবাসকে ১০০ টাকা, বাসকে ২০০ টাকা, ছোট ট্রাককে ১৫০ টাকা ও বড় ট্রাককে ৫০০ টাকা করে দিতে হয়।
গতকাল সেতু কর্তৃপক্ষ বোর্ডের সামনে আবারও টোল বাড়ানোর প্রস্তাব রাখে। এতে টোলের হার ১০ থেকে ৫০ শতাংশ বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু সেতুতে বাইকের জন্য ৫০ টাকা, গাড়ির জন্য ৫৫০ টাকা, মিনিবাসের জন্য ৭৫০ টাকা, বাস ও ছোট ট্রাকের জন্য এক হাজার টাকা এবং বড় ট্রাকের জন্য এক হাজার ৬০০ টাকা টোল নির্ধারণের প্রস্তাব দিয়েছে সেতু কর্তৃপক্ষ।
এ ছাড়া, মুক্তারপুর সেতুতে অটোরিকশার জন্য ৩০ টাকা, গাড়ির জন্য ৫০ টাকা, মিনিবাসের জন্য ১৫০ টাকা, বাসের জন্য ২৫০ টাকা, ছোট ট্রাকের জন্য ২০০ টাকা ও বড় ট্রাকের জন্য ৬০০ টাকা টোল নির্ধারণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তবে, বাইকের টোল অপরিবর্তিত রাখার কথা বলা হয়েছে।
নাম গোপন রাখার শর্তে সভা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল এক কর্মকর্তা দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন, বোর্ড টোলের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছে এবং সেতুমন্ত্রী কিছু ক্ষেত্রে টোল কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন। সেতুমন্ত্রী আরও বলেছেন, চলতি বছরের অক্টোবরের আগে এ সংশোধিত টোল কার্যকর করা উচিত হবে না।
পরিবহন মালিকরা যা বলছেন
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ জানিয়েছেন, টোল হার বাড়ানোর কোনো উদ্যোগের বিষয়ে তারা অবগত ছিলেন না।
গতকাল ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, ‘মহামারির কারণে এমনিতেই আমাদের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত। এ অবস্থায় আমাদের সঙ্গে কথা না বলে টোল হার বাড়ানো মোটেই ঠিক হয়নি।’
বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক রুস্তম আলী খান বলেন, ‘যানবাহনের পরিচালন ব্যয় বাড়লে, ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানের ভাড়াও বাড়বে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আবু বকর ছিদ্দীক বলেন, ‘দুটি সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়, ঋণ পরিশোধ ও দুটি নতুন প্রকল্পের জন্যে তহবিল সংগ্রহের জন্য তাদের টোলের ওপর নির্ভর করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘শেষ সভার আগে (২০২০ সালের নভেম্বরে) টোল বাড়ানোর প্রস্তাব রাখা হয়েছিল। তবে, তখন তা অনুমোদিত হয়নি। সেতু কর্তৃপক্ষকে পরবর্তী সভার আগে এ প্রস্তাব রাখতে বলা হয়। তাই আজ (গতকাল) বোর্ডকে সভার আগে আমরা এ প্রস্তাব উপস্থাপন করেছি এবং অনুমোদন পেয়েছি।’
নথির তথ্য অনুসারে, মে’র প্রথম ২৪ দিন দূরপাল্লার বাস চলাচলে বিধি-নিষেধ থাকলেও, ওই মাসে মোট আট লাখ ২৬ হাজার ২১৬টি যানবাহন বঙ্গবন্ধু সেতু পার হয়েছে। এসব যানবাহন থেকে রেকর্ড ৫৭ দশমিক ৬৮ কোটি টাকা টোল আদায় করেছে সেতু কর্তৃপক্ষ।
এ ছাড়া, মুক্তারপুর সেতু থেকে গত মাসে এক দশমিক ৭২ কোটি টাকা টোল আদায় করেছে কর্তৃপক্ষ।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন জারীন তাসনিম
Comments