১০ জুলাই ১৯৭১: মুক্তিবাহিনী এখনও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে- দ্য ইকোনমিস্ট

১০ জুলাই ১৯৭১। দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেন কানাডার সংসদীয় প্রতিনিধিদলের প্রতিনিধিরা। এ সময় ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তারা আলোচনা করেন পূর্ব বাংলা থেকে আসা শরণার্থীদের বিষয়ে।

১০ জুলাই ১৯৭১। দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেন কানাডার সংসদীয় প্রতিনিধিদলের প্রতিনিধিরা। এ সময় ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তারা আলোচনা করেন পূর্ব বাংলা থেকে আসা শরণার্থীদের বিষয়ে।

ইন্দিরা গান্ধীকে কানাডার সংসদীয় প্রতিনিধি দলের সদস্যরা বলেন, কানাডা শরণার্থীদের পাশে সবসময়ই আছে। ইতোমধ্যে কানাডা সরকার শরণার্থীদের সহায়তার জন্য যে অর্থ বরাদ্দ করেছে তা শিগগির ভারতে পৌঁছাবে। কানাডা বিশ্বাস করে পূর্ব পাকিস্তান নামে কোনো রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রাংশের অস্তিত্ব আর নেই। বাংলাদেশ আজ একটি বাস্তব সত্য। পূর্ব বাংলার নেতা শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার দাবি জানিয়ে অন্যায় কিছু করেননি। আমরা শরণার্থীদের সঙ্গে কথা বলে যা শুনেছি, তা নিতান্তই পৈশাচিক ও নির্মমতার সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এটা এখন পরিষ্কার যে পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ পরিকল্পিতভাবে একটি জাতিকে ধ্বংস করতে চেয়েছে।

তারা আরও বলেন, এটা এই শতাব্দীর সবচেয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায়। ইন্দিরা গান্ধী এ সময় ভারতের পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণায় কানাডার সংসদীয় দলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।

এই দিনে কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডের প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সদর দপ্তরে ১১ জুলাই থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত শুরু হওয়া সাত দিন ব্যাপী সেক্টর কমান্ডার সম্মেলনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়। ১১ জুলাই শুরু হওয়া এই সম্মেলনে যোগ দিতে ১০ জুলাইয়ের মধ্যেই  কলকাতায় হাজির হন মুক্তিবাহিনীর উচ্চপদস্থ কমান্ডারসহ সেনাবাহিনীর উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা। ১১ জুলাই সম্মেলনের প্রথম দিনে সাত দিনব্যাপী এই সম্মেলনের উদ্বোধন করেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ।

১০ জুলাই প্রভাবশালী ব্রিটিশ দৈনিক দ্য ইকোনমিস্ট ‘মুক্তিবাহিনী এখনও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই প্রতিবেদনে বলা হয়, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের দেওয়া সময়সূচী শুরু হলেও পূর্ব পাকিস্তানে এখনও কোনো উন্নতির চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত  কোনো আওয়ামী লীগের সদস্যই এখন পর্যন্ত ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। পাকিস্তানের সামরিক সরকার এরই মধ্যে ৩২ জন আওয়ামী প্রাদেশিক সদস্যের যে তালিকা করেছে তাদের প্রায় বেশিরভাগ সদস্যই  দেশত্যাগ করেছেন। আর যে অল্প কয়েকজন বাকি ছিলেন তারা ইয়াহিয়া খানকে সমর্থন করেছেন। এই মুহূর্তে মুক্তিবাহিনীর সকল কার্যক্রমই প্রায় সীমান্ত অঞ্চলে সংগঠিত হচ্ছে। পাকিস্তানি সামরিক প্রশাসন আমাদের জানিয়েছে, শুধু কুমিল্লাতেই মুক্তিবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধারা আটটি রেল সেতু ও ১৫টি সড়ক সেতু উড়িয়ে দিয়েছে।  ঢাকার উত্তরে, মধুপুর বনাঞ্চলে, নোয়াখালী, বরিশাল, খুলনায় মুক্তিযোদ্ধারা ও নকশালপন্থী ভারতীয়রা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ গড়ে তুলেছে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা পাঁচ হাজার নতুন পুলিশ সদস্যকেও নিরাপত্তার দেওয়ার জন্য হিমশিম খেতে হচ্ছে। গত শুক্রবার ২ জুলাই ঢাকায় একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে হামলার পর ঢাকা অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। এর পরদিন ঢাকা  ময়মনসিংহ সড়কে একটি সেতু উড়িয়ে দিয়েছিল মুক্তিবাহিনী। বিহারী, জামায়াতে ইসলামীর সদস্য, মুসলিম লীগের নেতারা এখন মুক্তিবাহিনীর নজরে আছে। সমস্ত বড় শহরে বোমা হামলা করেছে গেরিলারা। এরই মধ্যে ১০ শান্তি কমিটির সদস্য নিহত হয়েছে মুক্তিবাহিনীর হামলায়। তবে ছোট শহরগুলোতে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে।

ঢাকায় এদিন

১০ জুলাই ঢাকার ধানমণ্ডি ২ নম্বর সড়কে ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলা দল পুলিশের ওপর গ্রেনেড হামলা চালায়। এ সময় এক পুলিশ অফিসারসহ পাঁচ পুলিশ নিহত হয়।

১০ জুলাই পূর্ব পাকিস্তান রেডক্রসের প্রধান নির্বাহী  বিচারপতি নুরুল ইসলাম পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে  পাকিস্তানের পক্ষে প্রচারণা চালানোর জন্য বেশ কয়েকটি দেশ সফর করে ঢাকায় ফিরে আসেন। সর্বশেষ তিনি  রেডক্রসের জন্য সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় যান। জেনেভা থেকে প্যারিস, স্টকহোম, নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটন হয়ে  লন্ডন সফর শেষে তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন।

১০ জুলাই অস্ট্রেলিয়ার এমপি লেন এস রিড করাচী সফর শেষে পাঁচ দিনের সফরে ঢাকা এসে পৌঁছান।

ভারতে এদিন

১০ জুলাই নদীয়ার কৃষ্ণনগরের ভাগীরথী নদীর তীরে পলাশী গ্রামে নৌবাহিনীর কমান্ডো সাব লেফটেন্যান্ট মোহাম্মাদ রহমতুল্লাহর তত্ত্বাবধানে ১২০ সদস্যের একটি বিশেষ দল নৌ কমান্ডোর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে।

১০ জুলাই ভারতের দৈনিক হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড এক প্রতিবেদনে বলে, পাকিস্তানকে দেওয়া মার্কিন সমরাস্ত্র সহায়তার জন্য কলকাতাস্থ মার্কিন উপ দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ করেছে বাংলাদেশ থেকে ভারতে আশ্রয় নেওয়া বহু ছাত্র। গতকাল সন্ধ্যায় বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম সহায়ক সমিতির আয়োজনে কংগ্রেস নেত্রী পূরবী মুখার্জি, পশ্চিমবঙ্গের সংসদ সদস্য গীতা মুখার্জি, বিপ্লবী রেনুকা রায়ের নেতৃত্বে কয়েকশ নারী মার্কিন উপদূতাবাসের  সামনে পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহের প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেছে। এ সময় তারা পাকিস্তানকে দেওয়া সমস্ত অস্ত্র সহায়তা ফিরিয়ে নিতে এবং শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে মার্কিন সরকারের হস্তক্ষেপ চেয়ে কলকাতাস্থ মার্কিন উপ রাষ্ট্রদূত জেনারেল হার্বার্ট গর্ডনের কাছে একটি প্রতিবাদ লিপি ও স্মারকলিপি প্রদান করে।

আন্তর্জাতিক মহলে এদিন 

১০ জুলাই কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিচেল শার্প কানাডার প্রভাবশালী গণমাধ্যম গ্লোব অ্যান্ড মেইল পত্রিকায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করা হয়তো কাণ্ডজ্ঞানহীন কর্মকাণ্ড মনে হতে পারে। কিন্তু এখন এটিই বাস্তব। সংকট নিরসনের জন্য এটিই একমাত্র পথ হিসেবে বাকি রয়েছে। পাকিস্তান সরকার গণতান্ত্রিক পথের কথা বলছে, তা ইতোমধ্যেই পাকিস্তান সরকার নিজেরাই ধ্বংস করেছে। যদিও গণতান্ত্রিক সরকারই সবচেয়ে উত্তম পন্থা। জাতিসংঘ কী ব্যবস্থা নিচ্ছে তার দিকে আমরা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখছি।

১০ জুলাই ভেনিজুয়েলার কারাকাসে দ্যা রিলিজিয়ন পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পাকিস্তান সরকার ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ দেখলে যীশু খ্রিস্ট নিজেও শিউরে উঠতেন। পূর্ব পাকিস্তানে যা হচ্ছে তা কল্পনাকেও হার মানায়।

এই দিনে ব্রিটেনের লিস্টারে শরণার্থীদের সাহায্যার্থে ভারতের জাতীয় ক্রিকেট দলের সদস্যদের সই করা  একটি ব্যাট বিক্রি হয়। এই ব্যাটটি ৭৭ পাউন্ডে কেনেন এক প্রবাসী ভারতীয় সমর্থক।

দেশজুড়ে প্রতিরোধ যুদ্ধ

১০ জুলাই চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ কয়েকটি ঘাঁটি পরিদর্শন করেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল  আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজি। এ সময় তার সঙ্গে স্থানীয় শান্তি কমিটির সভাপতিদের সঙ্গে বৈঠক হয়। একই সঙ্গে এ দিন জেনারেল নিয়াজি চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের সঙ্গে বৈঠক করেন। চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় জেনারেল নিয়াজিকে বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে দুষ্কৃতকারীদের আক্রমণের সকল স্থল ও নৌপথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে দুষ্কৃতকারীদের সম্পূর্ণরূপে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা পাকিস্তানের ওপর কোনো আঘাত সহ্য করতে পারি না।’

১০ জুলাই কুমিল্লার শালদা নদী এলাকার মঈনপুরে সুবেদার আব্দুল ওয়াহাবের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সেনা বোঝাই একটি স্পীডবোটকে অ্যামবুশ করে। এতে দুজন লেফটেন্যান্ট  কর্নেল, দুজন মেজর, তিন জন ক্যাপ্টেন, একজন নায়েব সুবেদার, তিন জন সিপাই ও একজন অবাঙালি ব্যবসায়ীসহ মোট ১২ জন নিহত হয়। ‘কুমিল্লার জল্লাদ’  বলে পরিচিত ক্যাপ্টেন বোখারি এই হামলায় নিহত হন।

এ দিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঘোষণা করে, সুবেদার ওয়াহাবের মরদেহ যে নিয়ে আসবে তাকে ৫০ হাজার টাকা পুরস্কৃত করা হবে।

১০ জুলাই কুমিল্লার শালদা নদীর সাগরতলায় মুক্তিবাহিনীর ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হামলা চালায়। এ সময় মুক্তিবাহিনীও তীব্র আক্রমণ গড়ে তোলে। মুক্তিবাহিনীর  মর্টার ও মেশিনগানের পাল্টা আক্রমণে প্রায় ৪০ জনের মতো হানাদার নিহত হয়। এ সময় বৃষ্টির মতো গোলাগুলিতে হানাদার বাহিনী তাদের ক্যাম্পে ফিরে যেতে বাধ্য হয়।

১০ জুলাই নওগাঁর মধইলে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার মকাই চৌধুরীর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল হানাদার বাহিনীর ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। এ সময় ছয় জন হানাদার সেনা নিহত হয়।

 

তথ্যসূত্র:

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র ষষ্ঠ, সপ্তম, দশম, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড।

দৈনিক পাকিস্তান, ১১ জুলাই ১৯৭১

দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ১১ জুলাই ১৯৭১

দ্য ইকোনমিস্ট, ১০ জুলাই ১৯৭১

আহমাদ ইশতিয়াক, [email protected]

Comments