১৫ জুলাই ১৯৭১: কলকাতায় শপথ নেন মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডাররা

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১৫ জুলাই গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বলা হয়, ‘সম্প্রতি পাকিস্তানকে উন্নয়ন সাহায্য দেওয়ার মতো আদৌ কোনো অবস্থা রয়েছে কি না, তা সরেজমিন তদন্ত করার জন্যে বিশ্বব্যাংকের একটি বিশেষ প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। বাংলাদেশ ও পশ্চিম পাকিস্তান সফর করে ফিরে গিয়ে তারা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন।’

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১৫ জুলাই গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বলা হয়, ‘সম্প্রতি পাকিস্তানকে উন্নয়ন সাহায্য দেওয়ার মতো আদৌ কোনো অবস্থা রয়েছে কি না, তা সরেজমিন তদন্ত করার জন্যে বিশ্বব্যাংকের একটি বিশেষ প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। বাংলাদেশ ও পশ্চিম পাকিস্তান সফর করে ফিরে গিয়ে তারা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন।’

সেই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানকে দেওয়া বিশ্ব ব্যাংকের সব সাহায্য বন্ধ করা হোক। একইসঙ্গে ক্ষমতাধর দেশগুলো যেন পাকিস্তানকে সহায়তা না করে, সে বিষয়ে অনুরোধ করা হোক। এই মুহূর্তে যদি পূর্ব পাকিস্তানে ত্রাণ সহায়তার জন্যে পাকিস্তানকে কোনো প্রকার সহায়তা দেওয়া হয়, তবে, তা পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাবে না। বরং পাকিস্তান সরকার নিজেদের প্রয়োজনেই তা ব্যয় করবে। তাই এই মুহূর্তে পাকিস্তানকে সহায়তা দেওয়া সম্পূর্ণরূপে অর্থহীন।’

১৫ জুলাই মোট নয়টি বাম দল বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটি নামে একটি নতুন জোট গঠন করে। এই জোটে আটটি সমমনা বামদল ছাড়াও ভাসানী ন্যাপ যুক্ত ছিল। এদিকে এই জোট গঠনের খবর শুনে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র ও ত্রাণমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান মুজিবনগর থেকে সংবাদপত্রে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলেন, ‘জনযুদ্ধের এই সময় নির্বাচনে কোনো আসন না পাওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর এ ধরনের পদক্ষেপ পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী এবং চীনকেই শক্তিশালী করবে। আমরা আশা করি সব দলের কর্মীরাই বাংলাদেশ সরকারকে সহযোগিতা করে আমাদের বিজয়ের পথ সুগম করবে।’

ঢাকায় এদিন

১৫ জুলাই ঢাকায় কনভেনশন মুসলিম লীগের প্রাদেশিক কমিটির সভাপতি শামসুল হুদা কনভেনশন মুসলিম লীগের ঢাকা শহর কমিটি বাতিল করে দেন। এদিন তিনি এ এইচ মোহাম্মদ হোসেনকে সভাপতি ও নাসির উদ্দিনকে সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করে নতুন কমিটি গঠন করেন।

ভারতে এদিন

১৫ জুলাই কলকাতার আট নম্বর থিয়েটার রোডে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের কার্যালয়ের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে বৈঠক করেন মুক্তিবাহিনীর সেক্টর কমান্ডারেরা। এদিন  তাদের আনুষ্ঠানিক শপথ অনুষ্ঠান হয়। একই দিনে আওয়ামী লীগের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের বৈঠকে মুক্তিবাহিনী নৌ ও বিমান শাখা গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের উদ্দেশে বলেন, ‘বাংলাদেশের বিজয় অর্জন করতে হলে হানাদারদের বিরুদ্ধে নিজের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। এ ছাড়া আমাদের কোনো পথ খোলা নেই। একমাত্র পথ আমাদের দেশকে হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত করে শত্রু মুক্ত করা।’

পাকিস্তানে এদিন

১৫ জুলাই ইসলামাবাদে পাকিস্তান সরকারের এক সরকারি মুখপাত্র বলেন, ‘পাকিস্তান সরকার কমনওয়েলথের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার প্রশ্নটি বর্তমানে বিবেচনা করছেন।’

আন্তর্জাতিক মহলে এদিন

১৫ জুলাই ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগের এক মুখপাত্র বলেছেন, ‘পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানে বিরাজিত পরিস্থিতি বিবেচনা করে উন্নয়ন পরিকল্পনার একটি নয়া তালিকা পেশ না করা পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানে আর্থিক ও কারিগরি সাহায্য দান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে, পূর্ব পাকিস্তানে মানবিক সাহায্য প্রেরণ অব্যাহত থাকবে।’

মুখপাত্র আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে পাকিস্তানের সকল রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে একটি সন্তোষজনক রাজনৈতিক সমঝোতার জন্যে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানিয়ে আসছে। অবশ্য পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছানোর বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত কোনো ফর্মুলার প্রস্তাব দেয়নি।’

একই দিনে ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরী ও পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির সহ-সভাপতি মাহমুদ আলী। সেসময় তারা দুজন পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে বিশ্ব ব্যাংকের রিপোর্ট পুনর্বিবেচনা করার আবেদন জানান। হামিদুল হক চৌধুরী সেসময় বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারাকে বলেন, ‘ভারত এখন পাকিস্তানের নামে পুরো বিশ্বে কুৎসা রটিয়ে যাচ্ছে, একইসঙ্গে মিথ্যাচার প্রচার করছে। পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক আছে। সেখানে আমাদের সামরিক বাহিনীর বিশৃঙ্খলাকারীদের বিরুদ্ধে পাওয়া অভিযোগ প্রমাণ সাপেক্ষে কঠোর হস্তে দমন করছে।’

১৫ জুলাই সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্রেমলিনে ভারতের সংসদ-বিষয়ক মন্ত্রী ওম মেহতা সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাইস প্রেসিডেন্ট বাগদার নাসসুদ্দনোভার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেসময় ওম মেহতা শরণার্থীদের অবস্থা ও পূর্ব বাংলা সম্পর্কে বাগদার নাসসুদ্দনোভারকে সব বিষয়ে বিস্তারিত বলেন। বাগদার নাসসুদ্দনোভার ওম মেহতাকে বলেন, ‘এই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে সোভিয়েত সরকার বিবেচনা করছে। এই মুহূর্তে আমরা কোনোভাবেই পাকিস্তানকে অস্ত্র সহায়তা বা অস্ত্র বিক্রি করতে পারি না। পাকিস্তান সরকার যতক্ষণ পর্যন্ত না পূর্ব বাংলার বিষয়ে কোনো পূর্ণাঙ্গ সমাধানে আসতে পারবে এবং শরণার্থীদের নিরাপদে স্বদেশে ফেরত না নিতে পারবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা পাকিস্তান সরকারের বিষয়ে কোনো প্রকার সম্পর্ক স্থাপন করবো না।’

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এদিন

১৫ জুলাই ভারতের বিখ্যাত দৈনিক দ্য স্টেটসম্যান এক প্রতিবেদনে বলে, ‘বাংলাদেশে গণহত্যা প্রশ্নে আইরিশ এমপি স্যার এন্থনি এজমন্ড ও উইলিয়াম লোগান বুধবার কলকাতায় এক প্রেস কনফারেন্সে বলেন, “বাংলাদেশ থেকে ৭ মিলিয়ন শরণার্থীর ভারতে অনুপ্রবেশ দেশটির অর্থনীতিতে একটি ভয়াবহ প্রভাব ফেলবে”।’

একই দিনে দৈনিক যুগান্তরের এক প্রতিবেদনে  বলা হয়েছে, ‘মুক্তিযোদ্ধারা নাভারন ও জিকরগাছা দখল করে নিয়েছে। এখানকার অধিবাসীরা আশ্রয়ের জন্য ভারতে চলে এসেছে। অবশ্য এ অঞ্চলের অধিকাংশ অধিবাসীকে পাকসেনারা আগেই হত্যা করেছে। পাকশি সেতুর অধিকার নিয়ে পাকবাহিনী বেকায়দায় পড়েছে। এদিকে কুষ্টিয়া জেলার কয়েকটি গ্রাম মুক্তিফৌজ দখল করে নিয়েছে। পাকশি সেতুর এক প্রান্তে তুমুল সংঘর্ষ চলছে। মুক্তিফৌজের মতে, এই অঞ্চলে অন্তত দুই শ কমান্ডো সক্রিয় রয়েছে।’

দেশব্যাপী বিবৃতি

১৫ জুলাই কুষ্টিয়ায় এক সমাবেশে জামায়াতে ইসলামীর অস্থায়ী আমীর মিয়া তোফায়েল বলেন, ‘এক ব্যক্তি এক ভোট নীতি প্রবর্তনের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া চিরদিনের জন্য পাকিস্তানে বাঙালিদের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছেন। কিন্তু, শেখ মুজিবুর রহমান ও তার দল আওয়ামী লীগ নিশ্চিত ক্ষমতা দখল করে দাবি প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে বাঙালিদের এক চিরস্থায়ী দুর্ভোগের মুখে ঠেলে দিয়েছেন।’

একই দিনে কুষ্টিয়া জেলা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান সাদ আহমদ এক বিবৃতিতে বলেন, ‘ভারতের চর দেশদ্রোহী মুক্তিবাহিনী ও আওয়ামী লীগের চক্রান্তের হাত থেকে বাঁচাতে হবে দেশকে। এজন্য রাজাকারদের সর্বসময় সজাগ থাকতে হবে। একইসঙ্গে মীর জাফর দুষ্কৃতিকারীদের উৎখাত করে জনসাধারণের মধ্যে মনোবল সুদৃঢ় করতে হবে। আমরা দেখেছি বিপুল সংখ্যক দেশপ্রেমিক রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিচ্ছেন। রাজাকাররা ইতিমধ্যে বহু অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করেছে ও দুষ্কৃতকারী দমন করেছে। সবার দায়িত্ব এখন প্রাণের বিনিময়ে হলেও অখণ্ড পাকিস্তানকে রক্ষা করা।’

দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ

১৫ জুলাই টাঙ্গাইলের কালিহাতির বল্লায় কাদেরিয়া বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার বাহিনীর ৬০ সৈন্যের ওপর প্রবল আক্রমণ চালায়। সেসময় হানাদার বাহিনীর ৫১ সৈন্য নিহত হয়।

এদিন সকালে কাদেরিয়া বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা বল্লায় হানাদার সৈন্যদের তিন দিক থেকে ঘেরাও করে, ত্রিমুখী আক্রমণ চালায়। এসময় মুক্তিবাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণে হানাদারেরা দিশেহারা হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে হতোদ্যম হয়ে হানাদার সেনা ও রাজাকারেরা পালাতে চেষ্টা করলে মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অবরোধ করে। গোলাম মোস্তফার একটি দল সেসময় এগিয়ে পেছন থেকে তীব্র গোলাগুলি শুরু করে। 

সেসময় অবরুদ্ধ হানাদার সেনাদের উদ্ধারে নতুন একদল হানাদার সৈন্যদল বিপুল অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নৌকায় করে বল্লায় আসার পথে চারান নামক একটি জায়গায় মুক্তিবাহিনীর অতর্কিত হামলার শিকার হয়। হতবিহ্বল হানাদার  সেনারা নৌকার মধ্যে ছোটাছুটি শুরু করলে নৌকা ডুবে যায়। সেসময় বেশ কয়েকজন হানাদার সেনা পানিতে ডুবে মারা যায়। বাকি সৈন্যরা তীরে উঠে বল্লার দিকে রওনা হয়। এদিকে বল্লায় অবরুদ্ধ হানাদার সেনারা আগত হানাদার সেনাদের মুক্তিযোদ্ধা মনে করে বৃষ্টির মতো গুলি ও মর্টারের শেলিং শুরু করে। এতে বেশ কয়েকজন হানাদার সৈন্য নিহত হয়।

একই দিন সন্ধ্যায় নতুন আরেকটি হানাদার সৈন্যদল বল্লার দিকে অগ্রসর হয়। তখন মুক্তিযোদ্ধাদের অন্য আরেকটি দল আগে থেকে আত্মগোপনে ছিল। সেসময় হানাদার সেনাদের নতুন দলটিকে আসতে দেখে মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা সেই সৈন্যদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। একসময় তিন দিক থেকেই তীব্র যুদ্ধ শুরু হয়। সেসময় হানাদার বাহিনীর ভারী অস্ত্রের সামনেই কাদেরিয়া বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা দোর্দণ্ড প্রতাপে এগিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপক আক্রমণের মধ্যেই হানাদার সেনারা অগ্রসর হয়ে অবরুদ্ধ পাকিস্তানি সেনাদের উদ্ধার করে নিয়ে যায়। দুই দিনের এই যুদ্ধে প্রথম দিনেই হানাদার বাহিনীর ৫১ সৈন্য নিহত হয়েছিল।

১৫ জুলাই সিলেটের শাহবাজপুরে মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ওপর গেরিলা হামলা চালায়। সেসময় হানাদার বাহিনীর ১৩ সৈন্য নিহত হয়।

তথ্যসূত্র:

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র তৃতীয়, পঞ্চম, দশম, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড

দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ১৬ জুলাই ১৯৭১

দৈনিক পাকিস্তান, ১৬ জুলাই ১৯৭১

দ্য স্টেটসম্যান, ১৫ জুলাই ১৯৭১

দৈনিক যুগান্তর, ১৫ জুলাই ১৯৭১

আহমাদ ইশতিয়াক

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Taka to trade more freely by next month

Bangladesh will introduce a crawling peg system by next month to make the exchange rate more flexible and improve the foreign currency reserves, a key prescription from the International Monetary Fund.

6h ago