‘সৎ ও যোগ্যরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পাচ্ছেন না’

বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদের অনিয়ম ও দুর্নীতি বেশ কয়েক বছর ধরে গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে আলোচিত হচ্ছে। কয়েকজনের দুর্নীতি ইতোমধ্যে প্রমাণিতও হয়েছে।
(উপরের সারিতে বা থেকে) অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, (নিচের সারিতে বা থেকে) অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন ও অধ্যক্ষ হামিদা আলী। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদের অনিয়ম ও দুর্নীতি বেশ কয়েক বছর ধরে গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে আলোচিত হচ্ছে। কয়েকজনের দুর্নীতি ইতোমধ্যে প্রমাণিতও হয়েছে।

করোনা মহামারিতে প্রায় দেড় বছর ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদের দুর্নীতি, অনিয়ম ও নিয়োগ বাণিজ্য বন্ধ নেই।

সম্প্রতি বাংলাদেশের নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষের একটি ফোনালাপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এই ফোনালাপটি সামাজিক ও গণমাধ্যমে আলোচিত-সমালোচিত হচ্ছে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানদের এমন কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, আসলে কোন মানদণ্ডের ভিত্তিতে এমন প্রতিষ্ঠান প্রধানরা নিয়োগ পায়?

একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান নিয়োগের ক্ষেত্রে আসলে মানদণ্ড কী এবং বাংলাদেশে সেই মানদণ্ডগুলো কতটা অনুসরণ করা হয় এ নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার টেলিফোনে কথা বলেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ঢাবির সাবেক ভিসি অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন ও ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ হামিদা আলীর সঙ্গে।

চার জনেই বলেছেন বাংলাদেশে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান নিয়োগের ক্ষেত্রে তেমন কোনো মানদণ্ড অনুসরণ করা হয় না এবং প্রকৃত যোগ্যরা নিয়োগ পাচ্ছেন না। তাছাড়া শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য থেকে আমরা সরে গেছি বলে জানান তারা।

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, 'কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান নিয়োগের মানদণ্ডে আসা উচিত শিক্ষাবিদের নেতৃত্বের গুণাবলী, সাধারণ মানুষের মধ্যে তার গ্রহণযোগ্যতা। সর্বোপরি তিনি মানুষ হিসেবে সৎ কিনা, তার মধ্যে স্বচ্ছতা আছে কিনা, দায়বদ্ধতা আছে কিনা।'

তিনি আরও বলেন, 'বাংলাদেশে বর্তমানে নিয়োগের ক্ষেত্রে এসব বিষয় সেভাবে দেখা হয় না। সবার আগে দেখা হয় তার দলীয় পরিচয়। সরকারের প্রতি অনুগত যারা থাকবে তাদেরকেই আমাদের দেশে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব দেওয়া হয়।'

'একজন ভিসি দুর্নীতি করবে, এটা কখনও ভাবতে পারিনি। সঠিক মানুষকে নিয়োগ না দেওয়ার কারণেই বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনিয়ম হচ্ছে। নিয়োগ পাওয়ার পর তারা মুনাফা লোভী হয়ে ওঠেন। এসব অনিয়ম-অন্যায় বন্ধে প্রকৃত যোগ্য ও সৎ মানুষকে নিয়োগ দিতে হবে,' যোগ করেন তিনি।

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী মনে করেন, 'আমাদের প্রকৃত যে শিক্ষার উদ্দেশ্য তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। শিক্ষার ক্ষেত্রে কিছু কাজ হচ্ছে, তবে তা বিচ্ছিন্নভাবে। সামষ্টিকভাবে কিছু হচ্ছে না। আমাদের দেশে জ্ঞানের মূল্য কমে গেছে। শিক্ষকদের আরও গুরুত্ব দিতে হবে, সম্মান দিতে হবে।'

অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, 'শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান নিয়োগের ক্ষেত্রে দুটি বিষয়কে গুরুত্ব দিতে হবে। একটি তার শিক্ষাগত যোগ্যতা, অন্যটি তিনি মানুষ হিসেবে কেমন। তিনি সৎ ও স্বচ্ছ কিনা, শিক্ষার্থীদের প্রকৃত মানুষ করতে পারবেন কিনা। এর সঙ্গে তার খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক চর্চাও গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান নিয়োগের ক্ষেত্রে শুধু একজন শিক্ষকের সিভি দেখাই যথেষ্ট নয়। তিনি মানুষ হিসেবে কেমন, তার আচার-আচরণ কেমন, তিনি মূল্যবোধের চর্চা করেন কিনা, তার দেশপ্রেম কতটা— এগুলো মূল্যায়ন করতে হবে। কিন্তু আমরা শিক্ষাকে সার্টিফিকেটে বন্দি করে ফেলেছি। এ কারণেই আমরা শিক্ষক, আমলাসহ সব পেশায় দুর্নীতিবাজদের দেখতে পাই।'

তিনি আরও বলেন, 'আর ১০টা পেশার মানুষ দুর্নীতি করলেও সবচেয়ে বেশি দোষ হয় একজন শিক্ষকের। কারণ তার দায়িত্বই হচ্ছে দেশ গড়া, ভালো মানুষ তৈরি করা।'

'আমাদের দেশে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে এই মানদণ্ডগুলো তেমনভাবে অনুসরণ করা হয় না। অনুসরণ করলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর চেহারা এমন থাকতো বলে আমার মনে হয় না,' তিনি বলেন।

আরেফিন সিদ্দিক বলেন, 'প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক ভালো ও নিবেদিত শিক্ষক আছেন। তারা তদবির করেন না বলে নিয়োগ হয় না। যারা অসৎ, তারা দুর্নীতি করার জন্য বিভিন্ন ভাবে তদবির ও লবিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ পেয়ে থাকেন। কারণ তাদের চিন্তাই থাকে, কোনোভাবে নিয়োগ পেলেই দুর্নীতি করে অনেক টাকার মালিক হয়ে যাবে। সরকারের উচিত হবে প্রকৃত সৎ ও যোগ্যদের খুঁজে বের করে তাদের নিয়োগ দেওয়া। কিন্তু আমাদের দেশে তা হচ্ছে না। সঠিক জায়গায় সঠিক মানুষ যাচ্ছে না।'

ঢাবির সাবেক এই ভিসি বলেন, 'আমরা শিক্ষা ব্যবস্থাকে বাণিজ্যে রূপ দিয়েছি। শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য থেকে আমরা অনেক দূরে সরে গেছি। শিক্ষা হলো সমাজ ও রাষ্ট্রের চোখ। শিক্ষাকে আমরা জিপিএ-৫ এর মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি। যারা জিপিএ-৫ পায় বা প্রথম শ্রেণি পায় তাদেরকেই শিক্ষিত এবং মেধাবী মনে করা হয়।'

'শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলো মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটানো। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন করা ছাড়া শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য হাসিল হবে না। শিক্ষার ক্ষেত্রে কোনো বৈষম্য থাকবে না। প্রত্যন্ত অঞ্চলের একজন শিক্ষার্থী যে শিক্ষা পাবে শহরাঞ্চলের একজন শিক্ষার্থীও একই শিক্ষা পাবে। কিন্তু দেশে এখন দেখা যায় বিত্তবানদের জন্য এক ধরণের শিক্ষা ব্যবস্থা এবং বিত্তহীনদের জন্য এক ধরণের শিক্ষা ব্যবস্থা।'

'প্রাথমিক থেকে শুরু করে প্রতিটি জায়গা ঢেলে সাজাতে হবে। শিক্ষা ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। সৎ মানুষকে প্রশাসনিক দায়িত্ব দিতে হবে। প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকদের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। কারণ তারাই মূল কারিগর। তারাই ভিত্তিটা তৈরি করে দেন।'

ভিকারুননিসা নূন স্কুলের অধ্যক্ষের ফোনালাপ বিষয়ে তিনি বলেন, 'একজন শিক্ষক এই ভাষায় কথা বলবেন তা কোনোভাবেই কল্পনা করা যায় না। এটি শিক্ষক সমাজের জন্য বিব্রতকর। এই ধরণের শব্দ একজন শিক্ষকের মুখ দিয়ে উচ্চারিত হবে এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়।'

অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, 'কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান নিয়োগের ক্ষেত্রে দেখতে হবে তিনি পণ্ডিত শিক্ষক কিনা, তার প্রশাসনিক দক্ষতা, গবেষণা আছে কিনা। তাছাড়া তিনি মানুষ হিসেবে সৎ কিনা এবং তার মূল্যবোধ কেমন তা দেখতে হবে। তবে আমাদের দেশে এসব মানদণ্ড অনুসরণ করা হয় না।'

ঢাবির আইন বিভাগের এই অধ্যাপক বলেন, 'জবাবদিহিতার অভাব, দায়মুক্তির সংস্কৃতি এবং কোনো ঘটনার তদন্ত সঠিকভাবে না হওয়ার কারণেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনিয়ম, দুর্নীতি বেড়ে গেছে। দেশে ১০০টি অনিয়ম হলে নজরে আসে পাঁচ থেকে ১০টি। তাও আবার সামাজিক ও গণমাধ্যমে আলোচিত না হলে খুব বেশি আমলে নেওয়া হয় না।'

তিনি আরও বলেন, 'প্রকৃত শিক্ষার যে উদ্দেশ্য আমরা তার ধারের কাছেও নেই। শিক্ষার কাজ হলো আলোকিত মানুষ তৈরি করা, মূল্যবোধ তৈরি করা। কিন্তু বর্তমানে মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় হয়েছে। অন্যান্য পেশার মানুষকে যেভাবে মূল্যায়ন করা হয় এবং সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়, শিক্ষকতা পেশায় যারা আসেন তাদেরেকে সেভাবে সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয় না। এই পেশাকে যথাযথ গুরুত্ব দিতে পারলে এবং সঠিক মানুষকে সঠিক জায়গায় বসাতে পারলে শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হবে।' 

ভিকারুননিসা নূন স্কুলের শুরু থেকে পরবর্তী ২৩ বছর অধ্যক্ষের দায়িত্বে থাকা হামিদা আলী বলেন, 'শিক্ষাগত যোগ্যতার পাশাপাশি, ব্যক্তিত্ব, চরিত্র, নেতৃত্ব এসব বিষয় দেখতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অযোগ্যদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। একজন আদর্শবান মানুষ যার ভালো-মন্দ যাচাই করার মতো জ্ঞান আছে, শিক্ষার্থীকে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারবে তাদেরকেই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব দিতে হবে।'

ভিকারুননিসা নূন স্কুলের বর্তমান অধ্যক্ষের ফোনালাপ বিষয়ে সাবেক এই অধ্যক্ষ বলেন, 'এই ধরণের একজন মানুষ এমন ভাষায় কথা বলবে, তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। একটি প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ থাকার মতো তার বিন্দুমাত্র যোগ্যতা আছে বলে আমার মনে হয় না। তাকে দ্রুত সরিয়ে দেওয়া উচিত।'

তিনি বলেন, 'আমার স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান এইভাবে নষ্ট হলে আমি মরে যাবো। এর এমন মৃত্যু হবে তা আমি কোনোভাবেই চাই না। আমাদের বাচ্চারা এগুলো দেখে বিপথে চলে যাবে, কোনো আদর্শ তারা পাবে না। বর্তমান অধ্যক্ষকে দ্রুত অপসারণ করে একজন ভালো ও যোগ্য মানুষকে এই দায়িত্ব দেওয়ার জন্য প্রশাসনের কাছে অনুরোধ করছি।'

তিনি আরও বলেন, 'আমাদের দেশে শিক্ষা ব্যবস্থার প্রকৃত যে উদ্দেশ্য তা থেকে অনেকটাই আমরা সরে এসেছি। আমরা এখন আর মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারছি না। বর্তমানে ভালো শিক্ষক পাওয়া দুর্লভ। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাড়ছে কিন্তু কোয়ালিটি বাড়ছে না। শিক্ষা ব্যবস্থাকে রক্ষা করার জন্য এই খাতে কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না। কোনো শিক্ষক বা প্রতিষ্ঠান প্রধানের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাকে ছাঁটাই করতে হবে এবং আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।'

Comments

The Daily Star  | English

Taka to trade more freely by next month

Bangladesh will introduce a crawling peg system by next month to make the exchange rate more flexible and improve the foreign currency reserves, a key prescription from the International Monetary Fund.

15m ago