সঞ্চয়কারী-ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতাদের ক্ষতিতে ফেলে ব্যাংকের মুনাফার চেষ্টা

বিপুল পরিমাণ অতিরিক্ত তারল্যের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতি সামাল দিতে ঋণের চেয়েও দ্রুতগতিতে আমানতের সুদের হার হ্রাস করেছে দেশের ব্যাংকগুলো। ‍ফলে ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারী ও ঋণগ্রহীতারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
ফাইল ছবি

বিপুল পরিমাণ অতিরিক্ত তারল্যের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতি সামাল দিতে ঋণের চেয়েও দ্রুতগতিতে আমানতের সুদের হার হ্রাস করেছে দেশের ব্যাংকগুলো। ‍ফলে ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারী ও ঋণগ্রহীতারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

গত কয়েক মাস ধরে ঋণ ও আমানতের সুদ হারের পার্থক্য বা স্প্রেড যেভাবে বাড়ছে, তাতে ব্যাংকগুলো যে ভালো মুনাফা ও শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ নিশ্চিত করার জন্য গ্রাহকদের ক্ষতিতে ফেলছে, তা বোঝা যাচ্ছে।  

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এক বছর আগের ৫ দশমিক ৬ শতাংশ থেকে কমে গত জুন মাসে আমানতের সুদের গড় হার দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। জুন মাসে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ হওয়ায় আমানতকারীরা ব্যাংকের সঞ্চয় থেকে কোনো মুনাফাই পাচ্ছেন না।

বিপরীতে, এক বছর আগের ৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ থেকে কমে জুনে ঋণের সুদ হার ৭ দশমিক ৩৩ শতাংশে নেমে আসে। ফলে ওই মাসে ঋণ ও আমানতের সুদ হারের ব্যবধান (স্প্রেড) বেড়ে ৩ দশমিক ২০ শতাংশে দাঁড়ায়, যা গত বছরের জুনে ২ দশমিক ৮৯ শতাংশ ছিল।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, 'উচ্চ স্প্রেড মোটেও কাম্য নয়। কারণ, এতে আমানতকারীরা সঞ্চয় থেকে মুনাফা পাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। মূল্যস্ফীতির হার বিবেচনায় প্রকৃত সুদের হার অত্যন্ত নেতিবাচক।'

বেশিরভাগ ব্যাংক এখন ফিক্সড ডিপোজিটের (এফডিআর) ওপর ২ থেকে ৪ শতাংশ হারে সুদ দেয়। ফলে সঞ্চয়কারীদের প্রকৃত নেতিবাচক সুদ হার ২-৩ শতাংশ হয়।

সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, 'অন্যান্য দেশের ব্যাংকগুলো এ মুহূর্তে এত বেশি স্প্রেড রাখছে না। ব্যাংকের মূল এজেন্ডা হল ঋণ দেওয়া। কিন্তু, তারা এখন তা না করে আমানতের সুদ হার কম এবং ঋণের সুদ হার বেশি রেখে বেশি মুনাফা অর্জনের চেষ্টা করছে।'

করোনাভাইরাস মহামারির কারণে তৈরি হওয়া মানুষের আর্থিক সংকটের সময়ে ব্যাংকগুলোকে এমন কৌশল অবলম্বন না করার আহ্বান জানান তিনি।

কক্সবাজারের অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক আহমেদ কবির জানান, তিনি তিনটি ব্যাংকে রাখা এফডিআর থেকে পাওয়া সুদের আয়ের ওপর নির্ভরশীল।

'আমার সব এফডিআর সম্প্রতি ম্যাচিউর হয়েছে। ব্যাংক আমানতের সুদের হার কমিয়ে দেওয়ায় এখন কঠিন পরিস্থিতিতে আছি', কবির বলেন।

ডাচ-বাংলা ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম মো. শিরিন বলেন, ঋণের সুদ হারের চেয়ে আমানতের হার কমানো সহজ।

তিনি বলেন, 'আমানতকারীরা ঐক্যবদ্ধ নন। কিন্তু, ঋণগ্রহীতারা ঋণের হার বাড়লে ঐক্যবদ্ধভাবে তা কমানোর চেষ্টা করেন।'

ব্যবসায় মন্দা সত্ত্বেও ২০২১ সালের প্রথমার্ধে ব্যাংকগুলোকে ভালো মুনাফা অর্জন করতে আমানত ও ঋণের সুদের হারের বড় ব্যবধান সাহায্য করেছে বলে উল্লেখ করেন শিরিন।

ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুরের মতে, 'ব্যাংকিং খাতে অতিরিক্ত তারল্যের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা মূলত ভারসাম্যহীন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।'

গত জুনে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় অতিরিক্ত তারল্য ২ লাখ ৩১ হাজার ৪৬২ কোটি টাকায় কোটি টাকায় পৌঁছেছে, যা এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ।

ব্যাংকগুলোর এ অবস্থান ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতাদের ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলেছে উল্লেখ করে মনুসর বলেন, 'বড় ঋণগ্রহীতারা প্রভাব খাটিয়ে অপেক্ষাকৃত কম সুদে ঋণ নিতে পারে। ব্যাংক সাধারণত ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতার প্রতি মনোযোগ দেয় না।'

ব্যাংকগুলো যদি প্রত্যাশা অনুযায়ী ঋণ দেয় তাহলে ঋণের হার কমে যাবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'এর ফলে পরবর্তীতে অতিরিক্ত তারল্যও কমে যাবে। অতিরিক্ত তারল্য কমে গেলে আমানতকারীরাও উপকৃত হবেন।'

কিন্তু, মহামারি পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত এ দৃশ্যপটের পরিবর্তন নাও ঘটতে পারে।

ব্যাংকে টাকা জমা করা এখন সঞ্চয়কারীদের লোকসানের কারণ হয়ে দাঁড়ালেও, ব্যাংক ছাড়া তাদের কোনো বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে একমাত্র নিরাপদ বিকল্প হতে পারে সঞ্চয়পত্র, যার সুদের হার সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।

প্রত্যাশা অনুযায়ী, বিভিন্ন সঞ্চয়পত্রে নিট বিনিয়োগ এখন ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি ৩৭ হাজার ৩৮৬ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা এক বছর আগের তুলনায় প্রায় চার গুণ বেশি।

গত ৩ ডিসেম্বর তিন ধরনের সঞ্চয়পত্রের সর্বোচ্চ বিনিয়োগ সীমা কমিয়ে দেয় সরকার। ফলে, অনেক আমানতকারীকে টাকা রাখার জন্য ব্যাংকের কাছেই ফিরে যেতে হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তার মতে, 'শক্তিশালী কাঠামো থাকলে স্টক মার্কেট ব্যক্তিগত বিনিয়োগকারীদের জন্য অন্যতম সেরা বিকল্প হতে পারত। কিন্তু, মানুষের এখন শেয়ার বাজার থেকে দূরে থাকা উচিত। কারণ, অতিরিক্ত তারল্য ইতোমধ্যেই সেখানে একটি বুদবুদ তৈরি করেছে।'

তবে, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, 'আমানতের সুদের হার বাড়ানোর জন্য বেসরকারি খাতের ঋণের প্রতি আগ্রহের বিষয়টি অপরিহার্য ছিল।'

গত অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রা ১৪ দশমিক ৪০ শতাংশের বিপরীতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ দশমিক ৮০ শতাংশ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক অতিরিক্ত তারল্যের কিছু অংশ তুলে নিলেও, চলতি বছর পরিস্থিতির উন্নতি নাও হতে পারে উল্লেখ করে রহমান বলেন, 'ব্যবসায়ীদের আত্মবিশ্বাস পুনরুদ্ধারের বিষয়টি নির্ভর করছে মহামারি কতটুকু নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, তার ওপর ।'  

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন জারীন তাসনিম।

Comments

The Daily Star  | English

Taka to trade more freely by next month

Bangladesh will introduce a crawling peg system by next month to make the exchange rate more flexible and improve the foreign currency reserves, a key prescription from the International Monetary Fund.

3h ago