বান্ধবীদের বিয়ে হয়ে গেছে, ক্লাসে এখন একা নার্গিস

কুড়িগ্রাম সদর উপজেলায় ধরলা নদী দ্বারা বিচ্ছিন্ন হলোখানা ইউনিয়নের সারডোব গ্রাম। এই গ্রামে সারডোব উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী নার্গিস নাহার। গত ১২ সেপ্টেম্বর বিদ্যালয়ে আবার পাঠদান শুরু হলে ছাত্রী হিসেবে নার্গিস একাই শ্রেণিকক্ষে ছাত্রদের সঙ্গে উপস্থিত ছিল।
নার্গিস নাহার। ছবি: সংগৃহীত

কুড়িগ্রাম সদর উপজেলায় ধরলা নদী দ্বারা বিচ্ছিন্ন হলোখানা ইউনিয়নের সারডোব গ্রাম। এই গ্রামে সারডোব উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী নার্গিস নাহার। গত ১২ সেপ্টেম্বর বিদ্যালয়ে আবার পাঠদান শুরু হলে ছাত্রী হিসেবে নার্গিস একাই শ্রেণিকক্ষে ছাত্রদের সঙ্গে উপস্থিত ছিল।

কিন্তু, সেই বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় নার্গিসসহ ৯ ছাত্রী ছিল। করোনা মহামারির কারণে বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেলে তাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অটো-পাসের মাধ্যমে তারা সবাই নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছিল। নার্গিস ছাড়া বাকি ৮ ছাত্রী বাবার বাড়ি ছেড়ে এখন শ্বশুরবাড়িতে। এই বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে ছাত্রের সংখ্যা ২৭ কিন্তু উপস্থিত থাকছে ৮ থেকে ১০ জন।

সারডোব উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফজলে রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত ২২৫ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৬৩ জন ছাত্রী। গত ১২ সেপ্টেম্বর স্কুল খোলার পর থেকে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি সন্তোষজনক নয়। বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণির ৪ ছাত্রীর মধ্যে জেসমিন আখতার ছাড়া বাকি ৩ জনেরই বাল্যবিয়ে হয়ে গেছে। ৯ম শ্রেণিতে ৯ জনের মধ্যে নার্গিস নাহার ছাড়া ৮ জনের বিয়ে হয়েছে।'

তিনি আরও বলেন, 'এ ছাড়া আমরা জানতে পেরেছি ষষ্ঠ শ্রেণির একজন, সপ্তম শ্রেণির ২ জন, অষ্টম শ্রেণির ৪ জনকে গোপনে বাল্যবিয়ে দিয়েছেন পরিবারের লোকজন।'

'অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের খোঁজ নিতে শিক্ষকদের নিয়ে একটি টিম গঠন করা হয়েছে' উল্লেখ করে প্রধান শিক্ষক ফজলে রহমান বলেন, 'টিমের সদস্যরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ নিচ্ছেন।'

শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত একমাত্র ছাত্রী নার্গিস নাহার ডেইলি স্টারকে বলে, 'অষ্টম শ্রেণিতে আমরা ৯ জন ছিলাম। এখন আমি একা। বান্ধবীদের বাড়িতে গিয়ে জেনেছি তাদের বিয়ে হয়ে গেছে। তাদের বাল্যবিয়ের কথা শুনে অনেক কষ্ট পেয়েছি।'

'ক্লাসে ছাত্রী হিসেবে আমি একা। খুব খারাপ লাগে। কথা বলার মতো কোনো বান্ধবী নেই। ক্লাসে ছাত্ররা আছে। তাদের সঙ্গে কম কথা হয়।'

'জানি না ছাত্রী হিসেবে একাই শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত থেকে নিয়মিত পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারবো কিনা, তবে চেষ্টা করছি,' যোগ করে নার্গিস।

নার্গিস নাহার জানায়, গত এপ্রিলে তার জন্যও বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন একজন ঘটক। সে তার বাবা-মাকে স্পষ্ট জানিয়েছে যে এখন বিয়ে করবে না। আগে পড়াশুনা করে প্রতিষ্ঠিত হবেন তারপর বিয়ে। তাছাড়া তার বাবা-মা কেউই বাল্য বিয়ের পক্ষে নন বলে জানায় নার্গিস।

নার্গিসের বাবা পল্লিচিকিৎসক আব্দুল খালেক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মেয়ের বিয়ের জন্য একাধিক প্রস্তাব এসেছিল কিন্তু নাকচ করে দিয়েছি। তাছাড়া মেয়েও রাজি ছিল না। অভিভাবকরা সচেতন থাকলে বাল্য বিয়ে ঠেকানো যাবে।'

'ক্লাসে এখন একাই ছাত্রী হওয়ায় নার্গিস বিড়ম্বনায় পড়েছে। আমরাও হতাশ হয়েছি। মেয়ের কথা চিন্তা করে হয়তো তাকে প্রতিদিন ক্লাসে নাও পাঠাতে পারি। যেহেতু আশে-পাশে কোনো বিদ্যালয় নেই তাই তাকে আপাতত ওই স্কুলেই পড়তে হবে।'

সারডোব গ্রামে এক স্কুলছাত্রীর বাবা নজরুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিদ্যালয় বন্ধ হওয়ায় মেয়ে পড়াশুনা বাদ দিয়ে দেয়। গত মে মাসে মেয়ের জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসলে রাজি হয়ে যাই। মেয়ে এখন শ্বশুরবাড়ি।'

কোন কাজি বিয়ে পড়িয়েছেন এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তর দেননি।

সারডোব ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য বাহিনুর ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাল্যবিয়ের প্রধান কারণ অভিভাবকদের অসচেতনতা আর দারিদ্র। করোনা মহামারিতে বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা পড়াশুনা থেকে পিছিয়ে পড়েছে। এই সময় বাল্যবিয়ের হিড়িক পড়ে যায়। গোপনে অন্যত্রে নিয়ে গিয়ে পরিবারের লোকজন তাদের মেয়ের বাল্যবিয়ে দেন বলে তিনি জানান।

কুড়িগ্রাম জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা শামসুল আলম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই চিত্র শুধু সারডোব উচ্চ বিদ্যালয়ে নয়। এরকম চিত্র অনেক বিদ্যালয়ে আছে। বিশেষ করে চরাঞ্চল ও সীমান্তবর্তী এলাকার বিদ্যালয়গুলোতে এই চিত্র বেশি দেখা যায়। আমরা শিক্ষকদের মাধ্যমে জরিপ কাজ শুরু করে দিয়েছি। আশা করছি, শিগগির জেলার বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির সংখ্যা ও কারণ তুলে ধরতে পারবো।'

Comments

The Daily Star  | English

Bangladesh Bank again dissolves National Bank board

The bank’s sponsor director Khalilur Rahman made the new chairman

31m ago