বৈদেশিক মিশনে পাসপোর্ট-ভিসা উইংও আমলাদের দখলে

প্রায় ৮ বছর আগে, সরকার দেশের বাইরে বাংলাদেশের বিভিন্ন মিশনে প্রবাসীদের উন্নত সেবা দেওয়ার জন্য পাসপোর্ট ও ভিসা উইং স্থাপন করে।

প্রায় ৮ বছর আগে, সরকার দেশের বাইরে বাংলাদেশের বিভিন্ন মিশনে প্রবাসীদের উন্নত সেবা দেওয়ার জন্য পাসপোর্ট ও ভিসা উইং স্থাপন করে।

১৯টি মিশনের জন্য তখন ৭৩টি পদ তৈরি করা হয়েছিল। অর্থাৎ, প্রতি উইংয়ের জন্য ৩ থেকে ৫টি পদ। এই পদগুলো বহির্গমন এবং পাসপোর্ট অধিদপ্তরের (ডিআইপি) কর্মকর্তাদের দিয়ে পূরণ করার কথা ছিল। অথচ ২০১৫ সাল থেকে চালু হওয়ার পর একজন ডিআইপি কর্মকর্তাও প্রথম সচিব হিসেবে নিয়োগ পাননি, যেটি এই উইংয়ের শীর্ষ পদ। জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিবরাই মূলত এই পদে নিয়োগ পেয়েছেন।

এর বাইরে মাত্র ৪০ শতাংশ পদে ডিইপির কর্মীরা দায়িত্ব পালন করছেন বলে অধিদপ্তরের সূত্রে জানা গেছে।

সূত্রগুলো দ্য ডেইলি স্টারকে জানায়, উইং এর দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার আগে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা ডিআইপির কর্মকর্তাদের কাছ থেকেই প্রশিক্ষণ নেন।

ডিআইপির কর্মকর্তারা জানান, এভাবে এই কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে, কারণ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মূল প্রস্তাবের একটি অংশ থেকে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করেছে, যার সঙ্গে নিয়োগের বিষয়টি জড়িত। মূল প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন থাকা সত্ত্বেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এটা করেছে।

তারা অভিযোগ করেন, এই অবস্থানগত পরিবর্তনের কারণে শুধুমাত্র ডিআইপির দক্ষ কর্মীরাই বঞ্চিত হচ্ছেন না, এতে বিভিন্ন দেশে বসবাসরত বাংলাদেশি নাগরিক এবং সারা বিশ্ব থেকে আসা পর্যটকরা উন্নত সেবা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন।

ডিআইপির কয়েকজন কর্মকর্তা হতাশা প্রকাশ করে বলেন, পাসপোর্ট সেবা দেওয়া একটি কারিগরি বিষয় এবং সঠিক মানুষকে সঠিক পদে বসানো হলে মিশনে আরও উন্নত সেবা দেওয়া যাবে।

ডিআইপির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'তাদের প্রয়োজনীয় দক্ষতা নেই, কিন্তু তারপরেও তারা এই পদগুলো দখল করতে চান। অথচ আমরাই জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের পাসপোর্ট ও ভিসা প্রসেসিংয়ের বিভিন্ন কারিগরি দিক নিয়ে মাসব্যাপী প্রশিক্ষণ দেই।'

তিনি বলেন, এই 'অদ্ভুত ব্যবস্থা' এখনো চালু থাকায় ডিআইপির কর্মীদের প্রয়োজনীয় দক্ষতা থাকা স্বত্বেও তাদের প্রাপ্য সুযোগ পাচ্ছেন না।

প্রস্তাব

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পাওয়ার পর, ২০১২ তে সরকার দেশের বাইরে বিভিন্ন মিশনে পাসপোর্ট ও ভিসা উইং তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয়।

সে বছর ৬ জুন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি চিঠির মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রস্তাব পাঠায়। সেখানে বলা হয়, যেহেতু ২৪টি মিশনে ইতোমধ্যে মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি) ও মেশিন রিডেবল ভিসা (এমআরভি) যন্ত্র বসানো হয়েছে, সেখানে সেবা দেওয়ার জন্য বিশেষ উইং তৈরি করা উচিত।

চিঠিতে আরও বলা হয়, অভিজ্ঞ জনবলের অভাবে এই যন্ত্রগুলো কোনো কাজে আসছে না।

'ডিআইপির কর্মকর্তারা দক্ষ এবং পাসপোর্ট ও ভিসা প্রসেসিং এর ব্যাপারে অভিজ্ঞ। যদি বিদেশের মিশনগুলোতে তাদের চাকরি দেওয়া হয়, তাহলে ভিসা ও পাসপোর্ট প্রত্যাশীরা আরও ভালো সেবা পাবেন।'

এই প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৬৬টি মিশনে মোট ৩৬৬ পদ তৈরির জন্য প্রস্তাব দেয়।

প্রধানমন্ত্রী ২০১২ সালের ২৬ জুন অনুমোদন দেওয়ার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৩ জুলাই পাসপোর্ট ও ভিসা উইং এর জন্য পদ তৈরি করতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানায়।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সে বছর ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯টি বাংলাদেশি মিশনে ৭৩টি পদের অনুমোদন দেয়।

কিন্তু ২০১৪ সালের ১৭ জুন প্রকাশিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গেজেটে বলা হয়, প্রথম সচিবের পদ জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিবরা পূরণ করবেন এবং 'এই পদগুলো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে।'

দ্য ডেইলি স্টার সকল সরকারি নির্দেশ ও প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পাওয়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবের কপি সংগ্রহ করেছে।

ডিআইপির প্রশাসন উইং এর সূত্রগুলো জানিয়েছে, ২০১৫ সাল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ৪০ জন ডিআইপি কর্মী উইংগুলোতে প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে নিয়োগ পেয়েছেন এবং বাকি কর্মীরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নিয়োগ পেয়েছেন।

ডিআইপির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব চৌধুরী দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, সঠিক মানুষকে সঠিক পদে বসানো না হলে প্রত্যাশা অনুযায়ী সেবা পাওয়া যাবে না।

তিনি ব্যাখ্যা করেন, পাসপোর্ট এনরোলমেন্ট সম্পর্কে ভালো ধারণা না থাকলে মানুষ বায়োমেট্রিক ও ছবির মতো কারিগরি বিষয়গুলো বুঝতে পারবেন না।

আইয়ুব বলেন, 'উদাহরণস্বরূপ, একটি পাসপোর্ট ভ্যাকান্ট ভেরিফিকেশানের জন্য মুলতবি আছে। যার এ বিষয়ে জ্ঞান নেই, তিনি কখনোই বুঝবেন না যে এখানে পুলিশ ভেরিফিকেশন রিপোর্টের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছে।'

কেন পাসপোর্ট কর্মকর্তারা উইংগুলোতে শীর্ষ পদে নিয়োগ পাচ্ছেন না জিজ্ঞাসা করা হলে মহাপরিচালক জানান, এটি সরকারের সিদ্ধান্ত। 'তবে আমি বলব, যদি পাসপোর্ট কর্মকর্তারা এই পদের জন্য নির্বাচিত হন, তাহলে সেবার মান উন্নত হবে।'

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের যুগ্ম সচিব (ইমিগ্রেশন-১,২, নিরাপত্তা শাখা এবং ইমিগ্রেশন-১ সেকশন) জাহিদ হোসেন গত সপ্তাহে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, পাসপোর্ট ও ভিসা উইং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বর্ধিত অংশ।

তিনি আরও জানান, প্রথম সচিবের পদ প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য সংরক্ষিত এবং তাদেরকে চার বছরের মেয়াদে পদায়ন দেওয়া হয়। ডিআইপি ও মন্ত্রণালয়ের কর্মীরা বাকি কারিগরি পদগুলো পান।

প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন দেওয়া মূল প্রস্তাব অনুযায়ী সব পদে ডিআইপির কর্মকর্তা ও কর্মীদের নিয়োগ দেওয়ার কথা জানানো হলে তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন। তিনি দাবি করেন, 'আইন অনুযায়ী সব চলছে।'

তিনি আরও জানান, সবার জন্য উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কর্মকর্তা ও কর্মীদের এই পদগুলোতে নিয়োগ দেওয়া হয়।

জাহিদ যোগ করেন, 'মিশনে নিয়োগ দেওয়ার আগে আমরা একটি সার্কুলার ইস্যু করি এবং আগ্রহী প্রার্থীরা পদগুলোর জন্য আবেদন করেন। প্রতিবার শতাধিক কর্মকর্তা আবেদন করে এবং ২০ জনকে নির্বাচন করা হয়।'

তবে বেশ কয়েকজন ডিআইপি কর্মকর্তা দাবি করেন, আগের নির্দেশে শুধুমাত্র প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারাই এই পদের জন্য আবেদন করতে পারবেন, এরকম কোনো নিয়ম নেই।

ডিআইপির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, 'আমরা অন্তত পদগুলোর জন্য আবেদন করার সুযোগ চাই এবং আমাদেরকে অযোগ্য ঘোষণা করে হলেও আমরা তা মেনে নেব।'

উইং স্থাপনের জন্য কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়, সে ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা এবং দুজন ডিআইপি কর্মী জানান, তাৎক্ষনিকভাবে খরচের হিসেব দেওয়া সম্ভব নয়, কারণ একেক মিশনে খরচের পরিমাণ একেক রকম।

বিদেশি মিশনের পাসপোর্ট ও ভিসা উইং এ কর্মরত প্রথম সচিব তার মূল বেতন পান মার্কিন ডলারে।

এছাড়াও তিনি প্রতি মাসে ১ হাজার ৪১৪ ডলার বৈদেশিক ভাতা ও ৪৩৬ ডলার বিনোদন ভাতা পান।

কর্মকর্তার জন্য বার্ষিক ২০ হাজার ডলারের শিক্ষা ভাতা বরাদ্দ দেওয়া হয় এবং সরকার থেকে তিন কক্ষের বাড়ির ব্যবস্থা এবং ৯০ শতাংশ চিকিৎসা খরচও বহন করা হয়।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলোর তথ্য অনুযায়ী, বছরে একবার কর্মকর্তা ও তার পরিবারের সদস্যদের জন্য (সর্বোচ্চ ৫ জন) বিমান টিকিটের ব্যবস্থা করা হয়।

'উদ্দেশ্য বানচাল করা'

এ প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, 'এটি যোগ্য ও পেশাদার প্রার্থীদের প্রাপ্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে প্রশাসন ক্যাডারের অন্যায় সুবিধা নেওয়ার আরেকটি স্পষ্ট উদাহরণ, আর এক্ষেত্রে ভুক্তভোগী পাসপোর্ট বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।'

তিনি আরও জানান, এটি একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের নেপথ্যের যুক্তিকে অবজ্ঞা করছে, যার মাধ্যমে এই অনুমোদন নেওয়া হয়েছিল। অনুমোদনের সময় পাসপোর্ট বিভাগে কাজ করার অভিজ্ঞতা ও দক্ষতাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়ার সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল।

এখানে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে কীভাবে এক শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা বৈদেশিক নিয়োগকে একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সফল করার উদ্যোগ হিসেবে না দেখে মুনাফা অর্জনের সুযোগ হিসেবে দেখেন। তিনি জানান, এতে সংশ্লিষ্ট বৈদেশিক মিশনে সেবার মান বিঘ্নিত হবে।

তিনি আরও বলেন, 'অপরদিকে, এই পুরো ঘটনাটি পাসপোর্ট ডেলিভারির সঙ্গে জড়িত ও এসব পদের জন্য প্রকৃত যোগ্য কর্মকর্তাদের হতাশ ও নিরুৎসাহিত করবে এবং তাদের অনুপ্রেরণা কমাবে।'

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এই প্রক্রিয়া চলতে দেওয়া উচিৎ হবে না এবং যারা 'ভাল একটি উদ্দেশ্যকে বানচাল করছেন', তাদেরকে ক্ষমতার অপব্যবহারের জন্য দায়ী করতে হবে।

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

History of student protests in the USA

American campuses -- home to some of the best and most prestigious universities in the world where numerous world leaders in politics and academia have spent their early years -- have a potent history of student movements that lead to drastic change

4h ago