রাশিয়ার তেল-গ্যাসের ওপর বিশ্ব কতটা নির্ভরশীল?

একে একে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়া থেকে তেল আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এরপর রাশিয়া হুমকি দিয়েছে, ‘তেল না নিলে গ্যাস দেব না’।
রাশিয়ার একটি তেলক্ষেত্র। ছবি: রয়টার্স

একে একে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়া থেকে তেল আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এরপর রাশিয়া হুমকি দিয়েছে, 'তেল না নিলে গ্যাস দেব না'।

সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের পর রাশিয়া বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী দেশ। প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদনের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম অবস্থানে রাশিয়া।

আজ বুধবার ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাশিয়া প্রতিদিন ৫০ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল উৎপাদন করে। এর অর্ধেকের বেশি রপ্তানি হয় ইউরোপে।

গত ২০২০ সালের হিসাব অনুযায়ী, রাশিয়ার তেলের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরতা দেশটির মোট চাহিদার প্রায় ৩ শতাংশ।

যুক্তরাজ্যে গ্যাসের মোট চাহিদার প্রায় ৫ শতাংশ রাশিয়া থেকে আসলেও রাশিয়া থেকে কোনো গ্যাস আমদানি করে না যুক্তরাষ্ট্র।

জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলে জানিয়েছে, তেলের জন্য দক্ষিণ আমেরিকার রাশিয়াপন্থি দেশ ভেনেজুয়েলার সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করছে যুক্তরাষ্ট্র। একদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার তেল বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিচ্ছে, অন্যদিকে কারাগার থেকে ২ মার্কিন নাগরিককে মুক্তি দিয়েছে ভেনেজুয়েলা।

এক সময় ভেনেজুয়েলা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান তেল সরবরাহকারী দেশ। তবে বর্তমানে ভেনেজুয়েলার তেলের বিপুল অংশ চীনে রপ্তানি হয়।

বিবিসির অপর প্রতিবেদনে জানা যায়, ইউরোপের মোট চাহিদার ৪০ শতাংশ গ্যাস এবং ৩০ শতাংশ তেল আসে রাশিয়া থেকে। এই সরবরাহ বন্ধ হলে এর সহজ কোনো বিকল্প পাওয়া যাবে না।

রাশিয়ার তেল-গ্যাসের ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে ইতালি ও জার্মানি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

সরবরাহ কমে যাওয়ায় এরইমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে জ্বালানি পণ্যের দাম বেড়েছে। আমেরিকান অটোমোবাইল অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, গত এক সপ্তাহে স্টেশনগুলোয় জ্বালানির দাম ১১ শতাংশ বেড়েছে, যা ২০০৮ সালের পর সর্বোচ্চ।

গত ৩ মার্চ কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা জানায়, ব্যুরো অব লেবার স্ট্যাটিকসের হিসাবে গত জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রে বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতি ছিল সাড়ে ৭ শতাংশ, যা ১৯৮২ সালের পর নতুন রেকর্ড। এরপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তা আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

বিবিসির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, যুক্তরাজ্য ধীরে ধীরে চলতি বছরের শেষ নাগাদ রাশিয়া থেকে তেল আমদানি পুরোপুরি বন্ধ করতে পারবে। ব্রিটিশ সরকার আশা করছে, এই সময়ের মধ্যে তারা তেলের জন্য রাশিয়ার বিকল্প দেশ খুঁজে বের করতে পারবে।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইতোমধ্যে রাশিয়া থেকে তেল আমদানি ৩ ভাগের ২ ভাগে কমিয়ে এনেছে।

প্রতিবেদন মতে, রাশিয়ার উপপ্রধানমন্ত্রী আলেক্সান্ডার নোভাক বলেছেন, রাশিয়া থেকে তেল না কিনলে 'বিশ্ববাজারে চরম অস্থিরতা' তৈরি হবে।

ইউক্রেনে সামরিক আগ্রাসনের কারণে রাশিয়ার তেল-গ্যাসের ওপর যুক্তরাষ্ট্রসহ মিত্র দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞার ফলে বিশ্ববাজারে জ্বালানি পণ্যের দাম ক্রমাগতভাবে বেড়ে চলছে।

পরিস্থিতি বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে তার ঘনিষ্ঠ মিত্র সৌদি আরবকে তেল উৎপাদন বাড়াতে অনুরোধ করেছে। এর আগে তেলের দাম কমাতে উৎপাদন বাড়ানোর বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধ ফিরিয়ে দিয়েছিল সৌদি আরব।

রাশিয়ার ওপর নির্ভরতা

ইউরোপীয় কমিশনের হিসাবে, রাশিয়া হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পঞ্চম শীর্ষ বাণিজ্যিক অংশীদার। ২০২০ সালে জোটের বৈশ্বিক বাণিজ্যের ৪ দশমিক ৮ শতাংশ হয়েছিল রাশিয়া থেকে।

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের দিন মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনবিসি জানায়, ইউরোপীয় ইউনিয়নের মোট জ্বালানি ব্যবহারের ২৫ শতাংশ হচ্ছে প্রাকৃতিক গ্যাস।

ইইউ ডিরেকটরেট-জেনারেল ফর এনার্জির হিসাবে, জোটভুক্ত দেশগুলো তেল ও পেট্রোলিয়াম ব্যবহার করে ৩২ শতাংশ, নবায়নযোগ্য শক্তি ও বায়োফুয়েল ১৮ শতাংশ এবং জীবাশ্ম জ্বালানি (কয়লা) ব্যবহার করে ১১ শতাংশ।

প্রতিবেদন মতে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের গ্যাসের ওপর নির্ভরশীলতার মানে রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীলতা। কেননা, জোটের ব্যবহৃত মোট গ্যাসের ৪১ শতাংশ আসে রাশিয়া থেকে, ২৪ শতাংশ নরওয়ে থেকে এবং ১১ শতাংশ আলজেরিয়া থেকে।

বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, ২০২১ সালে ইইউ রাশিয়া থেকে ১০৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের জ্বালানি কিনেছে। যা জোটের মোট জ্বালানির ৬২ শতাংশ।

ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির ২০২০ সালের হিসাবে, রাশিয়ার গ্যাসের প্রধান ক্রেতা জার্মানি (৪২ দশমিক ৬ শতাংশ), ইতালি (২৯ দশমিক ২ শতাংশ), বেলারুশ (১৮ দশমিক ৮ শতাংশ), তুরস্ক (১৬ দশমিক ২ শতাংশ), নেদারল্যান্ড (১৫ দশমিক ৭ শতাংশ), হাঙ্গেরি (১১ দশমিক ৭ শতাংশ), কাজাখস্তান (১০ দশমিক ২ শতাংশ), পোল্যান্ড (৯ দশমিক ৬ শতাংশ), চীন (৯ দশমিক ২ শতাংশ) ও জাপান (৮ দশমিক ৮ শতাংশ)।

চীনের শুল্ক প্রশাসনের বরাত দিয়ে গত ১৪ জানুয়ারি রুশ রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম তাস জানিয়েছিল, ২০২১ সালে রাশিয়া ও চীনের বাণিজ্য রেকর্ড ১৪৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি হয়েছে। বর্তমানে চীন রাশিয়ার শীর্ষ বাণিজ্যিক অংশীদার।

ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলার বরাত দিয়ে গত ৭ ডিসেম্বর মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনবিসি জানিয়েছিল, রাশিয়া ও ভারত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ৩০ বিলিয়ন ডলার থেকে আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে রাজি হয়েছে।

রাশিয়ার বিকল্প

অপরিশোধিত তেলের জন্য রাশিয়ার বিকল্প দেশ পাওয়া গেলেও প্রাকৃতিক গ্যাসের জন্য রাশিয়ার বিকল্প পাওয়া খুব একটা সহজ নয় বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

বেলজিয়ামের জ্বালানি গবেষক বেন ম্যাকউইলিয়ামস বিবিসিকে বলেছেন, 'যেখানে বড় বড় পাইপ দিয়ে রাশিয়া থেকে ইউরোপে গ্যাস আসছে সেখানে এর বিকল্প খুঁজে পাওয়া কঠিন।'

তিনি মনে করেন, রাশিয়া যদি ইউরোপে গ্যাস রপ্তানি বন্ধ করে দেয় তাহলে ইউরোপকে হয়তো যুক্তরাষ্ট্র থেকে এলএনজি আমদানি করতে হবে।

বিশ্লেষক সিমন তেগলিয়াপিয়েত্রার মতে, 'নবায়নযোগ্য জ্বালানির চিন্তা করা যেতে পারে। তবে সেটাও কোনো সমাধান নয়।'

তিনি বলেন, 'আগামী শীতের জন্য জ্বালানি যোগাতে হয়তো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো খুলে দেওয়া হতে পারে। বিশেষ করে, এই জরুরি অবস্থায় ইতালি ও জার্মানি সেরকমই পরিকল্পনা করছে।'

আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে রাশিয়ার তেলের ওপর নির্ভরতা কমাতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন পরিকল্পনা করছে। এর মধ্যে রয়েছে গ্যাস সরবরাহের বহুমুখী পথ খোঁজা এবং বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে গ্যাসের বিকল্প যোগান দেওয়া।

এ ছাড়াও, প্রাকৃতিক গ্যাসের জন্য মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় তথা কাতার, আলজেরিয়া ও নাইজেরিয়ার দিকে হাত বাড়াতে পারে ইউরোপ। বাস্তবতা হলো, সেসব দেশে দ্রুত উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে অনেক বাধা আছে।

চলমান পরিস্থিতি বিবেচনায় এ কথা বলা যেতে পারে যে রাশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন অবরোধের কারণে বিশ্বে জ্বালানিসহ অন্যান্য পণ্যের দাম অনেক বেড়ে যাবে এবং এর খেসারত অনুন্নত বা স্বল্পোন্নত দেশগুলোর পাশাপাশি সবাইকেই দিতে হবে।

Comments

The Daily Star  | English
World Press Freedom Day 2024

Column by Mahfuz Anam: Has Bangladesh gained anything by a restrictive press?

The latest Bangladesh Bank restriction on journalists is anti-democratic, anti-free press and anti-public interest.

12h ago