দূষণে হতাশার নগরী ঢাকা
বিভিন্নভাবে দূষণে জর্জরিত ঢাকা শহর। টানা কয়েকবছর বায়ু দূষণের শীর্ষে অবস্থান করছে। শুধু কি তাই? নিম্ন জীবনমানের অপরিকল্পিত শহরের তালিকায়ও অনায়াসেই ঢাকার অবস্থান শীর্ষমুখী। দূষণ, দখল আর অনিয়মে বিধ্বস্ত শহরের পরিবেশ ব্যবস্থা। অথচ শহরগুলোর এমন কুৎসিত-কদাকার চেহারার কথা বাদ দিলে আমাদের প্রতিটি গ্রামের দৃশ্যই অনেক মনোমুগ্ধকর।
আমাদের গ্রাম আর শহরের এই ব্যবধান অনেকটা স্বর্গ-নরকের মতো! অথচ ইচ্ছে করলেই গ্রামের সৌন্দর্য কাজে লাগিয়ে ছয় ঋতুর বিন্যাসে শহরগুলো তৈরি করা যেত। প্রাকৃতিকভাবেও আমাদের সেই সুযোগ রয়েছে। ঢাকার কথাই যদি ধরি, চারপাশে নদী আছে, আছে অনেকগুলো খাল বিল-জলাশয়। তবে এর অধিকাংশই এখন দখল-দূষণে নাজেহাল। একসময় ঢাকার বর্তমান মধ্যাঞ্চল থেকে উত্তরাঞ্চল অবধি জঙ্গলাকীর্ণ ছিল। কোথাও কোথাও ছিল ধানের খেত আর জলাশয়। খোদ রমনাঞ্চলই ছিলো জঙ্গলাকীর্ণ। ঐতিহাসিক সূত্রমতে ১৮২৫ সালে ইংরেজ আমলে ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট চার্লস ডস জেলের কয়েদিদের নিয়ে তিন মাস ধরে রমনার জঙ্গল পরিষ্কার করে বের করেছিলেন ডিম্বাকৃতির একটি অংশ। তাতে শহরের উত্তরাঞ্চল পরিষ্কার হয়ে বায়ু চলাচলের পথ উন্মুক্ত হয়েছিল বলে জানা যায়।
মাত্র দুশো বছর আগেও এটাই ছিলো ঢাকার বাস্তবচিত্র। অথচ ধীরে ধীরে প্রবাহিত খাল ভরাট করে, জলাধার-নদী দখল করে শহরের নামে এই রাজধানীকে আমরা একটি আধুনিক বস্তি বানিয়েছি। বিনিময়ে আমরা পাচ্ছি 'আন্তর্জাতিক খেতাব'! প্রথমদিকে এধরনের খবরে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে কিছুটা অপ্রস্তুত হতে দেখা গেলেও এখন বিষয়টি গা-সওয়া হয়ে গেছে। এমনকি যেসব কারণে বায়ুদূষণ উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁচেছে সেসব নিয়ন্ত্রণেরও কোনো চেষ্টা আমরা দেখি না।
সম্প্রতি স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা সংস্থা 'ক্যাপস'-এর গবেষণা ও সমীক্ষায় দেখা গেছে ঢাকায় বায়ুর মান সবচেয়ে বেশি খারাপ থাকে রাত একটার দিকে। মধ্যরাতে এখানকার বায়ুমানের সূচক থাকে গড়পড়তা (গ্যাসীয় ও কঠিন) ১৬২, যা 'অস্বাস্থ্যকর' বলে বিবেচিত। জানুয়ারি মাসজুড়ে ঘুরেফিরে বিশ্বে শীর্ষ বায়ুদূষণের শহরের তালিকায় উঠে এসেছে ঢাকার নাম।
পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ুমান সূচক অনুসারে, শূন্য থেকে ৫০ পর্যন্ত 'ভালো'। ৫১ থেকে ১০০ 'মোটামুটি', ১০১ থেকে ১৫০ পর্যন্ত 'সতর্কতামূলক', ১৫১ থেকে ২০০ পর্যন্ত 'অস্বাস্থ্যকর', ২০১ থেকে ৩০০ পর্যন্ত 'খুব অস্বাস্থ্যকর', ৩০১ থেকে ওপরে 'অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর' বা 'দুর্যোগপূর্ণ'। উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, ঢাকায় বিকেল চারটার পর দ্রুত বাড়তে থাকে দূষণ, যা সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকে মধ্যরাতে। এরপর ধীরে ধীরে কমে ভোর ছয়টার দিকে হয় ১৫৪ বা অস্বাস্থ্যকর। দুই ঘণ্টা পর তা কিছুটা বেড়ে হয় ১৫৭। পরবর্তী সময়ে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দূষণ দ্রুত কমতে থাকে। তবুও তা স্বাস্থ্যকর নয়। সবচেয়ে কম দূষণও এ দেশে অস্বাভাবিক দূষণ। শিশু, গর্ভবতী নারী, রোগী, বয়স্কজন, শ্বাসকষ্টে ভোগা মানুষের জন্যও এটা ঝুঁকিপূর্ণ।
ঢাকার বায়ুদূষণ সবচেয়ে বেশি হয় মধ্যরাতে। রাত ১১টার দিকে সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা সড়ক ঝাড়– দেওয়া শুরু করেন। এ কারণে শহরজুড়ে ধুলা উড়তে থাকে। এছাড়া রাত ১০টার দিকে ঢাকার ভেতর পণ্যবাহী ভারী ও ক্ষুদ্র যান চলাচল করে, কিংবা ঢাকা হয়ে অন্য স্থানে যায়। আবার ঢাকার ভেতর নির্মাণসামগ্রী না ঢেকে পরিবহন করার কারণেও ধুলা ছড়িয়ে পড়ে। রাতে ফাঁকা রাস্তায় দ্রুতগতিতে গাড়ি চলায় জমে থাকা ধুলা চাকার সঙ্গে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকায় সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণ হয় জানুয়ারি মাসে। গত পাঁচ বছরে এই মাসের গড়পড়তা বায়ুমান সূচক ছিল ২০৭ বা 'খুবই অস্বাস্থ্যকর'। এর পরপরই ফেব্রুয়ারিতে দূষণের মাত্রা তীব্রতর হয়ে ওঠে।
রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকায় শীতে সর্বোচ্চ ধুলা ও দূষণ পরিলক্ষিত হয়েছে। ক্যাপসের উপাত্তে দেখা যায়, গত ১০ মাসে সবচেয়ে বেশি ধুলা দূষণ হয়েছে শীতে। স্বাভাবিকের চেয়ে ১০ গুণ বেশি ধুলা দূষণ নিয়ে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে ধানমন্ডি-মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকাটি। ওই সময়ে সর্বনিম্ন দূষণ ছিল তেজগাঁও ও আহসান মঞ্জিল এলাকায়; সেটিও স্বাভাবিকের চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি। এ ছাড়া বর্ষায় সবচেয়ে দূষিত এলাকা ছিল শাহবাগ, স্বাভাবিকের চেয়ে সাত গুণ বেশি। বর্ষায় সবচেয়ে দূষিত ছিল মিরপুর ও গুলশান এলাকা; স্বাভাবিকের চেয়ে তিন গুণ বেশি। বর্ষা-পরবর্তী ঋতুগুলোয় সর্বোচ্চ ধুলা-দূষণ ছিল তেজগাঁওয়ে; স্বাভাবিকের চেয়ে সাত গুণ বেশি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার বাতাসে পিএম ২ দশমিক ৫-এর মধ্যে রাস্তার ও মাটির ধুলা সবচেয়ে বেশি। পরিবহনের ধোঁয়া সাড়ে ৩৬ শতাংশ। এছাড়াও সাম্প্রতিক গবেষণা অনুযায়ী দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে সর্বোচ্চ বায়ুদূষণ দেখা গেছে গাজীপুরে আর সবচেয়ে কম দূষণ পাওয়া গেছে মাদারীপুরে। 'ক্যাপস'-এর সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয় 'ক্যাপস' ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত ৩ হাজার ১৬৩টি স্থানের বস্তুকণার মান পর্যবেক্ষণ করে। পরে তা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পর্যালোচনা করা হয়।
তাতে দেখা যায়, ৩ হাজার ১৬৩টি স্থানের গড় অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা প্রতি ঘনমিটারে ১০২ দশমিক ৪১ মাইক্রোগ্রাম। দৈনিক আদর্শ মানের চেয়ে তা প্রায় ১ দশমিক ৫৭ গুণ বেশি। দূষণের দিক দিয়ে গাজীপুরের পরের অবস্থানে রয়েছে পার্শ্ববর্তী ঢাকা জেলা। এই জেলার বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা প্রতি ঘনমিটারে ২৫২ দশমিক ৯৩ মাইক্রোগ্রাম। নারায়ণগঞ্জ জেলার অবস্থান তৃতীয়। নারায়ণগঞ্জের বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা ২২২ দশমিক ৪৫ মাইক্রোগ্রাম। এদিকে ১৫ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়-বায়ুদূষণ কমাতে সঠিক পরিকল্পনা চেয়েছেন হাইকোর্ট।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে-বায়ুদূষণের পাশাপাশি সবচেয়ে দূষিত এলাকা চিহ্নিত ও দূষণ কমাতে পরিকল্পনা দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এক রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ওইদিন বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও এস এম মনিরুজ্জামানের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলসহ এ আদেশ দেন। বায়ুদূষণ রোধে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চেয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) রিটটি করে। বিপজ্জনক ও অস্বাস্থ্যকর বায়ু থেকে জনগণকে সুরক্ষা দিতে অ্যালার্ট পদ্ধতি প্রবর্তন করতেও নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এ ছাড়া ইট পোড়ানোর বিকল্প পদ্ধতির উন্নয়ন ও কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের এমন পর্যবেক্ষণ এবং আদেশকে পরিবেশবাদীরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবেই বিবেচনা করছে।
তবে বায়ুদূষণে ঢাকা বারবার শীর্ষতম হলেও সার্বিকভাবে অন্যান্য দূষণের মাত্রাও একেবারে কম নয়। জলাশয় এবং শব্দদূষণ যার মধ্যে অন্যতম। ঢাকার চারপাশের নদী এবং ঝিলগুলো অনেক আগেই চরমভাবে দূষিত হয়েছে। আমরা জানি, সাধারণত সহনীয় শব্দের মাত্রা ৫৫ থেকে ৬০ ডেসিবেল। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ৬০ ডেসিবেলের অধিক শব্দ যদি দীর্ঘসময় ধরে থাকে তাহলে সাময়িক বধিরতা আর ১০০ ডেসিবেলের বেশি হলে স্থায়ী বধিরতা হতে পারে।
মূলত সারা বিশ্বে ৫ ভাগ মানুষ শব্দ দূষণের শিকার। 'শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬' হল একমাত্র আইনি হাতিয়ার, যা অনেক পুরনো এবং এই আইন অনেকটাই দুর্বল। তবুও এটাই শব্দ দূষণের বিরুদ্ধে লড়াই করার একমাত্র হাতিয়ার।
এই বিধিমালা অনুযায়ী নীরব, আবাসিক, মিশ্র, বাণিজ্যিক ও শিল্প- এসব এলাকার ধরণ অনুযায়ী দিন ও রাতের জন্য আলাদাভাবে শব্দের 'মানমাত্রা' বা স্ট্যান্ডার্ড লেভেল নির্ধারণ করা আছে। তাতে দিনের বেলায় সবচেয়ে কম নীরব এলাকায় ৫০ ডেসিবেল আর সবচেয়ে বেশি শিল্প এলাকায় ৭৫ ডেসিবেল মাত্রার শব্দ অনুমোদনযোগ্য। অথচ ঢাকার ফার্মগেট এলাকায় রেকর্ডকৃত দেশের সর্বোচ্চ শব্দমাত্রা ১৩২.০২ ডেসিবেল!
এই মুহূর্তে দেশের সার্বিক দূষণ নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। সবার আগে প্রয়োজন সচেতনতা। কারণ শুধু কঠোর আইন করে এধরনের পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটানোর কোনো সুযোগ নেই। যত্রতত্র শিল্প কারখানা স্থাপন করা যাবে না। ছেটো থেকে বড় সব ধরনের শিল্প কারখানা নির্দিষ্ট এলাকায় নিয়ম মেনে তৈরি ও পরিচালনা করতে হবে। বিষয়গুলো নিয়মিত তদারক করতে হবে। ঢাকা শহরে অসংখ্য বৈধ-অবৈধ কারখানা রয়েছে। এই কারখানাগুলো নানাভাবে নগরের দূষণমাত্রা বাড়িয়ে তুলছে। একটি রাজধানী শহরের ভেতর এধরনের কারখানা মোটেই পরিবেশ সম্মত নয়। ফলে শহরের সকল শিল্প কারখানাই সরিয়ে নেয়া উচিৎ।
যেকোনো উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অবশ্যই বাস্তবায়নকারী সংস্থাকে পরিবেশ দূষণের মাত্রা সহনীয় পর্যায়ে রাখার শর্ত পূরণ করতে হবে। উন্নয়ন অবশ্যই প্রয়োজন, তবে তা মানুষের জীবন বিপন্ন করে নয়। আমাদের শহরগুলোয় কাঙ্ক্ষিত উদ্ভিদের পরিমাণ অর্ধেকেরও কম, ৭ থেকে ৮ ভাগ। কোথাও কোথাও তারও কম। অথচ দূষণ নিয়ন্ত্রণের অন্যতম উপায় হচ্ছে কাঙ্ক্ষিত উদ্ভিদের অবস্থান নিশ্চিত করা। ফলে শহরগুলোয় অতিসত্ত্বর পরিকল্পিতভাবে বৃক্ষায়ন করা প্রয়োজন।
মোকারম হোসেন : প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক, সাধারণ সম্পাদক তরুপল্লব।
Comments