করোনায় শিক্ষাক্ষতি কাটিয়ে ওঠার উদ্যোগ নেই বাজেটে

ছবি: স্টার ডিজিটাল গ্রাফিক্স

করোনাভাইরাসের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘসময় বন্ধ থাকায় লাখো শিক্ষার্থীর শিক্ষা ঘাটতি তৈরি হয়েছে। অথচ এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে কোনো সুনির্দিষ্ট নতুন উদ্যোগ দেখা যায়নি।

একইসঙ্গে কোভিড-বিধ্বস্ত শিক্ষা খাতের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে নতুন পাঠ্যক্রম যথাযথ বাস্তবায়নে শিক্ষকদের সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তার বিষয়টিকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়নি বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

এবারের বাজেটের মূল প্রতিপাদ্য 'কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তন' হলেও, এতে এ ২টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না থাকা হতাশাজনক বলে উল্লেখ করেছেন শিক্ষাবিদরা।

তা ছাড়া, শিক্ষা খাতে জিডিপির অনুপাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে শিক্ষাবিদদের দীর্ঘদিনের আহ্বান এবং ইউনেস্কোর সুপারিশ উপেক্ষা করে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল প্রস্তাবিত বাজেটে জিডিপি অনুপাতে গত বছরের তুলনায় এবার শিক্ষায় বাজেট কমিয়েছেন।

জিডিপি অনুপাতে শিক্ষায় বরাদ্দ কমছে

২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষা খাতে মোট ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের জন্য ৩৯ হাজার ৯৬১ কোটি টাকা এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।

বিদায়ী অর্থবছরে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ ছিল ৭১ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা।

নতুন অর্থবছরে মোট বাজেটের ১২ দশমিক ০১ শতাংশ শিক্ষা খাতে রাখা হয়েছে। বিদায়ী বাজেটে এটি ছিল ১১ দশমিক ৯১ শতাংশ।

কিন্তু, ২০২২-২৩ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে জিডিপির মাত্র ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়েছে। বিদায়ী বাজেটে তা ছিল ২ দশমিক ০৮ শতাংশ।

জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (ইউনেস্কো) জিডিপির ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করার সুপারিশ করে।

গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেন, 'শিক্ষায় বিনিয়োগ জিডিপির ৬ ভাগে যেতে হবে। আমরা ৩ ভাগে আছি। তবে ২০০৬ সালে দেশের যে বাজেট ছিল এখন শিক্ষা বাজেটই তার চেয়ে অনেক বেশি। শিক্ষায় আমরা অনেক বিনিয়োগ করছি। আরও অনেক বিনিয়োগ করতে হবে '

'আমি বিশ্বাস করি, বড় বড় মেগা প্রকল্প হচ্ছে, যেগুলো আমাদের যোগাযোগের জন্য, দেশের এগিয়ে যাওয়ার জন্য দরকার। তেমনি পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন শিক্ষা। সেটিই হবে বড় মেগা প্রকল্প,' যোগ করেন তিনি।

শিক্ষা ঘাটতি

করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে ২০২০ সালের মার্চ (১৭ মার্চ) থেকে দেশের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে বলে অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন, সে সময় অনলাইনে এবং টিভি ও রেডিওর মাধ্যমে পাঠদান অব্যাহত রাখা হয়েছিল। টিভির মাধ্যমে পাঠদান চালিয়ে যাওয়ায় স্কুল পুনরায় খোলা পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার প্রতি মনোযোগী রাখা গেছে।

'এছাড়া, পড়াশোনার অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করতে শিক্ষকরা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে এবং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ রেখে নিয়মিত পাঠদান কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন,' যোগ করেন তিনি।

শিক্ষাবিদরা অবশ্য বলছেন, শহরাঞ্চলের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী ইন্টারনেটের মাধ্যমে শিখতে পারলেও, ডিজিটাল ডিভাইস না থাকা ও দুর্বল ইন্টারনেট সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।

প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষা ক্ষতির মতো গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সমাধানের কোনো উদ্যোগ না থাকায় অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদরা অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

২০২১ সালের অক্টোবরে একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, মহামারির কারণে দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় সারা দেশের প্রায় ৮০ লাখ শিক্ষার্থী শিক্ষা ঘাটতির ঝুঁকিতে আছে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) যৌথভাবে এ সমীক্ষা চালায়।

সমীক্ষায় বলা হয়, প্রাথমিকের ৩৯ লাখ ৬০ হাজার ও মাধ্যমিকের ৩৯ লাখ এই মোট ৭৮ লাখ ৬০ হাজার শিক্ষার্থী শিক্ষা ক্ষতির ঝুঁকিতে আছে।

কিন্তু, বাংলাদেশে কত সংখ্যক শিক্ষার্থীর শিক্ষা-ঘাটতি তৈরি হয়েছে সে সম্পর্কে সরকার এখনো অন্ধকারে আছে।

বাংলাদেশ এক্সামিনেশন ডেভেলপমেন্ট ইউনিট (বেডু) মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের করোনাকালের শিক্ষা ক্ষতি মূল্যায়ন করছে এবং এটি চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে।

সংস্থাটির প্রধান রবিউল কবির চৌধুরী দ্য ডেইলি স্টারকে এ তথ্য জানিয়েছেন।

পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মনে হচ্ছে সরকারের মূল ফোকাস স্কুলগুলো পুনরায় চালু করার দিকে। দুর্ভাগ্যবশত শেখার ক্ষতির চ্যালেঞ্জ সরকার যথাযথ নজর দেয়নি। তাই, আমরা বাজেটে সঠিক প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি না।'

'এ খাতে একটি বড় উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে আমরা আশা করেছিলাম,' যোগ করেন এই গবেষক।

তিনি আরও বলেন, 'শিক্ষা ক্ষতি পুনরুদ্ধারে জাতীয়ভাবে আলোচনা হওয়া উচিত। আমি মনে করি স্কুলগুলোকে শেখার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার ভার তুলে দিতে পারি না। ক্লাস পুনরায় শুরু হওয়ায় তারা, ইতোমধ্যে ব্যস্ত হয়ে গেছেন। কমিউনিটি লেভেলে আমাদের এটি সমাধান করা দরকার।'

ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমেদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দীর্ঘ সময় স্কুল বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষা ঘাটতি আমাদের জন্য একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।'

যেমন ২০২০ সালের মার্চে যে শিশুরা পঞ্চম শ্রেণিতে ছিল, তারা এখন সপ্তম শ্রেণিতে। দুটি ক্লাস তারা পার হয়ে গেছে, কিন্তু নতুন ক্লাসের পড়াশোনা আয়ত্তে আনার জন্য তারা কিন্তু প্রস্তুত নয়।'

এই শিক্ষার্থীদের জন্য তিনি একটি প্রতিকারমূলক পরিকল্পনা নেওয়ার পরামর্শ দেন। পরিকল্পনায় শিক্ষার এ ক্ষতি প্রতিকারে শিক্ষক ও বিদ্যালয়ের জন্য কারিগরি ও আর্থিক সহায়তার কথা উল্লেখ করেন তিনি।

'সরকার হয়তো বাজেটে এ বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো প্রস্তাব করেনি,' যোগ করেন এই শিক্ষাবিদ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ তারিক আহসান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সাধারণত বাংলাদেশের শিক্ষা বাজেট দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় কম হয়ে থাকে।'

তিনি বলেন, 'করোনা মহামারিতে শিক্ষাঙ্গণে যে আঘাত এসেছে, তা পুষিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার নেই। শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য নতুন করে পরিকল্পনা করা প্রয়োজন।'

'শিক্ষক ও শিক্ষার মান বৃদ্ধি এবং বিদ্যালয়ে সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই,' বলেন অধ্যাপক মোহাম্মদ তারিক আহসান।

'শিক্ষকদের সক্ষমতা বাড়ানো একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যেন তারা নতুন পাঠ্যক্রমের কার্যকর বাস্তবায়নে ক্লাসে শিক্ষার্থীদের আরও ভালোভাবে পড়াতে পারেন,' যোগ করেন তিনি।

নতুন পাঠ্যক্রম ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন শুরু হবে। ২০২৫ সালের মধ্যে সেটি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হবে বলে জানিয়েছে সরকার।

ক্যাম্পেইন ফর পপুলার এডুকেশনের (ক্যাম্পে) উপপরিচালক কে এম এনামুল হক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শিক্ষকদের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বিশাল বিনিয়োগ প্রয়োজন। শিক্ষককে এ ক্ষেত্রে উদ্ভাবনী হতে হবে। তাদেরকে সরকারের পক্ষ থেকে এই উদ্ভাবনী হওয়ার প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করতে হবে। যাতে তারা করোনাকালীন শিক্ষা ক্ষতি পুনরুদ্ধারে আরও উৎসাহী হন।'

'শিক্ষা উপকরণের মূল্য বৃদ্ধির কারণে শিক্ষা ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে' উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'সরকারের উচিত উপবৃত্তির মতো সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির আওতা ও পরিমাণ বাড়ানো দরকার।'

মহামারি চলাকালে বাল্যবিবাহের শিকার শিক্ষার্থীদের জন্য তিনি বিশেষ উপবৃত্তি দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন যেন তারা পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে।

Comments

The Daily Star  | English
government decision to abolish DSA

A law that gagged

Some made a differing comment, some drew a political cartoon and some made a joke online – and they all ended up in jail, in some cases for months. This is how the Digital Security Act (DSA) and later the Cyber Security Act (CSA) were used to gag freedom of expression and freedom of the press.

11h ago