খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা: মতিউর রহমান, বীর উত্তম
(মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছরে দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়ে বিশেষ আয়োজন 'মুক্তিযুদ্ধের খেতাবপ্রাপ্ত যোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা'। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাধারণত আমরা ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠের বীরত্ব সম্পর্কে জানি। কিছুটা আড়ালে ঢাকা পড়ে যান আমাদের বাকি খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা। দ্য ডেইলি স্টার উদ্যোগ নিয়েছে সেই জানা ও অজানা মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়মিত প্রকাশ করার। ক্রমানুসারে বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়েই চলছে ধারাবাহিক এই আয়োজন। পর্যায়ক্রমে বীর বিক্রম, বীর প্রতীক মিলিয়ে সর্বমোট ৬৭২ জন মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বগাঁথা প্রকাশ করবে দ্য ডেইলি স্টার। আমাদের আজকের ৫৫তম পর্বে রইল আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী বীর উত্তম'র বীরত্বগাঁথা।)
মুক্তিযুদ্ধের সময় মতিউর রহমান ছিলেন দুর্ধর্ষ নৌ কমান্ডো। মুক্তিযুদ্ধে অবিশ্বাস্য বীরত্ব ও অবদানের জন্য মতিউর রহমানকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। বীর উত্তম খেতাবে তার সনদ নম্বর ৫৫।
১৯৭১ সালের মার্চ মাসে ঢাকায় বেবিট্যাক্সি চালাতেন মতিউর রহমান। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঢাকা থেকে পায়ে হেঁটে আখাউড়া দিয়ে ভারতের আগরতলায় পাড়ি জমান তিনি। এরপর মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।
মুক্তিযুদ্ধের মে মাসের শুরুতে নৌ অপারেশনের জন্য নৌ কমান্ডো দল গঠনের প্রয়োজন পড়ে। এসময় সিদ্ধান্ত হয়েছিল ভারতীয় নেভাল টিমের অধীনে ৩০০ তরুণকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। ঠিক হয়েছিল যেসব তরুণ পানির নিচে দীর্ঘক্ষণ ডুব সাঁতারে পারদর্শী, শারীরিকভাবে সামর্থ্যবান তাদের নিয়ে গঠিত হবে দলটি। বাছাইকৃত তরুণদের মধ্যে নির্বাচিত হয়েছিলেন মতিউর রহমান।
২৩ মে মুক্তিবাহিনীর প্রধান কর্নেল ওসমানীর নির্দেশে নৌ-কমান্ডো সেক্টর গঠনের পর বাছাইকৃত গেরিলাদের ট্রেনিং দেওয়ার উদ্দেশ্যে একটি গোপন ক্যাম্প খোলা হয় ঐতিহাসিক পলাশীর স্মৃতিসৌধের পাশে ভাগীরথী নদীর তীরে। তাদের ট্রেনিং শুরুর আগেই বলা হয়েছিল এটি একটি আত্মঘাতী যুদ্ধ। তাই অপারেশনের সময় যেকোনো মূল্যে অপারেশন সফল করার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনে তাদের প্রাণ দিতে হতে পারে। তাই প্রশিক্ষণের শুরুতেই প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থীদের ছবিসহ একটি সম্মতিসূচক পাতায় স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছিলো। তাতে লেখা ছিল, 'আমি দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন বিসর্জন দিতে সম্মত হয়েই এই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছি, আর যুদ্ধে আমার মৃত্যু ঘটলে কেউ দায়ী থাকবে না।'
এরপর টানা আড়াই মাস তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন ২০ জন ভারতীয় এবং ফ্রান্স থেকে পালিয়ে আসা ৮ জন বাঙালি সাবমেরিনার। আগস্টের প্রথম সপ্তাহে প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার পরে ২টি সমুদ্র বন্দর এবং ২টি নদী বন্দর আক্রমণের লক্ষ্যে ৪টি সেক্টরের পরিকল্পনায় সাজানো হয়। প্রথম ব্যাচকে ৬০ জনের ২টি দল এবং ২০ জনের ২টি দল নিয়ে মোট ৪টি স্থানে আক্রমণের জন্য ৪টি দলে ভাগ করা হয়।
অপারেশন জ্যাকপট সফল করার জন্য প্রতিজন নৌ কমান্ডোদের দেওয়া হয় ১টি সুইমিং কস্টিউম, ১টি করে লিমপেট মাইন, ১ জোড়া ফিনস, ১টি ধারালো ছুরি, হ্যান্ড গ্রেনেড, এক্সপ্লোসিভ। প্রতিটি দলের সঙ্গে দেওয়া হয়েছিল স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র এবং কিছু টাকা। সঙ্গে প্রত্যেক দলনেতাকে দেওয়া হয়েছিল সতর্ক সংকেত শোনার জন্য একব্যান্ড রেডিও।
অপারেশন জ্যাকপটের অন্যতম অংশ দাউদকান্দি ফেরিঘাট আক্রমণের লক্ষ্যে কমান্ডো শাহজাহান সিদ্দীকির নেতৃত্বে ৯ জন কমান্ডো নিয়ে গঠিত হয়েছিল পঞ্চম দল। এই দলে অন্যতম নৌ কমান্ডো ছিলেন মতিউর রহমান।
পলাশীতে নৌ কমান্ডোদের অপারেশন শেষ হওয়ার আগেই অপারেশন জ্যাকপটের অভিযান পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়ে যায়। ২ আগস্ট দুপুরে পলাশী ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে রওয়ানা দিয়ে রাত ৯টায় ব্যারাকপুর ক্যান্টনমেন্টে পৌঁছে পরদিন সকালে কলকাতার দমদম বিমানঘাঁটি থেকে ড্যাকোটা বিমানে চেপে ৪ আগস্ট ভোরে আগরতলায় এসে নিউক্যাম্পে উঠেন মতিউর রহমানসহ কমান্ডোরা। এরপর ৬-৮ আগস্ট বাংলাদেশের নদীবন্দরগুলোকে চিহ্নিতকরণ, নদনদীর মানচিত্র, জোয়ারভাটা বাতাসসহ স্রোতের গতিপ্রকৃতি সবকিছু বিবেচনা করে একটি চার্ট তৈরি করা হয়।
এরপর কমান্ডো শাহজাহান সিদ্দিকীর নেতৃত্বে মতিউর রহমানসহ ৯ জন নৌ কমান্ডোর দলটিকে দাউদকান্দি ফেরিঘাটে অপারেশনের জন্য পাঠানো হয়। ১১ আগস্ট ভারতীয় ট্রাক তাদের কুমিল্লার কংশনগরের কাছে সীমান্তে নামিয়ে দেয়। এরপর মতিউর রহমানসহ কমান্ডোরা পায়ে হেঁটে, নৌকায় চেপে দাউদকান্দির বন্ধরামপুর গ্রামে এসে পৌঁছে বন্ধরামপুরের পীর আল্লামা শাহ কামাল সাহেবের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। এটিই ছিল কমান্ডোদের অস্থায়ী ক্যাম্প।
১৩ আগস্ট রাতেই রেডিওতে বেজে উঠে পঙ্কজ মল্লিকের কণ্ঠে 'আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলাম'গান। এই গান শোনার পর দলের অধিনায়ক সবাইকে প্রস্তুত হতে বলেন। ১৪ আগস্ট দাউদকান্দি ফেরীঘাট ও তৎসংলগ্ন অঞ্চল রেকি করেন দলের অধিনায়ক শাহজাহান সিদ্দিকী এবং সহঅধিনায়ক মতিউর রহমান। তারা একটি ছইওয়ালা নৌকায় দাউদকান্দি ফেরীঘাটের উত্তর দিকে নদীতে নৌকা চালু রেখেই গামছা পেঁচিয়ে নদীতে নেমে স্রোতের গতি ও বেগ পরখ করেন।
এইভাবে ফেরীঘাট ও ফেরীর অবস্থান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। যেহেতু দাউদকান্দি ফেরীঘাট থেকে পূর্ব পশ্চিমে ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়ক সেহেতু দলনেতা সিদ্ধান্ত নেন অপারেশনের পর কমান্ডোদের নিয়ে স্রোতের অনুকূলে সাঁতার কেটে ভাটির দিকে নিয়ে আশ্রয় নেওয়ার পরিবর্তে স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কেটে উত্তর দিকে আশ্রয়গ্রহণকারী নৌকায় ফিরে আসতে হবে। ৯ জন কমান্ডোর মধ্যে একজনকে পাবনার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলার কারণে শেষ মুহূর্তে হাসান নূর নামের এক কমান্ডোকে বাদ দেওয়া হয়। অপারেশনের গাইড ছিলেন আবুল কাশেম এবং আবদুল মান্নান নামের দুই বীর মুক্তিযোদ্ধা।
পূর্ব নির্ধারিত দিনক্ষণ অনুযায়ী প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টির মধ্যেই নৌকায় রওয়ানা দেন কমান্ডোরা। পথিমধ্যে গাইড আবুল কাশেম অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেদিনের মতো অপারেশন স্থগিত রাখা হয়।
১৬ আগস্ট সন্ধ্যায় রাতের খাবার খেয়ে সুইমিং কস্টিউম পরে ২টি নৌকায় ধানখেতের মধ্য দিয়ে বন্ধরামপুর থেকে দাউদকান্দির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন মতিউর রহমানসহ নৌ কমান্ডোরা। দাউদকান্দি ফেরীঘাট ছিল সেখান থেকে প্রায় পাঁচমাইল দূরত্বে। রাত আনুমানিক ১টার দিকে দাউদকান্দি ফেরীঘাট থেকে এক মাইল দূরে নদী তীরবর্তী ধানখেতের মধ্যে বড় নৌকাটি রেখে ছোট নৌকায় তিন জন করে মোট ছয় জন কমান্ডোকে টার্গেটের কাছে পাঠানো হয়। শেষের ট্রিপে ছিলেন দলনেতা। এরপর নৌকা ফেরত নিয়ে যাওয়া হয়।
মতিউর রহমানসহ ৬ কমান্ডো ফেরিঘাট থেকে সাঁতার কেটে কোমর থেকে ড্যাগার খুলে ডুব দিয়ে অদূরে নোঙ্গরকৃত জলের গভীরে ডুব দিয়ে ২টি ফেরির তলদেশের শ্যাওলা উঠিয়ে নিয়ে ৩টি করে লিমপেট মাইন স্থাপন করেন। এরপর দলনেতা ও কমান্ডো নুরুল ইসলাম নিঃশব্দে ফেরিঘাটের পন্টুনে ২টি মাইন লাগান। এরপর ২টি টার্গেটে লিমপেট মাইন স্থাপন করে স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কেটে নদীর উত্তরপাড়ে উদ্ধারকারী কোষা নৌকায় করে বড় নৌকায় এসে হাজির হন। তারা যখন ফিরে আসেন তখন রাত পৌনে ৩টা।
এরপর অতিদ্রুত নৌকার বৈঠা বেয়ে বন্ধরামপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। মতিউর রহমানসহ কমান্ডোরা রওয়ানা হওয়ার মাত্র ৫ মিনিট পরেই ৯টি লিমপেট মাইন বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়। সঙ্গে সঙ্গে কমান্ডোরা বুঝতে পারেন পাকিস্তানি বাহিনী দাউদকান্দি ফেরিঘাট থেকে পশ্চিম দিকে নদীতে ও চরের দিকে একনাগাড়ে মেশিনগানের গুলিবর্ষণ ও মর্টারের গোলাবর্ষণ শুরু করেছে। পাকিস্তানি বাহিনী অনুমান করেছিল কিছু সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা পশ্চিম দিক থেকে ফেরিঘাট আক্রমণ করেছে। এদিকে মাইন বিস্ফোরণের বিকট শব্দে আশপাশের কয়েকটি এলাকার মানুষও আতঙ্কে ঘুম থেকে সজাগ হয়ে উঠে। নৌ কমান্ডোরা যখন বন্ধরামপুরের দিকে যাচ্ছে তখন তারা দেখতে পান ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট থেকে কয়েকটি মিলিটারি লরি এবং জিপ দাউদকান্দির দিকে ছুটে যাচ্ছে।
শেষরাতে পীর সাহেবের বাড়ির ঘাটে এসে পৌঁছান মতিউর রহমানসহ নৌ কমান্ডোরা। প্রায় ৫ মাইল দূরের পীর সাহেবের বাড়িতেও মাইন বিস্ফোরণের গগণবিদারী শব্দ শোনা গিয়েছিল। এরপর ১৭ আগস্ট আনুমানিক সকাল ১১টার দিকে আগরতলার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়ে সীমান্তে বাসে চড়ে আগরতলা পৌঁছান। অপারেশন জ্যাকপটের পরেও বেশ কয়েকটি নৌ অপারেশনে অংশ নিয়ে অসামান্য বীরত্ব দেখিয়েছিলেন মতিউর রহমান বীর উত্তম।
মতিউর রহমানের জন্ম ১৯৫০ সালে কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি উপজেলার রঘুনাথপুর গ্রামে। মুক্তিযুদ্ধের পর ঢাকা ছেড়ে কাজের সন্ধানে গাইবান্ধা চলে যান মতিউর রহমান। সেখানে ২ বছর থাকার পর পরবর্তীতে চলে যান লালমনিরহাটে। লালমনিরহাটে বিয়ে করে আনসার বাহিনীতে যোগ দিয়ে সেখানেই স্থায়ী হয়ে যান তিনি। ১৯৯৬ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন মতিউর রহমান বীর উত্তম।
তথ্যসূত্র:
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র ১০ম খণ্ড
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: সেক্টর ভিত্তিক ইতিহাস ১০ম খণ্ড
Comments